প্যারিসে দিনযাপনের সাতকাহন ও টিমবাকটু
প্যারিসের হোটেল ডে আর্টসে সপ্তাহ তিনেক বসবাসের সুবাদে আডেলিনার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আমার মানসলোকে স্ট্রেস তুমুল হলে তার সান্নিধ্য কামনা করা আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেজাজ খারাপ হলে- চেষ্টা করি তার সঙ্গে কথা বলে, আউটিংয়ে গিয়ে, একত্রে থিয়েটার দেখে বা কনসার্ট শুনে এ দুঃসময় অতিক্রম করতে।
ক্যাফেতে কাপাচিনো পান করতে করতে তার সঙ্গে একাধিকবার অন্তরঙ্গ বাতচিত করেছি, গল্পচ্ছলে জানতে পেরেছি যে আবাসিক এ ফেসিলিটিতে ফুল সরবরাহের পার্টটাইম কাজে যুক্ত থাকলেও আদতে আডেলিনা হোটেল ডে আর্টসের শেয়ারহোল্ডার, অর্থাৎ বুটিক হোটেলটির তিরিশ শতাংশের মালিকিন। সে নিজ থেকে আমাকে বলেছে, সচরাচর সাড়ে এগারোটার পর তার হাতে বেশ কিছুটা সময় ফ্রি থাকে। আমি চাইলে তখন তার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে পারি।
দিন তিনেক আগে পেশাগত কাজে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনায় আমার স্নায়ুতে মারাত্মকভাবে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তখন এ বিষয়টি মাথা থেকে সরিয়ে কিছুটা সময় অন্যভাবে আডেলিনার সাথে কাটাতে চেয়েছিলাম। ঘটনা জানতে পেরে, আডেলিনা নিজে থেকে আমার সঙ্গে সম্পর্ককে আরও নিবিড় করার উদ্যোগ নিয়েছে। হোটেল ডে আর্টস থেকে বেরিয়ে আমরা ক্যাফেতে বসেছি। সে অতঃপর আমাকে নিয়ে গেছে পিয়ারে বনার্ড নামে তার প্রিয় এক শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীতে।
আজ এ মুহূর্তে আডেলিনা হোটেল ডে আর্টসের লাউঞ্জটির ফ্লাওয়ার ভাসগুলোতে তাজা ফুল গুঁজে তাতে স্পেয়ার দিয়ে পানি ছড়াচ্ছে। মৃদু স্বরে কক কক ধ্বনি হলে বুঝতে পারি, আডেলিনা আজ সাথে করে নিয়ে এসেছে তার পোষা মুরগি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি, লাউঞ্জের সাইড টেবিলে ঝুড়িতে রাখা রংচঙে কুক্কুটটি তাকাচ্ছে কৌতূহলী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিকে।
মুরগিটির নাম এসমেরেলডা। শুনেছি- তাকে আডেলিনা বছর দুয়েক আগে আফ্রিকার মালিতে বেড়ানোর সময় জোগাড় করেছে। ভিক্টোর হুগোর দ্য হান্সবেক অব নটরডাম উপন্যাসে এ নামে জিপসি সম্প্রদায়ের এক নায়িকা আছে। এসমেরেলডা শব্দটির সাথে সবুজ পাথর এমারল্ডের সম্পর্ক আছে। খেয়াল করে দেখি, মুরগিটির পিঠের পালকে আটকানো কালো ভেলভেটের রিবনে তৈরি একটি ফুল, আর তাতে ঝকঝক করছে ফ্লুরাইট পাথরের সবুজ একটি চাকলা।
তো আডেলিনার এ পোষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ হয়। ফুল সাজানো শেষ হলে সে লাউঞ্জের আয়নার সামনে একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়ায়। বুনোফুলের গন্ধ ভেসে এলে বুঝতে পারি, নারীটি শরীরে পারফিউম ছড়িয়ে ফ্রেশ হচ্ছে। একটু আগে আমি লাউঞ্জের এক কোণে রাখা টেবিলটিতে লিখতে বসেছি। তার উপস্থিতিতে আমি দারুণভাবে সচেতন হয়ে উঠি, তাই আর লেখাতে মনযোগ দিতে পারি না। সে টেনে জানালার কার্টেনগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। চোখে আলো এসে পড়লে, আমি পার্পল শেডের রোদচশমাটি পরে অধীর হয়ে কিসের যেন প্রতীক্ষা করি।
আডেলিনা মুরগির ঝুড়ি হাতে লাউঞ্জের প্রান্তিকে খানিক অন্ধকার কর্নারে এসে মোম জ্বালে। ঝুড়িটির কোনায় গোঁজা ডাটিওয়ালা একটি সবুজাভ গোলাপ। সে মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেন জনান্তিকে কথা বলছে এভাবে বলে, 'আই নো ইউ আর আ রাইটার, শুনেছি, রাইটারদের ইনটিউশন হয় খুব প্রখর, তুমি বলতে পারবে কী মোমবাতি জ¦ালাতে গিয়ে এসমেরেলডার মনে খেলা করছে কী ধরনের উইশ?'
আমার অবচেতন বোধ করি এ ধরনের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল, তাই চটজলদি জবাব দিই, 'এসমেরেলডা মনে মনে প্রার্থনা করছে মালির টিমবাকটু শহরে ফিরে যাওয়ার।' আমার দিকে এবার সরাসরি তাকিয়ে আডেলিনা রহস্যময় হেসে বলে, 'ইউ আর নট হানড্রেড পারসেন্ট রাইট বাট কোয়াইট ক্লোজ।'
সে একটু পজ নেয়, তারপর আবার বলে, 'বাই দ্যা ওয়ে, পার্পোল শেডের সানগ্লাসটি তোমার সিল্কি এক্সোটিক আউটফিটের সাথে মিশ খেয়েছে চমৎকার। কালারফুল বৃত্তাকার এ ধরনের কাচকে বলে মিডনাইট আউল সার্কোল, শেইপটি আমার খুব পছন্দের।'
কথা শুনতে শুনতে একটা বিষয় খেয়াল করি, তার শরীরে যেন বর্ষার জলপ্রপাতের মতো ঝলমল করছে যৌবন। যখনই সে আমার দিকে তাকাচ্ছে, তখনই মনে হয়, তার গ-দেশ রক্তিম হয়ে উঠছে, আর প্রসারিত হচ্ছে নীলাভ ডাগর দুটি চোখ। আমার দিকে তাকিয়ে সে যেন কী একটা খুঁজছে আমার আচরণে।
এবার সে মুরগির ঝুড়িসহ আমার টেবিলে এসে নতমুখী হয়ে জানতে চায়, 'এসমেরেলডা তোমার টেবিলে একটি সবুজাভ গোলাপ রাখতে চাইলে তোমার লেখাজোখার ফ্লোতে ছেদ পড়বে কি?' আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে 'নট অ্যাট অল' বলে সম্মতি দেয়ার আগেই সে কাচের ফুলদানিতে তা গুঁজে আমার টেবিলে রাখে।
আডেলিনা খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, এ সুযোগে আমি প্রশ্ন করি, 'ইট সিমস ইউ নো কোয়াইট আ বিট অ্যাবাউট দিস কাইন্ড অব সানগ্লাস?' 'ওহ ইয়েস,' বলে খানিক উচ্ছল হয়ে সে জানায়, 'এ্যাজ আ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট আমার সল্পকালীন এক কম্পেনিয়ন গ্রেগরি ফ্যালাসি এ ধরনের এভিয়েটর সানগ্লাস পরে ফ্লাই করতে ভালোবাসত। হি ওয়াজ আ ভেরি নাইস, রেস্টলেস অ্যান্ড কাইন্ড অব এক্সাইটিং গাই।'
আমি আলোচনাকে আরেকটু বিস্তারিত করার সুযোগ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'ডু ইউ মিস হিম?' 'ওহ ইয়েস, খুবই ব্যতিক্রমী পুরুষ ছিল সে,' যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এভাবে একটু বাক্রহিত হালতে দাঁড়িয়ে থেকে, গ-দেশে সেলারের অন্ধকার কোণে অনেক বছর পড়ে থাকা রেড ওয়াইনের লালচে গোলাপি আভা ফুটিয়ে তুলে ফরাসিতে কিছু বললে আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
একটু অধৈর্য হয়ে সে শরীরের ইঙ্গিতময় ভঙ্গি করে মৃদু স্বরে ব্যাখ্যা করে, 'হি ওয়াজ...ইউ নো...ভেরি গুড এ্যাট ফোরপ্লে, শৃঙ্গারে সে ছিল খুবই সৃজনশীল। গ্রেগরি কাজ করত যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্সে। ফ্রান্সে জঙ্গিবিমানের প্রদর্শনীতে যোগ দিতে আসলে আমার সাথে পরিচয় হয়। তার পেশাদারি দ্বায়িত্ব শেষ হলে দিন দশেক আমার অতিথি হয়ে সে প্যারিসে থেকে যায়। আমরা তখন ঘুরে ঘুরে দেখি, এখানকার উড্ডয়ন জাদুঘরে রাখা হালফিল বাতিল হয়ে যাওয়া পুরানো দিনের অনেকগুলো উড়েজাহাজ।'
'যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর গ্রেগরি ফ্যালাসির সাথে তোমার আর কোনো যোগাযোগ হয়েছিল কি?' আডেলিনা ম্লান হেসে জবাব দেয়, 'গ্রেগরি পোস্টেড ছিল হাওয়াই দ্বীপের একটি এয়ার বেসে। আমাকে সে দুই সপ্তাহের জন্য ইনভাইট করে। অ্যান্ড ইট ওয়াজ আ রির্মাকয়েবলি ফান টু উইকস। কাজ থেকে সে পার্টটাইম ছুটি নিয়েছিল। সকাল বেলা ঘণ্টা পাঁচেক ডিউটি করে সোজা চলে আসত। আমার বেড অ্যান্ড ব্রেকফার্স্ট ধাঁচের গেস্টহাউসে। জঙ্গিবিমানের ঘাঁটিতে তার ডিউটি ছিল ফ্যান্টম ফাইটার প্লেনগুলোকে উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত করে রাখা।'
আমি এবার জানতে চাই, 'হাউ ওয়াজ হিজ ওয়ার্ক?' ম্লান হেসে সে জবাব দেয়, 'ইট ওয়াজ স্ট্রেসফুল। বিকালের দিকে গেস্টহাউসে এসে আমাকে তুলে নিয়ে সে জিপ হাঁকাত সামান্য দূরের এক প্রাইভেট এয়ার স্ট্রিপের দিকে। ওখান থেকে সে ফ্লাই করত ভাড়া করা একটি সল্পগতিসম্পন্ন পাইপার প্লেন।'
সামান্য বিরতি নিয়ে আডেলিনা ফের কথা বলে, 'আমরা ধোঁয়া-ওড়া আগ্নেয়গিরির ওপর দিয়ে উড়ে যেতাম কালাওয়ায়ো দ্বীপের দিকে। কখনো মাউই দ্বীপের নিশানায় ফ্লাই করে খুব দক্ষতায় সমুদ্রজলের কাছে ছোট্ট বিমানটি নামিয়ে এনে গ্লাইড করতে করতে সে আমাকে দেখাত ভাসমান মাছের স্কুলে শিকারে মেতে ওঠা আমিষভোজী হাঙ্গরদের ক্রিয়াকলাপ। অ্যান্ড টু টেল ইউ সুপার ফ্র্যাকংলি... আমার শরীর খুব পছন্দ করেছিল সে। প্লেন অটো পাইলটে দিয়ে গ্রেগরি সুঠাম হাতে মেতে উঠত অত্যন্ত সৃজনশীল শৃঙ্গারে। তার হাত আমাকে বারবার স্পর্শ করলেও দৃষ্টি বিনিময়ে ছিল লাজুক, সে সব সময় বেগুনি শেডের আউল সার্কেল শেপের সানগ্লাস পরে থাকত বলে সূর্যালোকের বিচ্ছুরিত আভায় তাকে দেখাত খানিক জোৎস্নামদির।'
আমাদের কথাবার্তা জমে উঠছে, তাই আমি আরও কিছু বিষয় জানতে চাই, জিজ্ঞেস করি, 'ইট সিমড লাইক ইউ ট্রুলি হ্যাড ফান উইথ হিম, তার কোনো আচরণ কী তোমাকে ক্লান্ত, ত্যক্ত-বিরক্ত করত?'
আডেলিনা গ্রীবা বাঁকিয়ে কী যেন ভেবে বলে, 'ঠিক ক্লান্ত না, তবে একটা ব্যাপার আমি একেবারেই পছন্দ করতাম না। তার বেডরুমের হাতবাক্সে বাস করত সবুজ একটি নির্বিষ সাপ। খুব ঘনিষ্ট মুহূর্তে কু-লী পাকানো সাপটি আমার শরীরে ছেড়ে দিয়ে সে তাকিয়ে থাকত। ছোট্ট এ রেপটাইল পছন্দ করত আমার বুকের উষ্ণতা, তাই বসে থাকতে চাইত কু-লী পাকিয়ে।'
এ পর্যন্ত বলে অ্যাডেলিনা লাজরক্তিম হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়। সে নতমুখী হয়ে যেন অদৃশ্য কাকে কিছু বলছে, এভাবে জানায়, 'অভার অল হি ওয়াজ আ সুপার ফাইন মেইল কম্পেনিওন, আমাকে নিয়ে একটু স্বপ্ন দেখতেও শুরু করেছিল। গ্রেগরি ছিল খুবই করিৎকর্মা পুরুষ। ঘর তৈরি করা, কাঠমিস্ত্রির কাজ, এসব সে ভালোভাবেই জানত। নকশা করেছিল একটি ট্রি-হাউস বানানোর। বলত- ইট ইজ গোয়িং টু বি আওয়ার মুনলাইট রিট্রিট, হাওয়াই দ্বীপের চাঁদনি রাতে- বিশাল বৃক্ষের অনেক উঁচুতে ছোট্ট একটি কুটিরের জানালার পাশে বসে থাকতে তোমার খুব ভালো লাগবে আডেলিনা। ইট উইল বি- ইউ, মি অ্যান্ড আওয়ার লিটিল গ্রিন স্নেইক।'
আডেলিনার ফ্র্যাংকনেস আমার খুবই ভালো লাগে, তবে তার হাওয়াই দ্বীপবাসী পুরুষ সুহৃদ গ্রেগরি সম্পর্কে আমি একটু কনক্লুসনে আসতে চাই। সুতরাং জিজ্ঞেস করি, 'তার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তুমি পাস্ট টেন্স ব্যবহার করছ, ইজ হি নট অ্যারাউন্ড এনি মোর?'
জবাবে আডেলিনা ম্লান হেসে নিরাসক্তভাবে বলে, 'ইটস ট্রু হি ইজ নট হিয়ার ইন প্যারিস অর ইন হাওয়াই, বাট আই অ্যাম শিওর হি ইজ অ্যারাউন্ড সাম হোয়ার ইন দিস ইউনিভার্স, আমি তাকে দেখতে পাই না, তার উপস্থিতিও অনুভব করি না, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে পড়ে উষ্ণম-লীয় একটি অসাধারণ দ্বীপ, তার মৃদুমন্দ হাওয়ায় কেঁপে ওঠা ঝিরিঝিরি পত্রালি, রাতবিরাতে ঝেঁপে আসা ফুলের তীব্র গন্ধের মতো ভেসে আসে গ্রেগরির স্মৃতি।'
আমি এবার সরাসরি জানতে চাই, 'ওয়াজ গ্রেগরি আ ক্যানসার ক্যাজুয়েলটি? নাকি তার মৃত্যু হয়েছে ইরাক যুদ্ধে?' আডেলিনা আবার জনান্তিকে কথা বলে, 'ছুটি নিয়ে গ্রেগরি এয়ার শোতে যোগ দিয়েছিল, আকাশে ছোট্ট একটি বিমানের কসরত দেখাতে গিয়ে ক্রাশ করে তার মৃত্যু হয়, ইট ওয়াজ অ্যাবাউট ফোর ইয়ার্স এগো।'
আমি প্রিয় পুরুষের স্মৃতিতে বিধুর হওয়া নারীকে তার নিজস্ব বিষয় নিয়ে নীরবে তর্পণের সুযোগ দিতে চাই, তাই বলি, 'মার্সি, মার্সি বকু আডেলিনা, আই মাস্ট সে আ বিগ থ্যাংক ইউ ফর শেয়ারিং আ লিটিল বিট অব ইয়োর লাইফ, আমি এবার উঠি? ওকে?'
হাত ধরে আমাকে বসিয়ে দিয়ে সে বলে, 'লুক, আই হ্যাভ আ লং লাইফ অ্যান্ড আ লট মোর ইন্টারেস্টিং স্টোরিস ইন মাই স্টক। আমার শুধুমাত্র একটা গল্পেই কী তুমি ঘা খেয়ে গেলে, ডোনচ ইউ নট লাইক টু হিয়ার এনিথিং এ্যলজ?'
জবাবে আমি বলি, 'কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে, সো, আই উড নট মাইন্ড হ্যাংগ আরাউন্ড আ লিটিল বিট।' ব্রিফকেসের মতো বিশাল একটি পার্সের ডালা খুলতে খুলতে সে বলে, 'হাউ আবাউট আ ড্রিংক? দুপুরে লাঞ্চের আগে তুমি কী পান করতে পছন্দ করো?'
আমি জবাব দিই, ' সিম্পল জিন উইথ প্লান্টি অব টনিক ওয়াটার, সাথে কিছু আইস কিউব আর এক টুকরা সবুজ লাইম হলে চমৎকার হয়।' যেন নোংরা বস্তিতে প্রচলিত খারাপ কোনো স্ল্যাংগ ইউজ করেছি, এভাবে প্রতিক্রিয়ায় চোখমুখ বিকৃত করে সে বলে, 'দিস সাউন্ডস সো ব্রিটিশ, জিন অ্যান্ড টনিক ওয়াটার, জননী মরিয়ম, প্লিজ মার্সি আপন আস।'
সে কপট ভঙ্গিতে বুকে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে আবার বলে, 'লিসেন ইউ হ্যান্ডসাম গাই, জাস্ট রিমেমভার, ইউ আর সিটিং ইন দ্য হার্ট অব মোঁমাত...প্যারিস, দিস ইজ ফ্রান্স...ডু ইউ মাইন্ড সিপিং সাম ওয়াইট ওয়াইন উইথ মি।'
আডেলিনা বিশাল পার্স থেকে শ্যার্ডিনের একটি বোতল বের করলে আমি মাথা হেলিয়ে রাজি হই। তার পার্স থেকে বের হয় কাঠের ছোট্ট একটি বাক্স, তাতে গ্লাস বাবলে মোড়া ক্রিস্টালের দুটি গ্লাস। সে গ্লাসে পানীয় ঢেলে টোস্ট করার কায়দায় বলে, 'ওয়েলকাম টু মোঁমাত...প্যারি, লেটস হ্যাভ আ ফ্রেঞ্চ মোমেন্ট।'
ঠিক তখনই এসমেরেলডা কক কক করে উঠলে আমি ছোট্ট একটি সিপ নিয়ে বলি, 'এসমেরেলডা ইজ অলসো ট্রায়িং টু হ্যাভ আ ফেঞ্চ মোমেন্ট, প্লিজ টেল মি অ্যাবাউট দিস আফ্রিকান চিকেন আ লিটিল বিট, উইল ইউ?'
পান করতে করতে আডেলিনা ওয়েস্ট আফ্রিকার মালি নামে একটি দেশে তার বছরখানেক আগে ভ্রমণের কাহিনি বলে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সে তার মালিতে সফরের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে। মালির অনেকটাজুড়ে বিস্তারিত হয়েছে সাহারা মরুভূমি। ওখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম তোরাগ। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি করতে চায় 'আজওয়াড' নামে নতুন একটি দেশ।
বছর কয়েক আগে তোরাগদের গেরিলা যুদ্ধ টিমবাকটু বলে মধ্যযুগে নির্মিত কাদামাটির দেয়ালঘেরা শহর অব্দি বিস্তৃত হলে আন্তর্জাতিক সমাজের টনক নড়ে। পুরানো দিনের রহস্যময় নগরী টিমবাকটুর দুনিয়াজোড়া সুনাম মরুমৃত্তিকা দিয়ে তৈরি মসজিদের অনুপম স্থাপত্যকলার জন্য। একসময় কায়রো বা বাগদাদ থেকে উটের তেজারতি কাফেলা এসে থামত এ নগরীতে। টিমবাকটুতে সংরক্ষিত আছে ভূর্জপত্র ও চামড়ার পার্চমেন্টে চৌদ্দ থেকে পনেরো শতকে লেখা প্রায় সত্তর হাজারের মতো পা-ুলিপি, যা হাল জামানায় বিবেচিত হচ্ছে বিশ^সভ্যতার ঐতিহ্য হিসেবে। ইউনেসকো টিমবাকটুকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
তোরাগদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামে একসময় যুক্ত হয় উগ্রপন্থী ইসলামি ভাবধারায় গড়ে ওঠা আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের অনুসারী আনসার আল দীন বলে একটি সংগঠন। তারা নারীশিক্ষা, বোরকাবিহীন চলাফেরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পীর-ফকিরদের মাজার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
আনসার আল দীনের আমির ফাকি আল মাহদি বালিকা বিদ্যালয়ের অবিবাহিতা শিক্ষয়িত্রীদের বেশরিয়তি আচরণের সাজা হিসেবে তার মুজাহিদ কমান্ডারদের সাথে 'মুতা' পদ্ধতিতে বিবাহের আয়োজন করে। বিবাহিতা নারী-শিক্ষকদের স্বামীদের ডেকে এনে দোররা মেরে জমায়েতের সামনে তাদের নিজ নিজ স্ত্রীদের তালাকদানে বাধ্য করা হয়, যাতে মুজাহিদ কমান্ডাররা 'হিল্লা' পদ্ধতিতে তাদের সাথে সহবাস করতে পারে। এ ছাড়া আনসার আল দীনরা বেশ কিছু ঐতিহাসিক পা-লিপি, বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্র, বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে লেখা বইপত্র ধ্বংস করে।
একপর্যায়ে আনসার আল দীনের সশস্ত্র প্রভাববলয় মালি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স ওখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ফ্রেঞ্চ সৈনিকেরা টিমবাকটু শহরটি পুনরায় দখল করে খানিকটা আইনি শাসন জারি করলে ফরাসি নাগরিকদের একটি ডেলিগেশন বিষয়টি সরেজমিনে দেখার জন্য প্রথমে মালির রাজধানী বামাকো এবং তার পরে টিমবাকটু শহরে যায়। আডেলিনা এ ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে মালি সফরের সুযোগ পায়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কারণে টিমবাকটুতে আনসার আল দীনের কার্যকলাপ সম্পর্কে আমি কমবেশি অবগত। তাই আডেলিনার দীর্ঘ প্রেক্ষাপট বর্ণনায় অধৈর্য হয়ে বলি, 'জাস্ট টেল মি হাউ ইট ওয়াজ লাইক ট্র্যাভেলিং থ্রু টিমবাকটু।'
সে জবাব দেয়, 'নাইজার নদীর মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে আদি যুগের শহরটি আগের মতোই আছে। আনসার আল দীনরা সবগুলো মসজিদ, কেল্লা বা স্থাপনা ধ্বংস করেনি, শহরে লোকজন এখনো গাধার গাড়িতে মালপত্র টানে, উটের পিঠে লবণের সওদা বোঝাই করে কাফেলায় পাড়ি দেয় মরুসাহারা।'
এ পর্যন্ত বলে আডেলিনা আইফোনে তোলা টিমবাকটুর ছবিগুলো দেখায়। অবাক হয়ে দেখি, তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে থাকা টিমবাকটুর কাদামাটিতে তৈরি একটি আসাধারণ ইমারত। পরের ছবির সরণিটি খানিকটা আধুনিক হলেও প্রশস্ত সড়ক ধরে রাখালের তাড়া খেয়ে পথ চলছে অনেকগুলো শিংবাঁকা ছাগল।
যে ছবিটি আমার মনে তীব্রভাবে দাগ কাটে, তা হচ্ছে, আহমদ বাবা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা জ্বলাপোড়া পা-ুুলিপির পাতা ও একাধিক স্ক্রিপ্ট কেইস। আমরা টিমবাকটুর আহমদ বাবা ইনস্টিটিউট নিয়ে টুকটাক কথা বলি। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাবেকি এ ইনস্টিটিউটকে ফান্ড প্রদান করে বন্দোবস্ত করেছিলেন বিগত জামানার অমূল্য গ্রন্থরাজি সংরক্ষণের। তাঁর উদ্যোগে স্ক্রিপ্ট কেইস বা বিশেষ রকমের ফায়ারপ্রুফ বাক্সে পুঁথিপুস্তকগুলো হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা হয়। আনসার আল দীনের জঙ্গি জওয়ানরা আহমদ বাবা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঢুকে পড়ে জ্যোতিষশাস্ত্র, ভেষজ চিকিৎসা ইত্যাদি নানা বিষয়ের পা-ুুলিপিগুলো পুড়িয়ে ফায়ারপ্রুফ স্ক্রিপ্ট কেইসগুলো ছুড়ে ফেলে ইনস্টিটিউটের মেঝেতে।
আমি এবার জানতে চাই, 'আডেলিনা, হোয়াট ওয়াজ দ্য ফোকাস অব ইয়োর ভিজিট? টিমবাকটুতে কোন বিষয়টি তুমি খেয়াল করে স্টাডি করেছ?'
সে মৃদু হেসে জবাব দেয়, 'ইউ প্রবাবলি ডোন্ট নো আই লাইক টু কালেক্ট ইনডিজিনিয়াস পারফিউম। টিমবাকটুর দুটো পারফিউমের কথা আমি মালিতে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম। একটি ফ্রান্সে মালি-ব্লসম নামে পরিচিত। এতে জেসমিনের নোটসের সাথে দারুচিনি ও ভেনিলার হালকা সৌরভ মিশে গিয়ে তৈরি করে একধরনের ট্রুলি সেননুয়াস ফ্রেগরেন্স।'
'তো আডেলিনা, মালি-ব্লসম প্যারিসে পাওয়া গেলে টিমবাকটুতে তা খোঁজাখুঁজি করছিলে কেন?' সে জবাব দেয়, 'আমি জানতে চেয়েছিলাম, ফ্রান্সে প্রক্রিয়াজাত হওয়ার আগে স্থানীয়ভাবে এ পারফিউমের আদি রূপ কী? টিমবাকটু শহরে গাইডদের সাথে কথাবার্তা বলে জানতে পারি যে এ ধরনের সুগন্ধির স্থানীয় নাম হচ্ছে আফিফা বা পিওর, কাফেলায় সওয়ার হয়ে সাহারা পাড়ি দেওয়ার আগের রাতে পুরুষেরা উসুলান বলে একটি রিচ্যুয়ালের মাধ্যমে তাদের প্রিয় নারীর শরীরে মাখিয়ে দিত আফিফা। মালি দেশের তোরাগ সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করে- এ সৌরভে তৈরি হয় চমৎকার স্মৃতি, যদি উটের সওয়ারি পুরুষ ফিরে না আসে, তাহলেও সে বেঁচে থাকবে দীর্ঘদিন তার নারীর মনের স্মৃতিময় কন্দরে।'
আমি এবার জানতে চাই, 'আডেলিনা, দ্বিতীয় আতরটি সম্পর্কে তুমি তথ্য জোগাড় করতে পেরেছিলে কি?' 'ওহ, হেল ইয়েস, দ্যাটস হোয়াই আই ওয়েন্ট অল দ্য ওয়ে টু টিমবাকটু।' বলে সে জানায়, 'শুধু তথ্যই না, স্যাম্পলও জোগাড় করে নিয়ে এসেছি, শুঁকে দেখতে চাইলে তুমি আমার বাড়িতে একবার আসতে পারো।'
এ প্রস্তাবে আমি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বলি, 'আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড আবাউট দ্য সেকেন্ড পারফিউম...জাস্ট ডেসক্রাইব ইট টু মি প্লিজ।'
আডেলিনা গ্লাসে আরেক দফা শ্যার্ডিনে ঢেলে তা পান করতে করতে বলে, 'সেকেন্ড ওয়ান ইজ টোটালি ইরোটিক, স্থানীয় নাম হচ্ছে আফরাহ, যার মর্মার্থ সেলিব্রেশন বা উৎসব। ব্যাপারটা ঘটে কাফেলা ফিরে এলে পর। গাঁয়ের নারীরা আয়োজন করে উসুলানের। আফরাহ আতরের প্রধান ইনগ্রিডিয়েন্ট হচ্ছে কারা কারোনডি নামের একধরনের ফুলের নির্যাস। তাতে মেশানো হয় সবুজ আম ও লাল মরিচের ঝাঁজ। আতরটি পোড়ামাটির বাটিতে রেখে নিচে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় প্যাপিরাসের শুকনা ঘাস।'
আডেলিনার মধ্যে একধরনের সাতকাহনি প্রবণতা আছে। বিষয়টি আমার তেমন একটা পছন্দ হয় না। তাই এবার আমি জানতে চাই স্পেসিফিকস, তো সরাসরি প্রশ্ন করি, 'আফিফা ও আফরাহ আতর দুটি তুমি কীভাবে সংগ্রহ করলে?'
কী যেন ভেবে সে জবাব দেয়, 'নেইম অব দ্য গাই ইজ আলী ফারকা তৌরে। টিমবাকটু শহরের একটি মসজিদসংলগ্ন চালায় তার আতরের দোকান আছে। একসময় সে উটে চড়ে ফেরি দিয়ে টিমবাকটুতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করত আফিফা ও আফরাহ।'
সে ফের বলে, 'আনসার আল দীনের মুজাহিদরা উসুলান প্রথাকে হারাম ফতোয়া দিয়ে চড়াও হয় তার চালাঘরে। বেশরিয়তি সৌরভ বিক্রির আপরাধে তার পায়ে গুলি করে রক্তক্ষরণরত মানুষটিকে দাওয়ায় ফেলে রেখে তার বাড়িতে গিয়ে ফেরি দেয়ার বাহন উটকে তারা জবেহ করে। অতঃপর ঘরের মেয়েদের বাধ্য করে উটের মাংস শিকে ঝলসিয়ে রান্না করে দিতে। খাওয়াদাওয়ার পর মুজাহিদ কমান্ডার আলী ফারকা তৌরের চৌদ্দ বছরের নাতনিকে অকুস্থলে বিবাহ করে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে নিয়ে চলে যায় মরুভূমিতে। তার সাগরেদরা উটের অবশিষ্ট মাংস পিকাপ-ট্রাকে তুলে ফিরে যায় তাদের গেরিলা হাইড আউটে।'
এবার আমি প্রশ্ন করি, 'আলী ফারকা তৌরে কি বেঁচে আছেন? কার কাছ থেকে তুমি আফিফা ও আফরাহ খরিদ করলে, আডেলিনা?'
সে জবাব দেয়, 'ফরাসি সৈনিকেরা আনসার আল দীনকে মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিয়ে টিমবাকটু শহরে নিয়ে এসেছে একধরনের নর্মালসি। ফারকা তৌরের সাথে আমার দেখা হয় তার দোকানে। চালাঘরের বারান্দায় পাতা একটি খাটিয়ায় মানুষটি শুয়ে ছিলেন। স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার তার পা থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। কিন্তু ঘা শুকায় না। ডাক্তার বারবার ব্যান্ডেজ বদলায়। তাতেও ফল কিছু হয় না। আমার সাথে যখন দেখা হয়, মানুষটির পা ফুলে আছে, রক্ত-পুঁজে ভেজা ব্যান্ডেজের ওপর উড়ছে মাছি। আমি তাকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাই রাজধানী বামাকো শহরে। ফ্রেঞ্চ মিশনারি পরিচালিত একটি হাসপাতালে অস্ত্রপচারে তার পা কেটে বাদ দেওয়া হয়।'
এসমেরেলডা ঝুঁড়ি থেকে কক কক করে উঠলে আমি এবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেই, 'মাই ইনিশিয়েল কোয়েশ্চন ওয়াজ অ্যাবাউট দিস চিকেন? হাউ ডিড ইউ ফাইন্ড হার?' 'ইয়েস, আই অ্যাম গেটিং দেয়ার। আমি বামাকো ছেড়ে আসার সময় আলী ফারকাকে দেখতে যাই মিশনারি হাসপাতালে। ডাক্তার তাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করে জানান যে মানুষটিকে হাসপাতালে থাকতে হবে আরও কিছুদিন। হোটেলে ফিরে আমি সবকিছু গোছগাছ করে প্যাক করছি, পরদিন মালি ছেড়ে ফিরে আসব ইউরোপে। আলী ফারকার নাতি হোটেলে নিয়ে আসে এ মুরগিটি। সাথে কৃতজ্ঞতা হিসেবে তার পরিবার আমাকে পাঠিয়েছে সবুজ রঙের এক টুকরা পালিশ না করা ফ্লুরাইট পাথর। ওয়েল, দিস ইজ মাই স্টোরি অ্যাবাউট দিস চিকেন।'
আমরা বোতলের তলানি নিজিয়ে বাকি শ্যার্ডিনেটুকু পান করে চুপচাপ বসে থাকি। পড়ে আসা দুপুরে বেশ খানিকটা পান করেছি বলে একটু ঝিম ধরে। আডেলিনাকে কেমন জানি স্মৃতিবিধুর দেখায়। আমি জানতে চাই, 'হোয়াট আর ইউ থিংকিং?'
একটু সময় নীরব থেকে সে জবাব দেয়, 'একটি ইমেজ মনে ভেসে যাচ্ছে...আকাশের তীব্র নীল বিস্তার, চারদিকে লিমিটলেস স্পেস, তাতে ভাসছে থোকা থোকা শুভ্র মেঘদল।'
আমি টিমবাকটু শহরের কথা ভাবি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে পড়তে আসা মালির কয়েকজন মানুষের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তারা সকলেই ডিগ্রি শেষ করে ফিরে গেছে মালিতে। চাইলে তাদের সাথে আবার যোগাযোগ করা যায়। টিমবাকটুতে আমার যাওয়ার আগ্রহও প্রবল। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে, মনে হয় না, সহজে আমি সেখানে যেতে পারব।
আডেলিনা উঠে পড়ার উদ্যোগ নিয়ে বলে, 'থ্যাংকস ফর লিসেনিং মাই স্টোরি, এসমেরেলডা ইজ আ ফাইন চিকেন।' আমি তাকে বিদায় জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াই। সে কাছে এসে মৃদুস্বরে বলে, 'প্লিজ টেক আউট ইয়োর সানগ্লাস, উইল ইউ?' তার অনুরোধের কারণ আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু আডেলিনা ঝুঁকে আরও কাছে এসে চোখ থেকে বেগুনি শেডের রোদচশমা খুলে নিয়ে আমাকে চুমো খেয়ে মৃদু হেসে নীরবে চলে যায়।
তাকে বিদায় জানাতে পেছন পেছন লাউঞ্জের দোরগোড়া অব্দি যাই। সে বেরিয়ে গেলে ওখানে বসি। মেঘভাসা নীল আকাশের যে ইমেজের বর্ণনা সে দিয়েছে, তা নিয়ে একটু ভাবি। মরু-শহর টিমবাকটুতে ভ্রমণের সময় কি তার এ লিমিটিলেস স্পেসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল? নাকি তার এ স্মৃতি আরও পুরোনো, এ রকম সীমাহীন আকাশে কোনো একদিন সে কি উড়েছিল গ্রেগরির ছোট্ট হাওয়াই জাহাজে?