প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনীতির নেপথ্য দৃশ্যপট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার অস্থিরমতি স্বভাবের জন্যে পরিচিত ছিলেন। এই বৃষ্টি এই রোদের মতো; কখনো সহযোগী কখনোবা সম্পূর্ণ বিরুপ মনোভাব ছিল তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই তার সঙ্গে প্রথম বৈঠকের আগে কোন ট্রাম্পের দেখা মিলবে, তা নিয়ে সবসময় সন্দিহান ছিলেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দ।
চিরাচরিত প্রথার বিপরীত এই রাষ্ট্রনায়ক কখনো কখনো নিজেকে খোলামেলাভাবেও তুলে ধরেন। বিরল সেসব ঘটনা তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির একটি নতুন প্রামাণ্য সিরিজের পরিচালক টিম স্ট্রিজাকের।
ট্রাম্প সম্পর্কে ইউরোপিয় কমিশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিন ক্লঁদ জাঙ্কার তার সাবেক প্রধান কর্মকর্তাকে বলেন, "রাজনীতি করতে হলে কখনো কখনো বলরুমে চঞ্চল তরুণীদের সঙ্গেও নাচতে হয়। সে (ট্রাম্প) এখন বলরুমে। তাহলে চলো নাচের পর্বটাও সেরে ফেলি।"
ট্রাম্পকে ঘিরে কূটনীতিক দুনিয়ায় প্রচলিত অস্বস্তি যেন তুলে ধরে এই বক্তব্য। বিবিসি সিরিজের মূল লক্ষ্য, ট্রাম্পের কূটনীতির গোপন ও নেপথ্য চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরা। গুরুত্বপূর্ণ সেসব বৈঠকে উপস্থিত কূটনীতিকদের ভাষ্যেই তা বর্ণিত হয়।
এজন্য ট্রাম্পের শীর্ষ উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিদেশি কিছু রাষ্ট্রপ্রধান ও কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেয় বিবিসি। এদের অনেকের সঙ্গেই বিরোধে জড়িয়েছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি। ট্রাম্পের নজিরবিহীন আচরণে তাদের বিস্মিত, বিমূঢ় হওয়ার ঘটনাও সেখানে উঠে আসে।
সিরিজ প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে ট্রাম্প কীভাবে তীব্র বিরোধের সূত্রপাত ঘটান- তা তুলে ধরা হয়।

'তিনি হাত ছাড়িয়ে নিতে পারছিলেন না'
আটলান্টিকের ওপাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্র যুক্তরাজ্য। প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে।
কিন্তু, প্রথম সাক্ষাতেই ট্রাম্পের আচরণে বিব্রত হন থেরেসা। তার জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ-ফিওনা ম্যাকলিউড হিল- এর বর্ণনা করেন যে, ট্রাম্প যেভাবে মে'র হাত ধরে হোয়াইট হাউজে পাশাপাশি হাঁটেন তাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেমন অস্বস্তি বোধ করেছিলেন: তিনি ট্রাম্পের মুঠো থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও তাতে ব্যর্থ হন। তাই একহাত বন্দি অবস্থাতেই তিনি পাশাপাশি হাঁটতে বাধ্য হন।
ক্ষুদ্ধ থেরেসা তার সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তাকে বলেন, "আরেকজন পুরুষের হাত ধরে হেঁটেছি- এনিয়ে গণমাধ্যমে হইচই শুরু হওয়ার আগেই আমার উচিৎ ফিলিপকে (থেরেসার স্বামী) এই মুহুর্তে তা ফোন করে জানিয়ে রাখা।"
কিন্তু, মে বাড়িতে ফোন করার আগেই সফরকারী ব্রিটিশ দলের জন্য অপেক্ষা করছিল আরেকদফা চমক। থেরেসার সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজের আসরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনকলের সংযোগ করে না দেওয়ায় নিজ কর্মকর্তাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন ট্রাম্প।
তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থমাস শ্যানন জানান: "প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প) প্রধানমন্ত্রী মে'র দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। পুরো দুনিয়ায় একমাত্র ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধবংস করার ক্ষমতা রাখেন, অথচ আমি তার ফোনকল ধরতে পারলাম না!"

ট্রাম্পের অধীনে এসসিআইএফ বৈঠকে অংশগ্রহণ:
কূটনীতির চিরায়ত প্রথা পায়ে মাড়ানো ট্রাম্পের আচরণ প্রত্যক্ষ করেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলও।
এক জি-৭ সম্মেলনের পার্শ্ব:আলোচনায় ট্রাম্প ট্রার্নবুল এবং তখন সদ্য দায়িত্ব নেওয়া ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ'কে তার এসসিআইএফ বৈঠকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
এই এসসিআইএফ হলো; সেন্সিটিভ কম্পার্টমেন্টেড ইনফরমেশন ফ্যাসিলিটি'র সংক্ষিপ্ত রূপ। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত অতীব সংবেদনশীল তথ্য এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়। সেই বৈঠকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও দু'জন বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের উপস্থিতি ব্যতিক্রম ছিল নিঃসন্দেহে।
কিন্তু, ঘটনা সেখানে শুরুমাত্র। বৈঠকে তিনি নিরাপত্তা সহযোগিতা বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে করা শরনার্থীদের আবাসন সংক্রান্ত এক চুক্তি নিয়ে অভিযোগ করতে থাকেন। উল্লেখ্য, ওই চুক্তির আওতায় অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়প্রার্থীদের একটি অংশকে গ্রহণ করতো যুক্তরাষ্ট্র।
ওই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে টার্নবুল বিবিসি'কে বলেন: "ডোনাল্ড বলছিল, 'মাখোঁ তুমি কি জান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ২,০০০ সন্ত্রাসীকে (শরনার্থী) একটি মরুদ্বীপে আটকে রেখেছে ম্যালকম। এর চাইতেও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, এখন আমাকে সেসব অপরাধীকে আশ্রয় দিতে হবে।' এরপর মাখোঁ'র দিকে ফিরে সে সরাসরি বলে, 'ইমানুয়েল সত্যি করে বল- তুমি কি এসব সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেবে?' মাখোঁ তখন জানতেন না, ডোনাল্ড কোন প্রসঙ্গে এমন কথা বলছেন, তাই সে হতবাক হয়ে যায়।"

'ফক্সনিউজ'কে সাক্ষাৎকার দিলেই কেল্লাফতে'
সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট ট্রাম্পের ইতিবাচক মনোভাব পাওয়ার এক উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন।
ট্রাম্প যখন যুক্তরাজ্য সফরে আসেন তার মাত্র কিছুদিন আগেই দায়িত্ব নেন হান্ট। তিনি বিবিসি'কে বলেন: "ওই সময় আমি ট্রাম্পের প্রিয় গণমাধ্যম ফক্স নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দেই। এবং সেখানে তার আহবানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইউরোপিয় দেশগুলোর সামরিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পক্ষে মত দেই। তারপর তিনি (ট্রাম্প) সোজা আমার কাছে এসে, আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, 'ফক্সকে তো চমৎকার সাক্ষাৎকার দিয়েছ। আমি আমার আশেপাশের লোকদের বলেছি, এই লোকটি কে তা আমি জানি না, তবে সে অসাধারণ কাজ করেছে।' কূটনৈতিক হিসেবে এটাই ছিল ট্রাম্প সম্পর্কে আমার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা: সেটা হলো তাকে নিজের পক্ষে আনতে হলে; ফক্স নিউজকে সাক্ষাৎকার দিলেই চলবে।"

ব্রিটেন কি পরমাণু শক্তিধর!
যুক্তরাজ্য সফরের সময় হান্ট চেয়েছিলেন পুতিনের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে ট্রাম্প যেন কঠোর অবস্থান নেন। তার এমন উদ্দেশ্যের পেছনে ছিল কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্যের সেলিসবেরিতে এক রাসায়নিক হামলা। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এজন্য রুশ গুপ্তচর সংস্থার প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তোলে।
ট্রাম্পের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিবিসি'কে বলেন: "আমার ব্রিটিশ প্রতিপক্ষ এর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এটি একটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মাটিতে চালানো হামলা।' একথা শুনে ট্রাম্প বিস্মিত হয়ে মে'র দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেন, 'সত্যিই কি ব্রিটেনের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে?' এই প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা তাদের ঠোঁট বন্ধ রাখলেন, কিন্তু ততক্ষণে তাদের সবার চোখ কপালে উঠে গেছে।"
এরপর হেলসিঙ্কিতে বৈঠকের সময় শুধু মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ তাচ্ছিল্য করেই পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালের ওই নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপেই ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
হোয়াইট হাউজের শীর্ষ রাশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা ফিওনা হিল (মে'র চিফ অব স্টাফ নন) এব্যাপারে ট্রাম্পের বিস্ময়কর সংবাদ সম্মেলন স্মরণ করে জানান, ট্রাম্প মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর চেয়ে পুতিনের কথাতে বেশি আস্থা রাখার ব্যাপারটি সেখানে আবারও তুলে ধরছিলেন।
"বিব্রতকর অবস্থায় তখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা, কীভাবে এই সম্মেলন দ্রুত শেষ করব? সত্যি বলতে কী কোনো প্রকার অসুস্থতার ভান করে তা থামিয়ে দেওয়ার চিন্তা তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একবার মনেও হলো; রক্তহিম করা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ি।"
- সূত্র: বিবিসি