অন্য দেশের 'লকডাউনে' ফুলে-ফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের প্রপার্টি মার্কেট
ছয় বছরের একটানা অস্থিরতা কাটিয়ে দুবাইয়ের প্রপার্টি মার্কেট বা সম্পত্তির বাজার আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। কারণ, অন্যান্য দেশ থেকে লকডাউনকে পাত্তা না দেয়া লোকজন এসে ভিড় করছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে জনবহুল শহরটিতে। বিশেষ করে ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা মহামারিতে ধুঁকতে বসা দুবাইয়ের পর্যটন শিল্প ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নতুন করে জ্বালানীর খোরাক যোগাচ্ছেন।
এ মুহূর্তে সম্পদের বাজারে সবচেয়ে বড় অংশ দখল করে আছে দুবাইয়ের বিলাসবহুল ভিলা। কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ পাম জুমেইরাহ বা গলফ কোর্স সংলগ্ন ভিলাগুলোর প্রচুর চাহিদা রয়েছে ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের কনসালট্যান্সি প্রপার্টি মনিটর নামক প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার ঝান জোচিনক বলেন, দুবাইয়ের সম্পত্তির বাজার রোলার কোস্টারের মত, কখনো উঠে আবার কখনো সজোরে নিম্নগামী। ২০১৮ সালে এ বাজারের দর শুধুই নামছিল, কিন্তু গত বছর কোভিডের পর এটি সমান্তরাল বা ফ্ল্যাটলাইনে অবস্থান নেয়।
"কিন্তু লকডাউনের পরপরই এই সোজা রেখা মোড় ঘুরিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল, কারণ বাড়ছিল সম্পদের লেনদেন। আর এ দশা এখনো থামে নি"।
"আমরা এখন মাসে রেকর্ড পরিমাণ লেনদেন এবং প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি"।
গত বছর মহামারির ভেতরেও যে কয়টি দেশ বিদেশি নাগরিকদের জন্য দ্রুত সীমান্ত ও প্রবেশাধিকার চালু করে দেয়, আমিরাত তার অন্যতম। তাদের এ উন্মুক্ত-দুয়ার নীতিতে অবশ্য মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অন্তর্ভুক্ত।
এ বছরের শুরুতে বিশ্বজুড়ে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই কিছু বিধিনিষেধ সহকারে দুবাইতে রেস্তরাঁ, হোটেল প্রভৃতি খুলে দেয়া হয়। টিকাদানের ক্ষেত্রেও দুবাই অন্যান্য অনেক দেশের চাইতে এগিয়ে।
জোচিনক বলেন, "অন্য দেশের লকডাউন এড়িয়ে আসা লোকজন? আমার মনে হয় আমাদের এখানে তাদের অনেকেই আছেন"। তাছাড়া এখানকার শিথিল আবাসিক নিয়মনীতি এবং সম্পূর্ণ বিদেশী মালিকানায় ফার্মের অধিগ্রহণ লাভ করতে পারাটাও দুবাইতে ভিড় করার পিছনে অন্যতম কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বলাই বাহুল্য, বিদেশ থেকে আগতদের এ বন্যা দুবাইয়ের পর্যটন শিল্পকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে; গত এপ্রিলে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তাকে অনেকটা কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের সাথে তুলনা করা যায়।
গবেষণা সংস্থাটির অর্থনীতিবিদ ডেভিড ওয়েন বলেন, বছরের পরবর্তী ভাগে ক্রমবর্ধমান এ পর্যটকদের আগমনে ভ্রমণ ও পর্যটন সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য লাভের মুখ দেখবে।
প্রপার্টি মনিটরের ডেটা অনুযায়ী, এপ্রিলে ৯০টি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে বাৎসরিক ভিত্তিতেই ৩০০-৪০০টি লেনদেন হয়ে থাকে। ১০ মিলিয়ন দিরহামের (২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার প্রায়) ওপর এসব লেনদেন ঘিরে অনেক বছর পর আবারও আমিরাতি ভিলার মালিকেরা লাভের মুখ দেখছেন।
পাম বীচের একটি প্রাসাদোপম বাড়ি বিক্রি হয়েছে ১১১.২৫ মিলিয়ন দিরহামে।
মহামারির নিষ্প্রাণ সময়েও যেহেতু এই বিলাসবহুল সম্পত্তি ঠিকই বাজার দখল করে নিতে পেরেছে, ফলে ডেভেলপাররা এখন আশায় বুক বাঁধছেন। গভীর সুইমিংপুল, প্রাইভেট সিনেমা এবং একরের পর একর মার্বেল পাথর আর কাঁচে আঁকা মেঝের টানে অনেক ইউরোপীয়ই যে দুবাইমুখী হবেন, সে সম্ভাবনা দেখছেন তারা।
"১০ বছর আগে আমরাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রেনের মালিক ছিলাম। কিন্তু এখন দিন বদলেছে, আমার মনে হয়, দুবাই এখন মানুষের কাছে কেবলই একটি কন্সট্রাকশন সাইট হয়ে নেই", বলেন সম্পত্তির প্রতিনিধিত্বকারী এজেন্সি ব্ল্যাকব্রিকের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ বেট।
তিনি বলেন, "মানুষ এখন দুবাইকে দেখিয়ে বলে- এখানে আমি আমার মূল ঘর বানাবো। আমি দুবাই থেকে কাজ করতে পারব এবং এখানে থেকেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা কিংবা এশিয়াতে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব"।
"সুতরাং আমি দেখতে পাচ্ছি কোভিড-১৯ আমাদের জন্য কী করেছে, পুরো পৃথিবীর জন্য এটি আমাদের দুয়ার খুলে দিয়েছে"।
তবে কিছুক্ষেত্রে ভাগ্যেরও বুঝি ছোঁয়া লাগে! এটি এমন এক বাজার যেখানে ইতিমধ্যে বহু ভাগ্যবান এসেছে, আবার হারিয়েও গেছে। ফলে এই সহসা উত্থান দেখে আশঙ্কা হয়, এ পরিস্থিতির স্থায়িত্ব নিয়ে, টিকে থাকা নিয়ে।
প্রপার্টি মনিটর জানায়, আগের মাসের তুলনায় এপ্রিলে ১০ মিলিয়ন দিরহামের ঊর্ধ্বে সম্পত্তির বিক্রি বেড়েছে ৬.৭ শতাংশ। পাম বীচে যেখানে ২০২০ সালে মোট ৫৪টি ভিলা বিক্রি হয়, এক এপ্রিলেই এবার সেখানে বিকেছে ৮১টি ভিলা।
তবে এখনো পিছিয়ে আছে এপার্টমেন্ট বাণিজ্য।
আর্থিক পরিষেবা সংস্থা মরগান স্ট্যানলি অবশ্য সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই জোয়ার শীঘ্রই থামার সম্ভাবনা নেই।
বরং চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয় এই বাজারকে ধারণার চাইতেও শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে বলে তাদের ধারণা।
কোভিড-১৯ এর কারণে গত ১২ মাসে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপ, আকর্ষণীয় বন্ধকী হার এবং চাহিদার ধরনে পরিবর্তন আমিরাতের এই নয়া উত্থানে অবদান রেখেছে বলে মন্তব্য মরগান স্ট্যানলির।
- সূত্র- আরব নিউজ