ব্যয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণের জন্য ফের বাড়বে সয়াবিনের দাম!

ফুটপাতে বিক্রি হওয়া সাধারণ বিস্কুট ও ব্রেড থেকে শুরু করে ধনীর ঘরের এয়ারকন্ডিশনার, সবকিছুর আকাশছোঁয়া দামের কারণে মানুষের সংসার চালানো যখন অসম্ভব হয়ে উঠছে, তখন আবারও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মিলগুলো।
গত বুধবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ২৪ টাকা বাড়িয়ে ২২২ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে রিফাইনারদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। আগামী সোমবার সভা করে নতুন দাম নির্ধারণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
গত মে মাসে ভোজ্যতেল আমদানি মূল্য পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সয়াবিনের দাম লিটারে প্রায় ৫-৬ টাকা বাড়তে পারে। তবে পাম অয়েলের দাম ৮-১০ টাকা কমতে পারে। আগামী জুলাই মাস থেকে দেশে পাম অয়েলের পাশাপাশি সয়াবিনের দামও কমবে বলে জানান তারা।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করে, যা এখনও দিন দিন বাড়ছে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে দরিদ্রদের জন্য বিক্রি হওয়া সাধারণ পাউরুটির দাম ৫০% বেড়ে গেছে, বাড়ছে ব্র্যান্ডেড রুটির দামও।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণে আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়লেও তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও। ধানের ভরা মওসুমে সব ধরণের চালের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশে উৎপাদিত তরল দুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মিল্কভিটা।
খাদ্যপণ্যের বাইরে প্রতিদিন ব্যবহৃত সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট পাউডার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে এই সময়ে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে ভোগ্যপণ্যের প্রতিদিনকার খুচরা মূল্য সংগ্রহ করে সরকারের সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। বৃহস্পতিবার সংস্থাটি ৬২টি পণ্যের খুচরা দাম প্রকাশ করে বলেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে এর মধ্যে ৫৮টির দামই বেড়েছে।
টিসিবির হিসাবে, এক মাসে সামান্য দাম কমেছে শুধু ধনে, তেজপাতা, দারুচিনি ও ছোলার দাম- যার কোনটিই নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। অবশ্য, গতকাল এলপিজির দাম কমানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
সরকারি হিসাবে যদিও এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.২২%, তবে তা বিশ্বাস করেন না দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম ও এসডিজি অর্জনে নাগরিক প্লাটফর্ম এর হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২% এর কম নয়।
ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় রিক্সাভাড়া, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা এমনকি রাইড শেয়ারিং করা মোটরসাইকেল চালকরাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, এখান থেকে অতিরিক্ত আয় না করতে পারলে সংসার চালানোর মতো বাড়তি মূল্যে ভোগ্যপণ্য কিনতে পারবেন না তারা।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ৫-৬ দিনের মধ্যে আমরা ভোজ্যতেলের মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসব। আমাদের কাছে খবর আছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমতির দিকে। পাম অয়েলের দাম ইতোমধ্যে কমেছে। সয়াবিন তেলের দাম কমতির দিকে।
এবারের মূল্য নির্ধারণ গত মাসের দামের ওপর ভিত্তি করে হবে জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, আজকেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমেছে। তবে এর প্রভাব পড়বে এক মাস পর। এখন আমরা যে দামটা নির্ধারণ করব সেটা মে মাসের ল্যান্ডিং কস্টের উপর ভিত্তি করে হবে।
এর আগে গত ৫ মে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৯৮ টাকা, খোলা সয়াবিনের দাম ১৮০ টাকা ও পামঅয়েলের দাম ১৭২ টাকা করা হয়।
বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই সময় আমদানি পর্যায়ে ৫% ভ্যাট বহাল রেখে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে, যার মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হবে।
ভোক্তা স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এ সুবিধা আগামী অর্থবছরও অব্যাহত রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের ডেপুটি চিফ মাহমুদুল হাসান।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে মার্চ থেকেই ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি আইটেমের সাইজ ছোট করে কোম্পানিগুলো। ১৩ মে ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর কোম্পানিগুলো আটা, ময়দা, সুজিসহ এসব পণ্যে উৎপাদিত সব ধরণের পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে।
১ জুন থেকে সব ধরণের বেকারি পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি।
এই ঘোষণা অনুযায়ী, ৬০ গ্রাম আকারের বান, বাটার বান, মধু বান, ড্যানিশ ও পেটিসের খুচরা দাম ১৫ টাকা করা হয়েছে। যেগুলোর দাম ছিল ১০ টাকা। ৭০ গ্রাম ওজনের পাউরুটির দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা করা হয়েছে। অবশ্য ২৫০ গ্রাম ওজনের ব্র্যান্ডেড পাউরুটির দাম ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা করা হয়েছে আরও মাসখানেক আগেই।
সকালে রুটি-পাউরুটির দাম বৃদ্ধির খবরের রেশ শেষ না হতেই বিকেলে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা প্রতি লিটার দুধের দাম ৫ টাকা বাড়িয়েছে। সব ধরনের দুগ্ধজাত পণ্যের দামও বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বেসরকারি দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আড়ং সপ্তাহ দুয়েক আগেই প্রতি লিটার দুধের দাম ১০ টাকা বাড়িয়েছে।
যুদ্ধের কারণে যখন আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছিল, তখন দেশে উৎপাদিত মুরগির ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দামও বাড়তে থাকে। এক মাসের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে প্রতি হালি ডিম এখন ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের দাম ঈদ-উল-ফিতরের আগে ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে, যা ঈদের পর ৭০০ টাকার নিচে নামেনি।
সবচেয়ে ভালো মানের চিকন চাল কিনতে ভোক্তাকে এখন ৬৮-৭৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে, যা মার্চ মাসেও ছিল ৬২-৭০ টাকার মধ্যে। আর মোটা চাল ভরা মৌসুমে ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতি কেজি খোলা আটা ছিল ৩৪-৩৬ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়। অবশ্য প্যাকেটের এক কেজি আটা কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা দিয়ে।
'গরিবের আমিষ' মসুর ডাল ও আলুর দামও বেড়েছে। ফলে অল্প আয়ের মানুষ আগের চেয়ে বাড়তি খরচ না করে আলু ভর্তা-মসুর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার সুযোগ পাবে না।
প্রতিকেজি মসুর ডালের দাম ১৫-২০ টাকা বেড়ে ১৩০-১৪০ টাকায় উঠেছে আর আলুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এবছর ভারতের পাশাপাশি দেশেও পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার কারণে ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। দেশের কৃষকরা যাতে উপযুক্ত মূল্য পায়, সেজন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছে সরকার। এতে ২৫ টাকা কেজির পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকায় উঠেছে।
বেসরকারি চাকরিজীবি রাহেনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'তেল, চাল, ডাল, ডিম, আটা, ময়দা, সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে সব জিনিসেরই দাম বেড়েছে। পাঁচজনের পরিবারে খাদ্যপণ্য ও মুদি দোকানের কেনাকাটার পেছনে সাড়ে আট থেকে নয় হাজার টাকা খরচ হতো। মে মাসে শুধু খাওয়ার পেছনে খরচ হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু এই যে বাড়তি ব্যয় প্রতি মাসে করতে হবে, এই ব্যয় মেটানোর মত বাড়তি আয়ের সুযোগ তো আমার তৈরি হয়নি।'
বাড্ডার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'ছোটবাচ্চা সহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। বেবি মিল্ক কিনতেই এখন মাসে প্রায় ৭০০-৮০০ টাকা খরচ বেড়েছে। আর মুদি দোকানে আগে মাসে ৬ হাজার টাকার বেশি খরচ হতো, গতমাসে ৮ হাজার টাকার বেশি লেগেছে। সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।'
রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এয়ার কন্ডিশনারের দাম গত ছয় মাসে কয়েক ধাপে ১০-১২% বেড়েছে।
কোম্পানিগুলো দাম না বাড়াতে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু উৎসে কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান দাম, সি ফ্রেইট চার্জের বৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের বিকল্প নেই। কমার্শিয়াল যানবাহন, গাড়ি এবং দুই চাকার আমদানিকারকরাও একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।
রাজধানীর শ্যাওড়াপাড়ার সিঙ্গার-এর সেলস সেন্টারের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এ কে এম ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এসি সহ বড় এবং ভারী পণ্যগুলোর জন্য কোম্পানিকে অতিরিক্ত ফ্রেইট চার্জ দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে ডলারের উচ্চমূল্যের জন্য আমদানি পর্যায়ে ছোট প্রিমিয়াম পণ্য যেমন কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সের দাম বাড়াতে হয়েছে।
ওয়ালটনের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রবিউল ইসলাম মিল্টন বলেন, গত ছয় মাসে ওয়ালটন টিভির দাম বাড়িয়েছে।
"সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আমরা কম বাজেটের পণ্যের দাম না বাড়াতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচের মধ্যে আমাদের প্রিমিয়াম ক্যাটাগরির পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে।"
ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর এবং এসির দাম ১০-১২% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে যোগ করেন তিনি।
এদিকে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মন্তব্য করেন, বেসরকারি চাকরিজীবীরা বাড়তে থাকা ব্যয়ের বোঝায় তীব্র সংকটের মুখে পড়েছেন। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের সাথে সমন্বয় রেখে তাদের আয় যে বাড়েনি!