গাজার জন্য সহায়তা তোলার সুবাদে মোজোর বিক্রি বেড়েছে
সোমবার (১১ মার্চ) ঠিক সন্ধ্যা ৫টা ৩২ মিনিটে প্রতি বোতল কোমল পানীয় বিক্রি থেকে এক টাকা করে ৬৮ হাজার ২০৮ টাকা জমা পড়েছে মোজোর একটি উদ্যোগের তহবিলে। আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের ওয়েবসাইট www.wesupportpalestine.net-এর তথ্যানুযায়ী, মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে সন্ধ্যা ৬টা ২৪ মিনিট নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ হাজার ২৪ টাকায়।
অর্থের এই বড় লেনদেন সত্যিই লক্ষণীয়, কারণ মাত্র ৫২ মিনিটেই ১৮ হাজার ৮১৬ বোতল বা ইউনিট মোজোর কোমল পানীয় বিক্রি হয়েছে।
মোজোর কোমল পানীয় নিয়ে ভোক্তাকূলের আগ্রহ এর একমাত্র কারণ নয়, বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের ভোক্তাদের আবেগকে কাজে লাগাতে ব্র্যান্ডটির কৌশলী উদ্যোগই এর মূলে রয়েছে।
দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড হলো মোজো। প্রতি বোতল সফট ড্রিংকস বিক্রি থেকে এক টাকা করে ফিলিস্তিনিদের জন্য গঠিত তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ফিলিস্তিনের প্রতি গভীর সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ভোক্তাদের মধ্যে দারুণ সারা ফেলেছে মোজোর এ উদ্যোগ।
আকিজ ফুডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, "এই ক্যাম্পেইন শুরুর পর থেকেই আমরা ভোক্তাদের অকল্পনীয় সাড়া পেয়ে অভিভূত। ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়ে আমাদের বেচাবিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে।"
তিনি জানান, মধ্যপ্রাচ্যে এই সংঘাত শুরুর পর থেকে মোজোর বিক্রি ১৩০ থেকে ১৪০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে দেশে কোলা ধরনের কোমল পানীয়র মধ্যে মোজোর বাজার অংশীদারত্ব ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের আগের সময়ের চেয়ে যা উল্লেখযোগ্য হারে বা অন্তত ৬ শতাংশীয় পয়েন্টে বেড়েছে।
এই উদ্যোগে কত টাকা সংগ্রহ হয়েছে
২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য তারা দেড় কোটি টাকা দিয়েছেন বলে জানান মাইদুল ইসলাম। এরমধ্যে এক কোটি টাকা দেওয়া হয় কোম্পানির তহবিল থেকে, আর ৫০ লাখ টাকা আসে মোজোর বিক্রয় থেকে।
তিনি বলেন, "৮ মার্চ পর্যন্ত মোজোর বিক্রি থেকে পাওয়া আরো ৫৬ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য এই অর্থ এখন ট্রান্সফারের অপেক্ষায় রয়েছে।"
এর আগে গত ২ জানুয়ারি আকিজ ভেঞ্চারের চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতের কাছে "মোজো সাপোর্ট প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেইন" এর তহবিলে জমা হওয়া ৫০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন।
আকিজ ফুডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাইদুল বলেন, "ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ সহায়তা বিতরণে দক্ষ কাতার ও তুরস্কের নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার মাধ্যমে আমরা এসব তহবিল পাঠাচ্ছি।"
বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকটের মধ্যে এসব তহবিল কীভাবে পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ডলারের বিকল্প হিসেবে কাতার বা তুরস্কের মুদ্রায় কনভার্ট করে পাঠানোর চেষ্টা করেছি।
স্থানীয় কোলার দিকে ভোক্তার আবেগ
বহু বছর ধরেই বাংলাদেশিরা কার্বনেটেড পানীয়ের জন্য পেপসি নয়তো কোকাকোলার দিকে হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু, গাজায় ইসরায়েলি অভিযান শুরুর পর থেকেই অনেক বাংলাদেশি ভোক্তা সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয় এমন সব পশ্চিমা কোম্পানির পণ্য বর্জনের কথা বলেছেন।
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের মুদি দোকান মালিক কবির হোসেন (৪০) জানান, কোকাকোলা ও পেপসিকোর তৈরি বেভারেজ পাইকারী বিক্রেতারা তাঁর কাছে ছাড়কৃত (ডিসকাউন্ট) মূল্যে বিক্রির প্রস্তাব দিলেও, তিনি তা গ্রহণ করেননি। শীতকালে যখন কোমল পানীয়ের বেচাবিক্রি কম থাকে, তখন সাধারণত এই ধরনের অফার দেয় কোম্পানিগুলো। এসব অফারে কোল্ড ড্রিংকসের প্রতিটি কেস কিনলেই পাঁচ থেকে সাতটি বোতল বেশি পান খুচরা বিক্রেতা দোকানি। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ের ভূ-রাজনৈতিক সংকট এসব অফারের তাৎপর্য বাড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনের সাথে সহমর্মিতা জানিয়ে বয়কট আন্দোলনে শামিল হওয়াদের মধ্যে একজন কবির হোসেন।
তিনি বলেন, "মানুষজন এখন কোক বা পেপসির বদলে মোজো, ডেইলি কোলা ও ইউরো কোলা কিনছে… ইসরায়েল তাঁর চলমান গণহত্যা না থামানো পর্যন্ত আমি ইসরায়েলকে সমর্থন করে এমন পণ্য স্টকে রাখব না।"
ফিলিস্তিনিদের ওপরে ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁও পেপসিকো এবং কোকাকোলার তৈরি পানীয় পরিবেশন না করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন মসজিদেও ব্যানার টানিয়ে মানুষজনকে কোক ও পেপসির মতো পশ্চিমা পণ্য বর্জন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
"একটি বিশেষ ঘোষণা… আমেরিকান বার্গার ধানমন্ডি নিজেদের মেন্যু থেকে কোকাকোলা ও পেপসি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে" বলা হয়েছে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁর সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে। প্রতিষ্ঠানের নামেই এখানে আমেরিকান ব্রান্ডিংটা লক্ষ করবার মতোই বিষয়।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক ওমর ফারুক বলেন, "এই সিদ্ধান্তে আমাদের কাস্টমাররা খুশি। এখন আমরা দেশে তৈরি ডেইলি কোলা সার্ভ করি। স্থানীয় কোলার বিষয়েও মানুষ এখন দারুণ ইতিবাচক ফিডব্যাক দিচ্ছে। আমি সবাইকেই বলব, একবার স্থানীয় এই পণ্যটি ট্রাই করার জন্য।"
রাজধানীর বনশ্রীর একটি রেস্তোরাঁর ঘোষণায় বলা হয়, "আপনি কি ফিলিস্তিনে গণহত্যায় সহযোগিতা করছেন? আসুন পেপসি ও কোকাকোলা বর্জন করে, মোজো পান করি। আসুন মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অর্থ না জোগাই।"
ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের মধ্যে এসব ঘোষণা ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন এবং অভিনব বিপণন কৌশলকেও তুলে ধরছে।
এই প্রেক্ষাপটেই, স্থানীয় কোমল পানীয় ভোক্তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে ব্যবসাগুলোকে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে।
চলমান বয়কট আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করছেন ম্যাক্স কোলার উৎপাদক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, "একটার পর একটা ইস্যু আসতেই থাকে, কিছুদিন পর মানুষ কোনোটা নিয়েই আর পড়ে থাকে না। স্বল্পস্থায়ী এসব আবেগের ওপর গুরুত্ব না দেওয়াটাই উচিত। বরং আমরা পণ্যের মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভোক্তাদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্য নিয়েছি।"
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের অবস্থানের কথা জানিয়ে কামাল বলেন, "আমাদের বিশ্বাস, ব্র্যান্ড কোনো ধর্ম বা বর্ণের হওয়া উচিত নয়। পণ্য হচ্ছে সকলের জন্য। তা সেটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, রাশিয়া-ইউক্রেন বা অন্য যেকোনো সংঘাতই হোক না কেন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সবসময়েই শান্তির পক্ষে। আমরা যুদ্ধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে।"
দেশের কার্বনেটেড পানীয়ের বাজারে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রাণ-আরএফএল শুধু কোলা উৎপাদন করে না, আমরা একটা লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড, তাই বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করি। কোলা আমাদের ব্যবসায়িক পোর্টফোলিওর একটি অংশ মাত্র। তবে সৃজনশীল উপায়ে ম্যাক্স কোলার বিপণন ও দেশব্যাপী বিক্রি বাড়াতে আমাদের টিম নিরলস কাজ করে চলেছে।"
"দিনশেষে কোক ও পেপসি আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কলিগ। এখন তাঁরা সমস্যায় আছে, হয়তো একইভাবে আমাদেরকেও আগামীতে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে"- যোগ করেন কামাল।
বাংলাদেশে নন-অ্যালকোহল পানীয়ের বাজার
তুরস্কের কোকাকোলা আইসেক (সিসিআই) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে অ্যালকোহল-মুক্ত রেডি টু ড্রিংকের বাজার ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ১০ শতাংশ।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩ কোটি ডলারে কোকাকোলা বাংলাদেশ বেভারেজেস লিমিটেড কেনার ঘোষণা দেয় সিসিআই। ২০২৩ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে এদেশে কোমল পানীয়ের বাজার বছরে ১২ শতাংশ হারে বিকশিত হবে বলে প্রাক্কলন করেছে।
২০৩২ সাল নাগাদ নন-অ্যালকোহল রেডি টু ড্রিংকের বার্ষিক চাহিদা ৭২ কোটি ইউনিটে পৌঁছাতে পারে, ২০২২ সালের ৪১ কোটি ইউনিট বা বোতলের চেয়ে যা হবে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
কোমল পানীয় বিপণনকারীদের করা বাজার গবেষণা বলছে, ইসরায়েল- হামাস যুদ্ধের আগে দেশের কোলা বাজারে অগ্রণী অবস্থান ছিল কোকাকোলার, প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অনুমিত এই বাজারের ৪২ শতাংশই ছিল তাদের দখলে। তবে বাজার অংশীদারিত্বে পেছনে রয়েছে তাদের বর্ণহীন পানীয় স্প্রাইট, যার বাজারদখল প্রায় ২২ থেকে ২৩ শতাংশ। ২,৭০০ থেকে ২,৮০০ কোটি টাকার এই সেগমেন্টে ৪০ শতাংশ বাজার অংশীদারিত্ব নিয়ে আধিপত্য করছে পেপসিকো'র সেভেন আপ।
একইভাবে প্রতিযোগী মিরান্ডার চেয়ে বড় ব্যবধানে পিছিয়ে রয়েছে কোকাকোলার অরেঞ্জ ফ্লেভারের পানীয় ফান্টা। প্রাক্কলনমতে অপেক্ষাকৃত ছোট এই সেগমেন্টের বাজার বছরে ৩৫০ কোটি টাকার।
তবে বাংলাদেশে কোকাকোলার প্রতিযোগিতা করার জোরালো সক্ষমতা তুলে ধরে সিসিআই জানায়, ২০২৩ সালে এদেশে বিক্রি হওয়া সব রকমের কার্বনেটেড পানীয়ের বাজারমূল্যের ৪৫ শতাংশের বেশি ছিল কোকাকোলার।
দেশের বিভিন্ন বড় গ্রুপ– আকিজ, পারটেক্স, প্রাণ এবং মেঘনাসহ কার্বনেটেড কোমল পানীয়ের বাজারের স্থানীয় প্রতিযোগীরাও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বাজারের আনুমানিক বার্ষিক মূল্যে তারা ৫ হাজার কোটি টাকা অবদান রেখেছে।