যেভাবে ব্যাংকগুলোর সহজ রেমিট্যান্সের স্বপ্ন বিদেশে লোকসানের দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো
১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে লন্ডনের সোনালী ব্যাংক। কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ২১ বছরের মাথায় এসে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সোনালী ট্রেড অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি।
লন্ডনের অফিসটি মূলত প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সেবা দিয়ে আসছিলো।
পরে ২০০১ সালের সেটি ব্যাংকে রূপান্তর হয়। তখন প্রবাসী আয় সংগ্রহের পাশাপাশি ঋণপত্রের (এলসি) নিশ্চয়তা দেওয়া শুরু করে, আর প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড। ব্যাংকটি যখন আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে তখনই ঘটে বড় দুর্ঘটনা।
ব্যাংকটির মালিকানার ৫১ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের, বাকি ৪৯ শতাংশ সোনালী ব্যাংকের। প্রতিষ্ঠানটিকে চালাতে সরকার ও সোনালী ব্যাংক মিলে দফায় দফায় মূলধন জোগান দেয়। আবার ব্যবসা করতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও অর্থ দেওয়া হয়েছে।
কয়েক দফায় মূলধন জোগান দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন দাঁড়ায় ৬ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৮৭ কোটি টাকা। এর বাইরে সোনালী ব্যাংক ইউকেতে ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার দিয়েছে সোনালী ব্যাংক, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ব্যাংকটি ঋণপত্রের নিশ্চয়তা, অগ্রিম মূল্য পরিশোধ ও বিল ডিসকাউন্টিং ব্যবসা করছিল।
কিন্তু, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে অর্থ পাচার প্রতিরোধব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে ৩২ লাখ পাউন্ড জরিমানা করে সেই দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)। বন্ধ করে দেয় নতুন হিসাব খোলার সেবা।
২০২২ সালে শাখাটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের মতোই গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি ব্যাংকের অন্তত আটটি বিদেশি আউটলেট বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে বিদেশে অফিস খোলার ক্ষেত্রে দুর্বল সম্ভাব্যতা, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও বারবার লোকসানকেই দায়ী করা হয়েছে।
বন্ধের তালিকায় নাম রয়েছে জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক ও মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের। গত কয়েক বছরে একাধিক দেশে ব্যাংকগুলো তাদের বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিদেশে বাংলাদেশি মানি এক্সচেঞ্জ চালু করতে কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাছাড়া লোকসানে থাকা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ব্যবসা বন্ধ করতে চাইলে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ায়ও অনেক খরচ হয়।
এই হিসাবের কথা উল্লেখ করে ব্যাংকাররা বলেছেন, আটটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে।
ডলারের সংকট, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্কমে আসার এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি রেমিটার্সের বিনিময় হার বাড়ানোর পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ অর্থের প্রবাহ বাড়াতে বিদেশে আরও শাখা খোলার সুপারিশ করেছে।
এদিকে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড জানিয়েছে, বিদেশে তাদের কোনো এক্সচেঞ্জ হাউস নেই। অথচ দেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লেনদেনই হয় এই ব্যাংকের মাধ্যমে।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রেমিট্যান্স আনার জন্য নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ হাউজের দরকার হয় না। বিশ্বের যেকোনো মানি এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে চুক্তি করেই রেমিট্যান্স আনা সম্ভব।"
সাধারণত দেশের ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে ড্রয়িং বা এজেন্সি অ্যারেঞ্জমেন্টের মাধ্যমে। এখন যেমন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন মানি ট্রান্সফার, মানিগ্রাম, এক্সপ্রেস মানি, ইন্টারন্যাশনাল মানি এক্সপ্রেস, ক্যাশ এক্সপ্রেস, রিয়া মানি ট্রান্সফারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা হয়। তবে এজন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত পরিমাণে প্রফিট দিতে হয়।
পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হয় যাত্রা?
২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় মানি এক্সচেঞ্জ চালু করতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপের দেশগুলোয় প্রায় দুই ডজন মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান চালু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
কিন্তু ব্যবসায়িক সমীক্ষা ছাড়াই চালু করা এসব মানি এক্সচেঞ্জের প্রায় অর্ধেকই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, অধিকাংশ ব্যাংক কোন ধরনের সম্ভাবতা পরীক্ষা ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠান খুলে। যার কারণে এসব বিদেশি শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর বেশিরভাগই খুব একটা সক্রিয় ও লাভজনক ছিল না। তাই বলা যায় গভীর সমীক্ষার অভাব, সঠিক পরিকল্পনা, এবং ঐসব অঞ্চল সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকা এ সহায়ক সংস্থাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে মূল কারণ।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ছোট অর্থনীতির দেশগুলো প্রায়ই লেনদেনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে সমস্যার সম্মুখীন হয়।"
তিনি বলেন, বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকরা সাধারণত নগদ লেনদেন করেন যা অনেক দেশেই নিরুৎসাহিত করা হয়। তিনি বলেন, বিদেশি ব্যাংক এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর দ্বারা ঘন ঘন নগদ লেনদেন নিয়ন্ত্রকবিষয়ক বাধার সম্মুখীন হয়।
"ঘনঘন নগদ লেনদেনের কারণে আমাদের বার্মিংহাম এক্সচেঞ্জ হাউসটিও বন্ধ ছিল। আদালতে আবেদন করে আমাদের সেই নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করতে হয়েছিল," যোগ করেন তিনি।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা এখন যুক্তরাজ্যে একটি রেমিট্যান্স হাউস খোলার পরিকল্পনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, সোনালী ব্যাংক শাখার মাধ্যমে যুক্তরাজ্য থেকে যেসব প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠাতেন তারা এখন এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন।
বিদ্যমান এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে লাভজনক করে তুলতে হবে
স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিদেশে ৬টি শাখা, ২৪টি এক্সচেঞ্জ হাউস ও ৭টি রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস ছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ভারতে দুটি শাখা এবং কুয়েত ও সৌদি আরবে তিনটি রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস রয়েছে। জনতা ব্যাংকের ইতালিতে দুটি এক্সচেঞ্জ হাউস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে চারটি শাখা রয়েছে।
রূপালী ব্যাংক পাকিস্তানে একটি ব্যাংকের শেয়ার কিনেছে। অগ্রণী ব্যাংকের মালয়েশিয়ায় ছয়টি এবং সিঙ্গাপুরে চারটি এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকায় দুটি এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে এবং ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও ইতালিতে চারটি এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মালয়েশিয়ায় নয়টি, গ্রিস ও মালদ্বীপে দুটি এবং সিঙ্গাপুরে তিনটি এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে।
প্রাইম ব্যাংকের সিঙ্গাপুর এবং যুক্তরাজ্যে ছয়টি এক্সচেঞ্জ হাউস এবং হংকংয়ে একটি সাবসিডারি রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আমেরিকায় সাতটি এবং যুক্তরাজ্যে একটি এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে।
এক্সিম ব্যাংকের যুক্তরাজ্যে একটি এক্সচেঞ্জ হাউস এবং হংকংয়ে একটি সাবসিডারি প্রয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের মিয়ানমার ও চীনে দুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস এবং হংকংয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবিএলের বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তিনি তার দায়িত্ব পালনকালে দেখেছেন, বিদেশি আউটলেট এবং এক্সচেঞ্জ শপ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকদের 'যথাযথ দায়িত্ববোধ' ছিল না।
"আমরা এমনও দেখেছি যে বিদেশি আউটলেটের কিছু কর্মী সপ্তাহে মাত্র দুবার অফিসে আসছেন, কিন্তু তারা বাকি সব সুবিধাই নিচ্ছেন," মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংকগুলো বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার পরিবর্তে স্বাধীন মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে কার্যকর চুক্তি করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে। নতুন হাউস খোলার আগে বিদ্যমান বিদেশি আউটলেটগুলোকে প্রথমে লাভজনক করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ।