কফি পানে বাড়ে কর্মক্ষমতা; কমে ঘুম: গবেষণা
পানীয় হিসেবে কফি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। আর তাই শরীরে এ পানীয়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে প্রায়শই নানা গবেষণা করা হয়। সম্প্রতি দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ কফি পান নিয়ে ছোট পরিসরে করা একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, প্রতিদিন অন্তত এক কাপ কফি পানে বাড়তে পারে কর্মক্ষমতা, কমতে পারে ঘুম। খবর সিএনএন-এর।
তবে কফি পানের যে শুধু ইতিবাচক প্রভাবই রয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। একইসাথে গবেষণা মতে, প্রতিদিন অন্তত এক কাপ কফি পানে ব্যক্তিবিশেষে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি সম্পর্কিত ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
শরীরে কফির প্রভাব বিশ্লেষণে করা এ গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক গ্রেগরি মার্কাস। তিনি বলেন, "কফি পানের সাথে শরীরে এর প্রভাব বিশ্লেষণের ব্যাপারটি অতটা সহজ নয়। কেননা মানবদেহে পানীয়টি নানাভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে।"
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মার্কাস জানান, মানবদেহে কফির প্রভাব নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই পর্যবেক্ষণমূলক। এ পদ্ধতিতে সাধারণভাবে যারা কফি পান করেন সরাসরি তাদের শরীরে এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু তাদের ওপর গবেষকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেক্ষেত্রে বাহ্যিক নানা প্রভাবকের দ্বারা গবেষণা ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে।
তাই গবেষণার ফলাফল আরও সুনির্দিষ্টভাবে পেতে হলে প্রথমত স্যাম্পল ঠিক করতে হবে। এরপর 'র্যান্ডমাইজ ইন্টারভেশন ট্রায়াল' অর্থাৎ স্যাম্পলকে বাহ্যিক সকল ধরণের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে শরীরে সুনির্দিষ্টভাবে কফির যে প্রভাব, সেটি বিশ্লেষণ করতে হবে।
এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই গবেষণাটিতে গড়ে ৩৯ বছর বয়সের ১০০ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে স্যাম্পল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এরপর এদের হাঁটাচলা ও ঘুম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। একইসাথে প্রতিনিয়ত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ও হৃদস্পন্দনের তথ্যও রেকর্ড করা হয়েছে।
পরবর্তী ধাপ হিসেবে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে দুই দিন নিজেদের চাহিদা অনুসারে কফি পান করতে দেওয়া হয়। এরপর পরবর্তী দুইদিন তাদের কফি পান থেকে একেবারে বিরত রাখা হয়। এভাবে টানা দুই সপ্তাহ ধরে এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতে থাকে ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো রেকর্ড করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কফি পানের দিনগুলোতে অন্য দিনগুলোর তুলনায় অংশগ্রহণকারীরা গড়ে ১০৫৮ বার বেশি পদক্ষেপ দিয়েছেন। অন্যদিকে কফি পানের দিনগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা অন্য দিনগুলোর তুলনায় গড়ে ৩৬ মিনিট কম ঘুমিয়েছেন। এক্ষেত্রে কফি পানের সাথে শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও ঘুম কমার একটা সম্পর্ক দেখা যায়।
তবে ঘুম ও কর্মক্ষমতা ছাড়াও হৃদপিণ্ডের ওপর কফির সূক্ষ্ম প্রভাব থাকতে পারে বলে এ গবেষণায় উঠে এসেছে। হৃদপিণ্ডের ভেনট্রিকলে স্বাভাবিকের তুলনায় হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়াকে বলা হয় প্রিম্যাচিউর ভেনট্রিকুলার কনট্র্যাকশন (পিভিসি)।
এক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যাদের হৃদপিণ্ডে আগে থেকেই পিভিসির প্রবণতা রয়েছে, তাদের প্রতিদিন এক কাপের বেশি কফি পানের ফলে পিভিসি (উচ্চমাত্রার হৃদস্পন্দন) এর প্রবণতা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মার্কাস বলেন, "পিভিসির অতিরিক্ত প্রবণতার কারণে হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে যাওয়া কিংবা হার্ট ফেইলরের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই পারিবারিকভাবে পিভিসির প্রবণতা থাকলে কিংবা চিকিৎসক পরামর্শ মতে এ সংক্রান্ত কোন ঝুঁকি থাকলে কফি পান থেকে বিরত থাকা উচিত।"
অন্যদিকে মেলবোর্নের আলফ্রেড হাসপাতালের ইলেক্ট্রোফিজিওলজির প্রধান পিটার কিস্টলার অবশ্য গবেষণাটি স্বল্প পরিসরে করা হয়েছে বলে এর ফলাফলের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "গবেষণাটিতে কফি পানের দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও অন্য স্বাস্থ্যগত অবস্থায় দেহে কফির প্রভাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি।"
মার্কাস জানান, কফি পান করলে কাজের প্রতি অনুপ্রেরণা আসতে পারে; হাঁটাচলায় ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারে। তবে তাই বলে অতিরিক্ত কফি পান কখনোই উচিত না। কেননা এতে করে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আবার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে ক্যাফেইন বিপাকের হার জানতে জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট পর্যালোচনা করা হয়েছে। দেখা যায়, কফি পানের ফলে যাদের ঘুমের পরিমাণ কমে এসেছে তাদের দেহে ক্যাফেইন বিপাকে ধীরগতি লক্ষণীয়। আর যাদের দেহে ক্যাফেইন বিপাকে দ্রুতগতি লক্ষণীয়, তাদের ঘুম কমে আসার প্রবণতা কম ও হৃদপিণ্ডে পিভিসির লক্ষণ প্রকাশের প্রবণতা বেশি।
কফি পানে দেহের প্রভাবকে আবার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কিস্টলার। তিনি বলেন, "মানসিক প্রশান্তি আনতে কফি ঔষধের মতো কাজ করে। কফি পান করলে ক্লান্তির পরিমাণ কমে আসে। তাই এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই।"
এছাড়াও কিস্টলার জানান, কফি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের সিম্পেথিটিক সিস্টেম কিংবা অ্যাড্রিনালিনকে কার্যকর করতে পারে। যার ফলে হৃদপিণ্ডের হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
মার্কাস অবশ্য মনে করেন, গবেষণাটি থেকে কফি পানের প্রাপ্ত ফলাফল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, "সাধারণভাবে পরিমিত পরিমাণে কফি পান করলে শরীরে এর বড় কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব নেই।"
অন্যদিকে ব্যক্তির দেহে ক্যাফেইন বিপাকের হার বেশি না কম; সেটি জানার ক্ষেত্রে সচারাচর ক্লিনিক্যাল টেস্ট করার কোনো উপায় আপাতত নেই। কেউ যদি ক্যাফেইন বিপাকের হার জানতেই চায়, তবে তাকে অবশ্যই ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। অবশ্য কফি পানের পর শারীরিক অবস্থার ওপর গভীরভাবে নজর দিলে এ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব।
দেহে ক্যাফেইন বিপাক প্রসঙ্গে কিস্টলার বলেন, "এক কাপ কফি পানের পর অস্বস্তি বোধ করলে দেহে ক্যাফেইন বিপাক ধীরে হয়ে থাকতে পারে। আর পানীয়টি পানের পর ভালো বোধ করলে মনে করতে পারেন যে, আপনার শরীরে ক্যাফেইন বিপাকের হার দ্রুত।"