এসডিজি অর্জনের অন্যতম প্রধান শর্ত সুষ্ঠু স্থানীয় সরকার নির্বাচন: রেহমান সোবহান 

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
12 March, 2021, 04:10 pm
Last modified: 12 March, 2021, 04:12 pm
অনুষ্ঠানে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “নাগরিকদের জন্য সরকারের দেওয়া সেবায়ও বৈষম্য রয়েছে। দরিদ্র মানুষ তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রভাবশালীরা নায্যতার বেশি পাচ্ছে”

প্রাথমিক শিক্ষা, মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা ও গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের মতো তৃনমূল পর্যায়ে সরকারি সেবাসমূহের গুনগত মান নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মন্তব্য করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অবাদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

'গণতান্ত্রিক সুশাসন ও উন্নয়ন: তৃণমূল প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা' শীর্ষক এক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বৃহস্পতিবার বলেন,  "সরকারি সেবাসমূহে স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ মানুষের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন নির্বাচিত প্রতিনিধি এ বিষয়ে কাজ না করলে জনসাধারণ পরের বার অন্য কাউকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবেন। এর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পরিবেশ প্রয়োজন।"

ইউরোপিয় ইউনিয়নের সহযোগীতায় সিপিডি ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশ যৌথভাবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) এ সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন (ইইউ) এর রাষ্ট্রদূত রেনসে টেরিঙ্ক, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর দিপঙ্কর দত্ত বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

সেমিনারে বক্তারা স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেন। তাছাড়া, স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোরও তাগিদ দেন তারা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, "ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো গেলে দেশের চিত্র পাল্টে যাবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বিষয়টি সেভাবে আসছে না।"

তিনি বলেন, "উন্নয়ন কাজ, এমনকি কর্মীদের বেতন ভাতার জন্য করপোরেশনগুলো সরকারের কাছে হাত পেতে থাকে। আর্থিক স্বাধীনতা বাড়াতে হলে সরকারের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে স্বচ্ছতাও আনতে হবে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৬৬ ডলার। আর বিদেশি মূদ্রার রিজার্ভ ছিল ০.৯৯ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় দাতাগোষ্ঠীগুলো নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ক্ষতিকর প্রকল্প চাপিয়ে দিতো। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশ এখণ একটা শক্ত অবস্থানে দাড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।"

তিনি আরও বলেন, সরকারের একার পক্ষে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সব শ্রেণির জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে দেশের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে হবে। 

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "গত পঞ্চাশ বছরে আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকেই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে সবাই এ উন্নয়নের সুবিধা পেয়েছে কিনা- সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। গড় আয় বাড়লেও সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা লোকজনের আয় কমলে উন্নয়ন টেকসই করা যাবে না।"

লিঙ্গ, বয়স ও এলাকাভেদে বৈষম্য বাড়ছে। এ বৈষম্য কমাতে হবে। মানুষের কাজের ব্যবস্থা না হলে প্রবৃদ্ধি কোন কাজে আসবে না, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, "নাগরিকদের জন্য সরকারের দেওয়া সেবায়ও বৈষম্য রয়েছে। দরিদ্র্ মানুষ তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রভাবশালীরা নায্যতার বেশি পাচ্ছে।"

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "যেকোন উন্নয়নই স্থানীয় পর্যায় থেকে আসে। এসডিজি অর্জণও স্থানীয়ভাবে করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি পরিষেবা স্থানীয়ভাবে বিতরণে দায়িত্বরতদের সাথে স্থানীয় জনসাধারণের সংশ্লেষ বাড়াতে হবে। স্থানীয় জনগনকে শক্তিশালী করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।"  

এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, দেশে গড়ে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকলেও, অনেক এলাকায় তা ৫০ শতাংশের বেশি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এসব এলাকাকে এসডিজি অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টেরিঙ্ক বলেন, "করোনার টিকা প্রদানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭ শীর্ষ পারফরমারের মধ্যে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। তৃনমূল পর্যায়ের লোকজন তথা স্থানীয় এনজিও, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে এটা সম্ভব হয়েছে।" 

বাংলাদেশের পক্ষে উচ্চাকাঙ্খী এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য রোধ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

"এ লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারকে শুধুমাত্র সেবা প্রদানকারী না হয়ে নাগরিকদের দাবি-দাওয়ার কণ্ঠস্বরে পরিণত হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার মাধ্যমে অন্তর্ভূক্তিমূলক নীতিমালার বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।" 

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দারিদ্র্য নিরসন, নাগরিকদের সক্ষমতা বাড়ানো, অবকাঠামো গড়ে তোলা, দুর্যোগ প্রশমন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে রেহমান সোবহান বলেন, "সরকারি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পয়ঃনিষ্কাশন ও অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহারে সব নাগরিকের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসডিজির যেসব লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নাগরিকরা যাতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের প্রাপ্য সেবা যথাযথ উপায়ে পেতে পারেন, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং এসডিজি বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে উপযুক্ত উপলব্ধি সৃষ্টি করতে হবে।" 

সিপিডির চেয়ারম্যান আরও বলেন, "স্থানীয় সরকার যেন অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। সরকার এসডিজি বিষয়ে যেসব নীতি কাঠামো প্রণয়ন করছে, সেগুলোর বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিকদের মধ্যে যাতে যথাযথ উপলব্ধি সৃষ্টি হয়- সেজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জীবনচক্র ভিত্তিক সব জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।" 

সমাপনী অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের দায়িত্ব শুধু আইন প্রনয়ন করা নয়, যে আইন আমরা প্রনয়ন করি সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটাও দেখার দায়িত্ব আমাদের। যেমন বাজেটে অংশ নিয়ে আমরা বরাদ্দের কথা বলি-সেখানে বরাদ্দ ঠিকঠাক হলো কিনা, সেটা দেখাও আমাদের দায়িত্ব। 

অক্সফাম গ্রেট ব্রিটেন শাখার সিইও ধনঞ্জয় শ্রিসকন্দরাজা বলেন, "আমাদের স্থানীয় সরকার, নাগরিক শক্তি এই বিষয়গুলো কত গুরুত্বপূর্ণ; কোভিড সময়কালে আমরা তা আবার নতুনভাবে আবিস্কার করেছি। আগামীদিনে আমরা রূপান্তরমুখী পরিবর্তনের কথা বলছি। অতিমারি পরবর্তী সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি শক্তি নিয়ে সঙ্কট থেকে বের হতে হবে।"  

জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, এসডিজির আলোকে অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব একটি বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মিলিত উদ্যেগ কার্যকর অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে অনেক কাজ আছে, যেগুলো স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সরকার করে থাকে। কিন্তু, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আছে। "এই প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করা যায়, সেটা ভাবতে হবে।"  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.