সরীসৃপ পাচারে বিশ্বে সপ্তম বৃহৎ উৎস বাংলাদেশ 

বাংলাদেশ

মেহেদি আল আমিন
03 March, 2021, 08:55 pm
Last modified: 03 March, 2021, 09:12 pm
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্র ২০ শতাংশ চোরাচালানের খবর জানা গেলেও, ৮০ ভাগই প্রকাশ্যে আসছে না

গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাবার রীতি দেশ বা সংস্কৃতি বিশেষে ভিন্নতর। চীনারা তাদের সম্মানিত অতিথির জন্যে রান্না করে সাপ, বনরুই বা প্যাঙ্গোলিন এবং আরও নানা ধরনের প্রায় বিলুপ্ত বন্য প্রাণি। বিচিত্র মাংসের এই চাহিদা পূরণ করে স্থানীয়ভাবে চাষ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বৈধ ও অবৈধ উভয়ভাবে আমদানি।  

এই প্রক্রিয়াতে ২০০৭-১৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হয়ে ওঠে বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ সরীসৃপ পাচারের উৎস। অবৈধ এ বানিজ্যের ২.৫ শতাংশ হয়েছে এদেশ থেকে। তথ্যটি উঠে এসেছে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) এক প্রতিবেদনে। "ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম রিপোর্ট: ট্র্যাফিকিং ইন প্রটেক্টেড স্পিসিস" শীর্ষক প্রতিবেদনটি গেল বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত হয়।

বিরল প্রাণি চোরাকারবারে শীর্ষ উৎস দেশ হলো ভারত, তারপরের স্থানগুলো দখল করেছে যথাক্রমে; উজবেকিস্তান, মাদাগাস্কার, পাকিস্তান, মালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ড। এসব দেশের নানা প্রজাতি পাচারে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান গন্তব্য হলো চীন।    

চীনে আছে হাজার বছর প্রাচীন ওষুধ শিল্প। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পসহ অলঙ্কার, শোপিস এবং ফ্যাশন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়- পুরো পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করা বন্য প্রাণি দেহের নানা অংশ। 

জ্যান্ত পাচারের সময় ছোট্ট খাঁচায় বন্দি থেকে হাঁসফাঁস করে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ভুগে এবং আরও অনেক কারণে মারা যায় প্রাণিরা। এজন্য যাত্রাকাল সংক্ষেপ করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাচার হওয়া সরীসৃপ জাতীয় প্রাণির ৫৬ শতাংশকে আকাশপথে পরিবহন করেছে অসাধু চক্র। ইউএনওডিসি প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। 

সরীসৃপ পাচারকারীদের কাছে নানান প্রজাতির কচ্ছপ হলো উচ্চ দাম নিশ্চিত করার মতো পণ্য। কিছু কিছু প্রজাতি এত মূল্যবান যে, সেগুলো সংগ্রহের উৎস দেশ থেকে এয়ার কুরিয়ারের মাধ্যমে চূড়ান্ত গন্তব্যের দেশে আনা হয়।  

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে ডাক এবং এয়ার কুরিয়ারে পাচারকালে চালান আটকের ঘটনা তাই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল থেকে দুটি ক্ষেত্রেই চালান আটকের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ইউএনওডিসি প্রতিবেদন আরও জানায়, জব্দ করা চালানের ৮০ শতাংশই ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট পরিমাণের, গড়পড়তা প্রতিটি চালানে ছিল ১৫টির কম সরীসৃপ। 

এব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে, বন বিভাগের বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিট- এর পরিচালক এএসএম জহির উদ্দিন আকন বলেন, ২০১৬ সালের পর আমরা কচ্ছপের কোনো চালান আটক করিনি। আর আমাদের এখান থেকে এতো বন্য প্রাণি পাচারও হচ্ছে না।" 

"কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাচার হওয়া সব পণ্য পরীক্ষা করে দেখার মতো যথেষ্ট লোকবল নেই আমাদের। দেশের আন্তর্জাতিক সব বন্দরে আমাদের কর্মকর্তাও নেই। তবে গোপন সূত্রে কোনো সংবাদ পেলে, তখন অবৈধ চালান আটকের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে," তিনি যোগ করেন। 

বাংলাদেশ থেকে পাচার করা প্রজাতি:

২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ কচ্ছপ ছিল বিশ্বব্যাপী আটক বন্যপ্রাণির ৪৭ শতাংশ। তারপর ছিল সাপ, গিরগিটি, কুমির ও অন্যান্য সরীসৃপ। পাচার হওয়া কচ্ছপের মধ্যে কালো ফুটিওয়ালা আর এশীয় বক্স কচ্ছপ- এ দুটি প্রজাতি ছিল ধরা পড়া চালানের ১৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট –আইইউসিএন দুটি প্রজাতিকেই বিপন্ন ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশেও প্রজাতি দুটির উপস্থিতি আছে। 

বৈশ্বিক বন্য প্রাণি বাণিজ্য নিয়ে কাজ করা এনজিও- ট্র্যাফিক ২০১৮ সালে "ব্ল্যাক স্পটেড টার্টল ট্রেড ইন এশিয়া: এ সিজার এনালাইসিস" শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ নাগাদ তিনটি পৃথক ঘটনায় বাংলাদেশে ১,১৯৭ কালো ফুটিওয়ালা কচ্ছপের চোরাচালান ধরা পড়ে। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় চালানপ্রতি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কচ্ছপ ধরা পড়েছে, এই তিন চালানের গড় হিসাবে। অর্থাৎ, প্রতি চালানে ধরা পড়েছে ৩৯৯টি করে।     

ইউএনওডিসি প্রতিবেদনেও বিশ্বব্যাপী জ্যান্ত বন্যপ্রাণি চোরাচালয়ান আটকের ঘটনাগুলো কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। তবে এদেশ থেকে কচ্ছপের আরও কিছু প্রজাতি পাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী ভারতে, যার উল্লেখ প্রতিবেদনে নেই।  

অলাভজনক সংস্থা- ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স "ট্রান্স-বাউন্ডারি ট্রেড অব ফ্রেশ ওয়াটার টার্টলস ফ্রম বাংলাদেশ টু ত্রিপুরা" শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের বন বিভাগের কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে ছিল চোরাকারবারী চক্র, দাম এবং পাচার করা স্বাদু পানির কচ্ছপের সংখ্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ নানা বিবরণ।   

২০১৭ সালে করা ওই গবেষণায় দেশের চুনারুঘাট, ভৈরব, দেবীদ্বার, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, আখাউড়া এবং আজমপুর অঞ্চলকে কচ্ছপ সংগ্রহ করে একত্র করার সাতটি কালেকশন পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চোরা শিকারিরা জলাভূমি বা নদী থেকে কচ্ছপগুলো ধরে কালেকশন পয়েন্টে নিয়ে আসে, তারপর সেগুলো বিক্রি করে ত্রিপুরার আগরতলায় বটতলা বাজার এবং গোলবাজারে।   

গবেষকরা আগরতলার বড় এ দুটি বাণিজ্য কেন্দ্রে 'ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাপশেল' প্রজাতির কচ্ছপ প্রতি কিলো ৯ থেকে ১২ মার্কিন ডলারে বিক্রি হতে দেখেছেন। 'ইন্ডিয়ান পিকক সফটশেল টার্টল' বিক্রি হয় ১৮-২৫ ডলারে, আর 'ইলোগনেটেড টরটোইজ' নামের প্রজাতি বিক্রি হয় কিলোপ্রতি ২৫-৩৫ ডলারে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৫৬ কেজি কচ্ছপ ও কাছিমের বেচাকেনা চলে। 

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স- এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, "ভারতের সাথে আমাদের বিশাল সীমান্ত। তাই সহজেই এদেশ থেকে কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্য প্রাণি সীমান্ত ঘেঁষা ভারতীয় রাজ্যগুলোয় পাচার করা যায়। এমন অসাধু তৎপরতা বন্ধে সরকারের কঠোর নজরদারির পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।"
 
দেশে আটক চালান: 

বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের ঢাকা অফিস ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৮,০৪১টি সরীসৃপ আটক করেছে। একই সময়ে ইউনিটটি বাঘ ও হরিণ-সহ ২৩৩টি স্তন্যপায়ী প্রাণিকে পাচারের সময় আটক করে। উদ্ধার করা হয় ২১,৮২০টি পাখি এবং ট্রফি বা স্মারক হিসেবে চালান করা ৮৮২টি প্রাণির মাথা ও দেহায়ব।    

ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির "কম্ব্যাটিং  ওয়াইল্ড লাইফ ট্রেড ইন বাংলাদেশ: কারেন্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড নেক্সট স্টেপস" শীর্ষক ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে বেশি চিহ্নিত হয়েছে সরীসৃপ পাচারের ঘটনা।

বন্যপ্রাণী চালান ধরা পড়ার ২৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১৫টিই ছিল সরীসৃপ প্রজাতির। এসব সরীসৃপের মধ্যে আবার ৪৭.৮ শতাংশ ছিল মিঠাপানির কচ্ছপ, ৪০.৭ শতাংশ গিরগিটি/টিকটিকি, ৬.১ শতাংশ সাপ এবং ৩.৫ শতাংশ জলচর কাছিম এবং কুমির।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্র ২০ শতাংশ চোরাচালানের খবর জানা গেলেও ৮০ ভাগই প্রকাশ্যে আসছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খান বলেন, "মোট পাচারের মাত্র ২০ শতাংশ ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রিপোর্ট করছে, বাকি ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। তবে ধরা পড়া চালানে প্রাণির পরিমাণ বৃদ্ধির ঘটনা মানেই অবৈধ বাণিজ্যের পরিধি বিস্তার এমনটা নয়।"

তিনি বলেন, "ইউএনওডিসি প্রতিবেদন তথ্যসূত্রের প্রকৃত সংখ্যা তুলে ধরেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বাংলাদেশে পাচার করার মতো এতো বেশি সরীসৃপ নেই যে বিশ্বে সপ্তম হবে। অনেক দেশে আটক হওয়া অনেক প্রজাতি এদেশ থেকেই ধরা হয়েছে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেকক্ষেত্রে, বন্যপ্রাণি পাচারচক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে।" 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.