বৈশ্বিক মূল্যের চাইতে দেশে সৌরবিদ্যুতের দাম ছয় গুণ বেশি

বিগত এক দশকে বিশ্বব্যাপী প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম ৩২ টাকা থেকে ৫.৭৬ টাকায় নেমে এসেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে সৌর বিদ্যুৎ আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৭টি মিনি গ্রিড রয়েছে। গ্রিডগুলোতে পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু, বাংলাদেশে এসব গ্রিডে সৌর বিদ্যুতের মূল্য এখনো প্রতি ইউনিট ৩২ টাকা। সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধি করত্ জাতীয় গ্রিডের সাথে মিনি গ্রিডগুলো যুক্ত করার পদক্ষেপ নিলে মালিকপক্ষ এই মূল্য প্রস্তাব করে।
জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর শক্তি খাতের চাইতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রস্তাবিত মূল্য পাঁচ গুণ বেশি। বৈশ্বিক গড়ের চাইতেও এই মূল্য ছয় গুণ। ব্যবসায়িক হিসাবে এধরনের প্রস্তাব অর্থহীন। বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনস্ত টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারণে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মিনি-গ্রিডের জন্য ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণে উদ্যোগ নিয়েছে।
স্রেডার পরিচালক মোহাম্মদ আলাউদ্দীন বলেন, "মিনি গ্রিড সংগঠন এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) ইউনিট প্রতি ৩২ টাকার প্রস্তাব রেখেছে। আমরা এখন অন্যান্য অংশীদারদের সাথে উৎপাদন খরচের বিষয়ে মধ্যস্থতায় আসার চেষ্টা করছি।"
মিনি-গ্রিডগুলোকে জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, "ইডকলের অর্থায়নে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক সেবাদানকারী একটি কোম্পানি। মিনি গ্রিডগুলোকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা না হলে, অবকাঠামোগুলো পড়ে অব্যবহৃত থাকবে।"
পিভি-নির্ভর সৌর মিনি গ্রিডগুলো ২০১০ সালে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে স্থাপিত হয়। জাতীয় গ্রিডগুলো থেকে এরা বেশ দূরে অবস্থিত। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্রকল্পে ১৪১ কোটি টাকা ব্যয় করে।
তবে সময়ের সাথে, দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতেও পৌঁছে গেছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ। ফলে মিনি গ্রিড প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বললেই চলে।
এখন পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) লাইন ১৩টি ক্ষুদ্র-গ্রিডে পৌঁছে গেছে। বাকি অঞ্চলগুলোতেও এবছরের শেষ নাগাদ পল্লী বিদ্যুৎ বা অন্যান্য বিতরণ প্রতিষ্ঠান পৌঁছে যাবে।
অন্যদিকে, গ্রিড বিদ্যুতের দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় মানুষ এখন মিনি-গ্রিড ব্যবহার বন্ধ করছে। ফলে, নিম্ন-চাহিদা, এমনকি কোনো কোনো জায়গায় একদমই চাহিদা না থাকায় মিনি-গ্রিড মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এছাড়া, প্রকল্পটির জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধে মালিকপক্ষকে ছয় থেকে আট শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুণতে হচ্ছে। একারণে ব্যবসা সচল রাখতে মালিকপক্ষ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে মিনি-গ্রিডগুলোকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার আবেদন করে।
সরকারি উদ্যোগ:
গত বছর আগস্টে জাতীয় গ্রিডের সাথে সৌর গ্রিড সংযোগ ও মূল্য নির্ধারণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ একটি কমিটি গঠন করে।
মিনি-গ্রিড মালিক এবং ইডকল প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ৩২ টাকা করে রাখার প্রস্তাব দেয়। সরকার স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) কাছ থেকে যে মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তার থেকে এই মূল্য পাঁচ গুণ বেশি।
স্রেডার একটি সূত্র জানায়, ওয়েস্ট জোন বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাসহ দুইটি বিতরণ প্রতিষ্ঠান ইডকলের প্রস্তাবিত মূল্যে বিদ্যুৎ নিতে রাজী হয়।
তবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এই মূল্যে বিদ্যুৎ নিতে রাজি হয়নি। তাদের দাবি অন্যান্য প্ল্যান্টের তুলনায় এই মূল্য মাত্রাতিরিক্ত।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অবঃ) বলেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৩২ টাকা করে কেনার কোনো যুক্তি নেই।
"কিছু প্রকল্প দশ বছর ধরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আসছে। এতোদিনে তারা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পেয়েছে। তাহলে আমরা কেন তাদের এত দাম দেব?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বাংলাদেশে মিনি-গ্রিড বিদ্যুতের দাম বেশি কেন?
বিগত এক দশকে সৌর বিদ্যুতের মূল্য কমার পরেও কেন মিনি-গ্রিড মালিকরা পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি মূল্য দাবি করছে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে এই মূল্য অবকাঠামোগত ডিজাইন ত্রুটির জন্য বলে দাবি করেন সোলার মিনি-গ্রিড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার ডিএম মজিবর রহমান।
তিনি বলেন, সোলার প্যানলের খরচ কমছে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই।
"তবে, মিনি-গ্রিডে প্যানলের মূল্য মোট উৎপাদন খরচের মাত্র ২০ শতাংশ বহন করে। অন্যদিকে, সংরক্ষণ ও বিতরণ অবকাঠামোর জন্য ৮০ শতাংশ খরচ দায়ী। তাছাড়া, ব্যাটারি, ইনভার্টার ও কন্ট্রোলারের দামও বেড়েছে," ব্যখ্যা করেন তিনি।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আহমেদ মজিবর রহমানের সাথে সহমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, "জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত সোলার মিনি-গ্রিডগুলোর সংরক্ষণ ক্ষমতা ও বিতরণ অবকাঠামোর দরকার নেই। এজন্য, অন্যান্য সৌর প্রকল্পের তুলনায় মিনি গ্রিডের খরচ বেশি।"
ইডকলের ক্রুটিপূর্ণ নকশা:
অর্থায়নের ক্রুটিপূর্ণ মডেল ও প্রযুক্তিগত নকশা যার জন্য মিনি-গ্রিডগুলোর খরচ বেড়েছে, তার জন্য মজিবর রহমান ইডকলকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, "আর্থিক মডেলে প্রকল্প অনুদানের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। ভারতে এই হার ৮০ শতাংশ। এ কারণে ভারত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১১.৬১ টাকা বা ১০ রূপিতে দিতে পারে।"
"এছাড়া, টেকনিকাল নকশায় ইডকল মাঠ পর্যায়ে সোলার বিকিরনের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করেনি। প্যানেলগুলোও ঠিক ভাবে বসানো হয়নি। এমনি সিস্টেম লসের হিসাবও ছিল না," বলেন তিনি।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বছরের ১৯৩ দিনেই কুয়াশা, বৃষ্টি বা মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকে। যা বছরের মোট সময়ের ৬০ শতাংশ।
তবে, ইডকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ মালিক এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাননি।