ইতালির যেই শহর ম্যারাডোনাকে ভুলবে না
ইতালির ন্যাপোলি শহর ১৯৮৪ সালে তেমন বড় কিছু ছিল না। যদিও রোম থেকে ট্রেইনে মাত্র দেড় ঘন্টা দুরত্ব কিন্তু একদম ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন খাবার, সংস্কৃতি এবং ফুটবল। মাফিয়া তন্ত্রের কারণে শহরে একটা ভয় ছিল। পর্যটকরা তাদের টাকা গুটিয়ে কোনমতে চলে যেত ইতালির আরো দক্ষিণের আমালফি এলাকায়।
তাছাড়া ছিল একটা বৈষম্য। ওই সময় ইতালির ফুটবলে অনেক এগিয়ে ছিল উত্তরের সব ক্লাবগুলো। টোরিনো শহরের য়ুভেন্টাস আর মিলানো শহরের এসি মিলান ও ইন্টারনাজ্জিওনালে। ফুটবল ছাড়াও এই উত্তর-দক্ষিণ বৈষম্য রয়ে যায়। উত্তরের শহরগুলো ছিল অনেক ধ্বনি, দক্ষিণে গরীব এবং মাফিয়ার কারনে অনেকটা অনিরাপদ। এ নিয়ে মজা করত, ছোট করে দেখত উত্তর ইতালির মানুষ দক্ষিণ ইতালির মানুষকে।
এসি মিলানের সমর্থকরা খুব খারাপভাবে ন্যাপোলির প্লেয়ার ও দর্ষকদের ছোট করত। তারা বলত এদের কলেরা আছে। এমনও বলত যে ন্যাপোলির লোকজনের গায়ে এত গন্ধ যে কুকুরও তাদের থেকে পালিয়ে থাকে।
এমন এক সময়, বার্সেলোনা থেকে এসে হাজির হয় ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বার্সেলোনাতে অসাধারণ খেললেও, শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ টিমের সাথে মারামারি করে ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। এত ক্লাব থাকতেও সে ন্যাপোলিকেই বেছে নেয়।
ম্যারাডোনার নিজের জীবন ও অনেকটা দারিদ্রতার কষ্ট ভোগ করে ওঠা। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের একটা 'বাররিও' বা বস্তিতে বড় হওয়া ছেলে সে। এ কারণে ন্যাপোলির সাধারণ দর্শকের কাছে খুব পছন্দের প্লেয়ার ছিল সে। তাছাড়া, ন্যাপোলি শহরের সাথে একদক মিশে যায় ম্যারাডোনা, এমন কি মাফিয়ার সাথেও। ন্যাপোলির কামররা মাফিয়ার সাথে খুব খাতির ছিল তার, যেখান থেকে সে কোকেইন নেয়ার অভ্যাসটাও পরে শিখে। এবং ন্যাপোলি ছেড়ে পালানোও লেগেছিল তার কারণ এই মাফিয়ার সাথে ছিল উঠবস এবং পুলিশ তাকে খুঁজছিল।
কিন্তু ন্যাপোলির মানুষ তাকে দোষ দেয় না। হেলিকপ্টারে করে যেদিন এসেছিল সে, ৭৫,০০০ দর্শক মাঠে এসেছিল তাকে স্বাগতম জানাতে। এবং সব চেয়ে বড় অর্জন, সে মাঠে যাদু দেখিয়ে দিয়েছিল। ধনী ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গরীবলোকের ক্লাব ন্যাপোলিকে শিরোপা জিতিয়েছে কয়েকবার, যা ন্যাপোলি আগে কখনো পারেনি। তার খেলায় ন্যাপোলির জনগণ ফিরে পেয়েছিল তাদের মর্যাদা, উঠে দাঁড়াতে পারত মিলান, য়ুভেন্টাস ও ইন্টারের বিরুদ্ধে। যখন তাদেরকে বলত তাদের গায়ে গন্ধ, তাদের আছে কলেরা, তখন ন্যাপোলির দর্শকেরা মাঠে তাদের ডাক দিত। 'মা আমার হৃদপিন্ড কেন এভাবে ধব-ধব করছে?' বলে শুরু করত। তারপর সবাই এর উত্তর দিত 'কারণ আমি ম্যারাডোনা কে দেখেছি, প্রেমে পড়েছি আমি।'
কিন্তু এই ভালবাসার শ্রেষ্ঠ বহিপ্রকাশ পায় ১৯৯০ বিশ্বকাপে। সেমি-ফাইনালে ইতালি বনাম আর্জেন্টিনা। খেলার মাঠ? ন্যাপোলির সান পাওলো স্টেডিয়ামে। ম্যাচের আগে ম্যারাডোনা বলেছিল যে ন্যাপোলি ইতালি নয় এবং সবাইকে আহবার জানিয়েছিল আর্জেন্টিনা কে সমর্থন করতে। সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল ন্যাপোলির দর্শকেরা। আজ পর্যন্ত ইতালির অনেকেই তাদেরকে ক্ষমা করে না।
ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টিনা সব সময়ই এক হয়ে থাকবে। কিন্তু অনেক সময়ই ভুলে যাওয়া হয় যে বুয়েনস আইরেসের চেয়েও হয়ত বেশি ভালবাসা ন্যাপোলিতে তার জন্যে। এখনো শহরের অলিতে গলিতে তার ছবি আঁকা, এখনো মানুষ তার নাম শুনলেই অন্যরকম স্মৃতিচারণ করেন, যেন সেই দিন আর খুঁজে পায়নি। ন্যাপোলি ছাড়ার পরের দিন একটা দেয়ালে লিখা ছিল, 'ডিয়েগো আমাদের আবার স্বপ্ন দেখতে শেখাও।'
লেখক: ইমার্জেন্সি মেডিসিন ডাক্তার, যুক্তরাজ্য, এবং শিক্ষক, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি