করোনায় আটকে আছে শতকোটি টাকার প্রকল্প
পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে নেই তেমন শিল্প কারখানা। পর্যটনই এই জেলার বড় শিল্প। পর্যটন সমৃদ্ধ এই এলাকায় একটি মানসম্মত শিল্প কারখানা গড়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মো. মহসীন মিয়া মধুর। সেলক্ষ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ইছবপুরে ৮০ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে একশ কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ করে সুবিশাল ফুড ফ্যাক্টরি 'হেলদি চয়েস' গড়ে তোলেন তিনি।
২০১৮ সালের প্রথম থেকে অবকাঠামোর কাজ শুরু করে তা শেষ করেন ২০১৯ এর শেষের দিকে। পরিকল্পনা ছিল ২০২০ সালের শুরু থেকেই পুরোদমে উৎপাদন এবং একসাথে সারা দেশের মার্কেটে বিপনন শুরু করার। কিন্তু করোনা আসায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। চীন ও ইতালি থেকে আমদানি করা মেশিনগুলো ডিসেম্বরের শেষ দিকে সে দেশের ইঞ্জিনিয়াররা এসে ইনষ্টল করে দেওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তারা আসতে পারেননি। ফলে কোটি কোটি টাকার মেশিনগুলো চালু করা যাচ্ছে না ।
কর্মসংস্থান পিছিয়ে গেছে প্রায় ৪ হাজার মানুষের। বর্তমানে সীমিত আকারে উৎপাদন শুরু হলেও তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১০ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ বিভাগের সুত্রে জানা যায়, কারখানায় কমপক্ষে ২ হাজার কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আছে। সারা দেশে বিপনন বিভাগে নিয়োগ হবে আরও ২০০০ কর্মী। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হবে। এখন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছে ১২০ জন শ্রমিক-কর্মচারী।
প্রকৌশলী ও জনবল
চীন ও ইতালি থেকে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। এসব মূলত অটোমেশন পদ্ধতির উৎপাদন যন্ত্রপাতি। চীন ও ইতালির সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে ডিজিটাইজড এসব মেশিন বসানোর পর উৎপাদন শুরু ও দেশীয় অপারেটরদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চুক্তি রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে লোকবলের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বিপণন ও মার্কেটিং বিভাগের ম্যানেজার কাজী আব্দুল্লাহ জানান, বিদেশি বিশেষজ্ঞরা করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এসে মেশিন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাবেন, কিন্তু তার আগে আমাদের নিজস্ব লোকবল প্রস্তুত করতে হবে।
করোনার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৫ একর জমির ওপর তৈরি হওয়া সুবিশাল এই ফুড ফ্যাক্টরি চালু হলে এটিই হবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রথম কোনো শিল্পকারখানা। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বড় কোনো কলকারখানা নেই।
তিনি বলেন, 'হেলদি চয়েসে বিপুল সংখ্যক কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এখন অল্প কিছু জনবল নিয়োগ হয়েছে মাত্র। করোনার আগে কারখানার বিভিন্ন পদে জনবলের জন্য আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিললাম। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারিনি।'
করোনা আরেকটা বিপদ তৈরি করেছে, বলে উল্লেখ করেন কাজী আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে স্থানীয়ভাবে কারখানায় কাজ করার দক্ষ পরিচালক, অপারেটর নেই। মূলত দক্ষ লোক ঢাকা কিংবা অন্য শিল্পাঞ্চল থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন করোনার কারণে কেউ ঢাকা বা চট্রগ্রাম থেকে এখানে এসে নিয়োগের প্রক্রিয়ার যাচাই বাচাইয়ে অংশ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না।'
স্বপ্নের প্রকল্প
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. মহসীন মিয়া বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ২০১৮ সাল থেকে আমার স্বপ্নের এই প্রজেক্ট শুরু হয়। ২০১৯ এর শেষের দিকে কাজ শেষ হয়। এখানে একশ কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ করেছি। এর মধ্যে ৮০ কোটি টাকা ব্যাংক লোন। কারখানা উৎপাদনে না যেতে পারায় দায় বাড়ছে প্রতি মুহুর্তে।
কবে পুরোদমে কারখানা চালু করতে পারবেন তা শুধু করোনা পরিস্থিতির উন্নতির উপরেই নির্ভর করছে না মো. মহসীন মিয়া জানান, এখন আসলে মূল চ্যালেঞ্জ জনবল নিয়োগ। মফস্বল এলাকা হওয়াতে ঢাকার অভিজ্ঞ লোকজন এখানে আসার ব্যাপারে আগ্রহী না। স্থানীয়ভাবে মেশিন চালানোর মতো দক্ষ বা প্রশিক্ষিত অপারেটর নাই, এধরনের শিল্প কারখানার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করার মতো প্রশিক্ষিণ সুবিধাও আমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে। এসব করেই তবেই উৎপাদনে যেতে হবে।
মো. মহসীন মিয়া তার এলাকার বেকারদের এখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান। এই কারখানা নিয়ে স্থানীয় বেকার তরুন তরুনীরাও স্বপ্ন দেখছে, তিনি জানান। স্থানীয়ভাবে ১ হাজার কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারলেও ১ হাজার বেকার যেমন কাজ পেতো সেই সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোও অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হত। কারখানা চালু হলে কোটি কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকবে।
করোনার কারণে গুরুত্বপূর্ণ আট মাস পেরিয়ে গেছে।
সবকিছু অনশ্চিত জানিয়ে তিনি বলেন, স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে ছন্দপতন অনেক ভাবেই আঘাত দিয়েছে কিন্তু করোনার কাছে আমরা অসহায়, কিছু করার নেই। কবে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে তা বলা কঠিন তবে আমি আশাবাদি তাই করোনা কালেও সীমিত আকারে ১২০ জন কর্মচারী দিয়ে পরিক্ষামূলক চালু রেখেছি। শেষ বয়সে আমি এলাকার জন্য এটা করে যেতে চাই।
সীমিত উৎপাদন
পরীক্ষামূলকভাবে 'হেলদি চয়েস' ফ্যাক্টরিতে শতভাগ হালাল চিপস, চানাচুর, মটরভাজা, কেক, ওয়েফারসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। 'হেলদি চয়েস' ব্রান্ড নেম হলো 'মজার'। সিলেটি ভাষায় 'মজার শব্দের অর্থ হলো স্বাদ। পূর্ণ উৎপাদনে গেলে হেলদি চয়েস, প্রচুর বিভিন্ন প্রকারের বিস্কুট উৎপাদন করবে।
সীমিত উৎপাদনের এ পর্যায়ে 'হেলদি চয়েস' মূলত পণ্যের মাননিয়ন্ত্রনের উপর জোর দিচ্ছে, হাইজিন, সেফটি, সিকিউরিটিসহ সব ধরনের কমপ্লায়েন্স পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা পরিকল্পনা রয়েছে, জানান কারখানার ফ্যাক্টরি ম্যানেজার সোহেল আহমদ।
এটিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্টান হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মো. মহসীন মিয়া । করোনাকালে আমাদের কার্যক্রমে স্থবিরতা এসছে তবু আমরা আশা করি এ আঁধার কেটে আলো আসবেই। আমরা, আমাদের ভোক্তাদের সর্বোচ্চ মানের খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতে সবসময় সচেষ্ট থাকব।