করোনাভাইরাস: ‘জুলাই মাসে সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছাবে চট্টগ্রাম’
চট্টগ্রামে ৩০ জুন পর্যন্ত আট হাজার ৮৫২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে শুধু জুন মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন ছয় হাজার ৬৬১ জন। তার মানে, বন্দরনগরীতে এ পর্যন্ত যত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন, এর অধিকাংশই জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
লকডাউন শিথিল, নমুনা পরীক্ষায় ধীরগতি এবং ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, লকডাউন চলাকালেও অনেকে নির্দেশনা মানেনি। আবার লকডাউন তুলে নেওয়ার পর মানুষ আর ঘরে বসে থাকেনি। মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা-যাওয়া শুরু করে। ফলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার যোগান তৈরি হয়। লকডাউন থাকলে রোগটি একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকত এবং সংক্রমণ গতি এত বাড়ত না।
জুলাই মাসে চট্টগ্রামে করোনার সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছাবে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, চূড়ায় পৌঁছানো বলতে ক্রমাগত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকবে এবং এক পর্যায়ে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হবে। এরপর শনাক্তের সংখ্যা কমে যাবে।
'চট্টগ্রাম এখনো সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছায়নি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জুলাই মাসে সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে', যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রামে আক্রান্ত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুন মাসে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মৃত্যুও। জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১৭৮ জন মারা গেছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে। এর মধ্যে শুধু জুনে মারা গেছেন ৯৯ জন।
চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে আক্রান্তের হারও বেশি। এ হার সারা দেশে ১৯ শতাংশ হলেও চট্টগ্রামে ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ৩০ জুন পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২৭ হাজার ৯৫৯টি। কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন আট হাজার ৮৫২ জন। সেই হিসেবে নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
তবে জুন মাসে সুস্থতার হার বেড়েছে। চট্টগ্রামে জুন পর্যন্ত করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৬৫ জন। এরমধ্যে শুধু জুন মাসে সুস্থ হয়েছেন ৮৩৮ জন।
২০১৯ সালে শেষের দিকে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী মহামারিতে রূপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে এই ভাইরাসে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ রোগী প্রথম শনাক্ত হয় গত ৩ এপ্রিল। ৬৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি নগরের দামপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পরবর্তী সময়ে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এদিকে, সাধারণ ছুটি গত ৩১ মে তুলে দেওয়ার পর মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। জেলায় জ্যামিতিক হারে রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. মোস্তফা জামাল।
তিনি বলেন, মানুষকে আইসোলেটেড করতে পারলে সংক্রমণ এত দ্রুত বাড়ত না। চাহিদামতো নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। এতে করে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, 'করোনাভাইরাস চট্টগ্রামে কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন রোগীকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কোভিড ইউনিট চালু করতে হবে। পাশাপাশি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন, হাই ফ্লো ন্যাসালক্যানুলার ব্যবস্থা করতে হবে।'
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দরনগরীর মানুষ স্বাস্থ্যবিধি কম মানছেন।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, বাণিজ্যিক হাব হওয়াতে চট্টগ্রামে সারা দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করেন। এজন্য ভাইরাসটি এখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলাম, চট্টগ্রাম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু মানুষকে আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখিনি। প্রকাশ্যে বাসিন্দারা ঘোরাঘুরি করেছেন এবং সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারে উদাসীন ছিলেন।
'পরীক্ষার গতি বাড়াতে আমরা ইতোমধ্যে দুটি বেসরকারি ল্যাবকে নমুনা পরীক্ষা করানোর অনুমতি দিয়েছি। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা করোনা হাসপাতালগুলোকে দ্রুত অনুমোদন দিচ্ছি। পাশাপাশি সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়িয়েছি। আগে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজার নমুনা পরীক্ষা হতো। এখন ১২০০ থেকে ১৩০০ নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে। নয়তো কোনোভাবেই এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না,' বললেন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী।