ট্রলিম্যান: রেলের ভার বয়ে যে পথ চলে
রেল দপ্তরের প্রকৌশল বিভাগের একটি পদের নাম ট্রলিম্যান। রেলপথের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানে সাহায্য করেন তারা। অনুসন্ধানের কাজটি করেন মূলত প্রকৌশলীরা। তাদের পথে পথে বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব ট্রলিম্যানদের। প্রাথমিক ত্রুটি সারানোর জন্য কাজ করেন যে মিস্ত্রি বা কিম্যান, তাদেরও বয়ে নিয়ে চলেন ট্রলিম্যান। রেলপথ নজরদারি বা চেকিংয়ের কাজ করেন ওয়েম্যান। ট্রলিম্যানরা তাদের কাজও সহজ করে থাকেন।
দুই ধরনের ট্রলি আছে রেলের — পুশ ট্রলি আর মোটর ট্রলি। ধাক্কা দিয়ে চালাতে হয় পুশ ট্রলি। ৩০ বা ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে চলাচল করে পুশ ট্রলি। প্রকৌশলীসহ ৫–৬ জন এতে চড়তে পারেন। মোটর ট্রলি ২৫০–৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল করে। ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে থাকে ১০ বা ১১ জন বহনে সক্ষম মোটর ট্রলি। মো. ওবায়েদুল ইসলাম রাজু যে মোটর ট্রলিটিতে কাজ করেন, সেটি নরসিংদী থেকে ভৈরব হয়ে আখাউড়া বাইপাস দিয়ে সিলেট পর্যন্ত ৩৫০ কিলোমিটার পথে চলাচল করে। এ পথের কিছু লাইন অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কিছু নতুন লাইনও যুক্ত হয়েছে।
পুশ ট্রলি ধাক্কায় চলে
রাজু ২০১২ সালে ট্রলিম্যান পদে আবেদন করেন। তখন অষ্টম শ্রেণি ছিল ন্যূনতম যোগ্যতা। ভাইভাতে রাজুকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল দেশের মোট আয়তন, জাতীয় ফুলের নাম ইত্যাদি সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন। সেটায় পাশ করার পর মেডিক্যাল ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একই বছর রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে কাজে যোগ দেন রাজু। রাজুর প্রশিক্ষণ হয় হালিশহরে। ৫৫ দিনের প্রশিক্ষণে মূলত সিগন্যাল চিনতে শেখানো হয়, আত্মরক্ষার কিছু উপায় এবং অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বাঁচার উপায় জানানো হয়।
সিগন্যাল ছাড়া রেলগাড়ির চলাচল মানে দুর্ঘটনা অবধারিত। তিনটি বাতি — লাল, হলুদ, সবুজ দিয়েই সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হয়। লাল মানে থেমে যেতে হয়, হলুদ মানে আস্তে চলতে থাকো আর সবুজ দেখলে অবাধে চলতে থাকো। স্টেশন থেকে বেরুনো বা ঢোকার মুখে জালের মতো বিছানো একাধিক লাইন থাকে; লুপ লাইন, হোম লাইন, মেইন লাইন, আউটার লাইন ইত্যাদি। কোন গাড়ি কোন লাইনে কখন দাঁড়াবে তা স্থির করতে বাতির সহযোগিতা লাগে।
লাইন ক্লিয়ার না থাকলে মোটর ট্রলি চলাচল করতে পারে না। পুশ ট্রলির অবশ্য ক্লিয়ারেন্স লাগে না। রেল গাড়ির মতোই মোটর ট্রলিও ব্রেক টেনে দিলেই গাড়ি জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে না। আর পুশ ট্রলিতে ব্রেক থাকেই না। তাই সতর্কতাই আত্মরক্ষার এবং দুর্ঘটনা এড়ানোর উপায়।
রাজুর পা ভেঙেছে
আড়াই মাস ধরে রাজু ডান পা নিয়ে ভুগছেন, গোছার বাটি আলগা হয়ে গেছে। সেদিন ডিউটি সেরে ফিরছিলেন তারা। রাত ১০টা বেজে গেছে। রেলগেট পার হচ্ছিল ট্রলি — একটা অটো রিকশা, আগে থেকে দেখাও যায়নি ভালো করে — অটোরিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে গিয়ে মোটর ট্রলি দূরে একটি গাছে গিয়ে আঘাত করে। রাজুর ডান পা, প্রকৌশলীর মাথা এবং আরেক ট্রলিম্যানের হাত ও পা আহত হয়। রেলের হাসপাতাল থাকায় চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে পা ভাঙার চিকিৎসা সেখানে দেওয়া হয় না বলে রাজুকে বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হাড় জোড়া লাগলে থেরাপি দেওয়ার খরচও নিজের পকেট থেকেই করতে হবে।
রাজু কাজে যোগদানের পর পুশ ট্রলিতে ছিলেন আড়াই বছরের বেশি। সপ্তাহে কমপক্ষে চারদিন ট্রলি নিয়ে বের হতে হতো। তিন স্প্যান পুশ করার নিয়ম। তারপর ট্রলিম্যানকে লাফিয়ে ট্রলিতে উঠতে হয়। এক ঠেলায় আধা কিলোমিটার পথ এগোয়। একটা স্প্যানে তিনটি রেল (লোহার বার) থাকে, এক রেল সমান ৪২ ফুট, মানে দাঁড়াল ১০০ মিটার ঠেললে পাঁচশ মিটার এগোয় ট্রলি।
পুশ ট্রলিগুলোর বডি হয় কাঠের আর চাকা লোহার। ট্রলিতে থাকে গজ বা লোহার পাত যা দিয়ে লাইনের প্রস্থ মাপা হয়। মিটার গেজ লাইনের গজ হয় তিন ফুট তিন ইঞ্চি তিন সুতা। গজ যদি ঠিকঠাক না আঁটে তখন মেরামতের প্রশ্ন আসে। ট্রলিতে ওয়েল্ডিং মেশিন, শাবল, গাইতি, করাত, কাটিং মেশিন ইত্যাদিও রাখা হয় জরুরি সময়ে। ট্রলিতে চড়ে প্রকৌশলী লক্ষ্য রাখেন দুটি রেল সমান লেভেলে আছে কি না, দুটিকে জোড়া দেওয়ার আংটা বা নাট-বল্টুগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, লাইন কোথাও বেঁকে গেছে কি না, স্লিপারের সঙ্গে জোড়া দেওয়া রেল বারের আংটা ছুটে গেছে কি না ইত্যাদি।
ছোটখাটো প্রয়োজনে ট্রলিতে যন্ত্রপাতি থাকা সাপেক্ষে নিজেরাই মেরামত করেন অথবা মিস্ত্রিকে ডেকে পাঠান। সাধারণত প্রতি ছয় কিলোমিটার রেলপথে প্রকৌশল দপ্তরের একজন করে মিস্ত্রি বা কিম্যান থাকে। সামান বাক্স থেকে রেঞ্জ, হাতুড়ির, শাবল, করাতের মতো জিনিসপত্র নিয়ে তিনি হেঁটে বেড়ান রেললাইন ধরে। রেল বা লোহার বারের কোথাও কিছু ঢিলা হয়ে থাকলে টাইট দেন, আগাছা পরিস্কার করেন, পাথর সরে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে এনে গুছিয়ে রাখেন।
পুশ ট্রলি লাইনে নামাতে লাইন ক্লিয়ার থাকা লাগে না। শুধু সামনের ও পেছনের স্টেশন মাস্টারকে জানিয়ে রাখা লাগে। এমনিতেও সময়সূচি হিসেব করেই পুশ ট্রলি লাইনে নামে। যেমন কোনো আন্তঃনগর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর দেড় বা দুই ঘণ্টা যদি ফাঁকা সময় থাকে সেটা পুশ ট্রলির টাইম। আর যদি কোনো ট্রেন চলেই আসে তবে ভাগ ভাগ করে ট্রলি লাইনের পাশে সরিয়ে নেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।
রাত-দিন বলে কিছু নেই
যেহেতু ইমার্জেন্সি স্টাফ, তাই ট্রলিম্যানের রাত-দিন বলে কিছু নেই। হেডকোয়ার্টারের কাছেই তাদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়। প্রকৌশল বিভাগের এলাকাভিত্তিক হেডকোয়ার্টার আছে যেমন ভৈরব থেকে আঠারোবাড়ি পর্যন্ত পথের হেডকোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী থেকে ভৈরব পথের হেডকোয়ার্টার নরসিংদী, ভৈরব থেকে আখাউড়া হয়ে হরষপুর পর্যন্ত হেডকোয়ার্টার আখাউড়া। ২৪ ঘণ্টার ডিউটি ট্রলিম্যানের।
একবার পশ্চিমাঞ্চলে থাকার সময় রাজুর ট্রলি ৩৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিল একদিনে — রাজশাহী সদর স্টেশন থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত। পথে পড়েছিল নন্দনগাছি, হরিয়ানা, সারদা ইত্যাদি স্টেশন। সেবার ওই দূরত্বে যতগুলি ব্রিজ আছে সেগুলোর সংখ্যা গোনা ও হালচাল জানা ছিল উদ্দেশ্য। রাজু যোগ করলেন, '৫০টির মতো ব্রিজ আমরা পেয়েছিলাম। তবে সবগুলো ব্রিজ নয়, কোনোটা সাধারণ কালভার্ট, কোনোটা লোহার গাটার, কোনোটা পাইপ কালভার্ট।' সেদিন সকাল ৭টায় বেরিয়ে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করেছিলেন রাজুরা। ব্রিজ দিয়ে ট্রলি চালাতে হুঁশিয়ার থাকতে হয় খুব। একবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ট্রলি ওঠাতে হয়েছিল রাজুদের। রাজু বলছিলেন, লাইন ক্লিয়ার না থাকলে এই সেতুতে ট্রলি ওঠানো ঠিক হয় না; যদিও ট্রলি নামিয়ে রাখার মতো জায়গা আছে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর।
গরমে লোহা বাড়ে, শীতে কমে
রাজু পূর্বাঞ্চলীয় রেলে যুক্ত হন ২০১৬ সালে। মোটর ট্রলিতে ডিউটি করার সুযোগ পান। মোটর ট্রলি সাধারণত সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে থাকে। প্রধান কারণ তার কর্মক্ষেত্র দীর্ঘ ও বিস্তৃত। একেকটি মোটর ট্রলিতে ১১ জনও চড়েন; প্রকৌশলী এবং ট্রলিম্যান ছাড়া আরও থাকতে পারেন কিম্যান, রাজমিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিশিয়ান, খালাসি প্রমুখ। গরমকালে প্রচণ্ড তাপে রেললাইনে গোলাই বা কার্ভ তৈরি হয়।
রাজু বলছিলেন, যদি বাইরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি হয়, রেললাইনে লোহা, পাথর ইত্যাদির প্রভাবে তা দাঁড়ায় ৪৫-৪৭ ডিগ্রিতে। তাপে লোহা বাড়ে তাই প্রসারণের জায়গা না পেয়ে বেঁকে যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আবার রেললাইন সংকুচিত হয়। তখন দুটি লোহার বার যেখানে নাট-বল্টু দিয়ে যুক্ত থাকে তা ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এছাড়া বর্ষায় স্লিপারের মাঝে কাঁদা জমে যেতে পারে। প্রবল বর্ষায় স্লিপারের নিচের মাটি ধসে গিয়ে পাথরও সরে যেতে পারে। দৈত্যের মতো রেলগাড়ির ভার ছড়িয়ে দিতে পাথর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই পাথর ছড়িয়েছিটিয়ে গেলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ওই সব ব্যাপারই নিয়মিত নজরদারিতে রাখা লাগে। তাই প্রকৌশল বিভাগের নিয়মিত টহলে বের হওয়া লাগে; আর টহল মানেই ট্রলিম্যান।'
সাধারণত গোলাই বা কার্ভ তৈরি হলে পানি ঢেলে বা পিটিয়ে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। লাইন সংকুচিত হলে টি-সিস্টেম ব্যবহার করে ফাঁক পূরণ করা হয়। আর মাটি সরে গেলে আশপাশ থেকে মাটি এনে ভরাট করা হয়।
মোটর ট্রলির ভার বেশি
পুশ ট্রলির চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ওজনের হয়ে থাকে মোটর ট্রলি। এটি পুরোটাই লোহায় নির্মিত। যখন বের হয়, তিন চারদিন পথেই থাকে। এটিও ভাগ ভাগ করে খুলে সরিয়ে রাখা যায়। আবার লোকাল ট্রেনে চাপিয়ে নির্দিষ্ট স্টেশনে নিয়ে যাওয়াও যায়।
রাজু বলছিলেন, হরতাল-অবরোধ ট্রলিম্যানদের দুঃখের কাল। তখন মেরামতির চেয়ে টহল দেওয়ার কাজ হয় বেশি আর তা করতে হয় রাতের বেলায়, বিশেষত জঙ্গুলে জায়গায়। ভাওয়াল-মধুপুর গড় এলাকা এবং শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ভানুগাছ পথে বসতি অনেক দূরে দূরে। ময়মনসিংহ-নেত্রকোণার বিল এলাকায়ও মাইলের পর মাইল নিরিবিলি। দুষ্কৃতকারীরা এসব জায়গাতেই ওৎ পেতে থাকে এবং লাইন উপড়ে ফেলে। তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০১৪ সালে ভাওয়াল এলাকায়। দুর্ঘটনার পর এক বা একাধিক রিলিফ বা রেসকিউ ট্রেন রওনা হয় ঘটনাস্থলে। সেসব ট্রেনের বগিগুলোয় উদ্ধার উপযোগী মালপত্র এবং ট্রলিম্যানরাও স্থান করে নেয়। দুর্ঘটনা ঘটলে রেললাইন এলোমেলো হয়ে যায়। তাই ট্রলিম্যান ও মিস্ত্রিদের ব্যস্ততা বাড়ে।
আবার রাজু পথে নামবেন
প্রথম প্রথম রাজুর কাজটি বেশি ভালো লাগত না; বিশেষ করে পরিশ্রম বেশি হতো বলে। রাজুর বাবাও ছিলেন ট্রলিম্যান। ২০০০ সালে তারা দক্ষিণ সাজাহানপুরের রেল স্টাফ কলোনিতে থাকতে শুরু করেন। রাজুর বয়স এখন বত্রিশ। বিশ বছর বয়সে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কলোনিতেই তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। কলোনির মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন। কাজে যোগ দেওয়ার বেশ কিছু কাল পরে তিনি মানিয়ে নিয়েছেন। ততদিনে বুঝেছেন, এটি একটি সেবামূলক কাজ। তার পরিশ্রমের ফলে অনেক যাত্রী নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারে জেনে তিনি আনন্দ অনুভব করেছেন। এ কাজে ঝুঁকি আছে, খাওয়ার সময়ের ঠিক নেই, পথে থাকা অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে তিন-চারদিনও দেখা হয় না। তবু মানুষের জন্য কিছু করতে পারছেন ভাবলেই কষ্ট দূর হয়ে যায়। তখন কাজটি তার কাছে চাকুরির চেয়ে বেশি কিছু।
পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এখন বিশ্রামে আছেন রাজু। আরও কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, রেলপথ ঠিক রাখতে ছুটবেন ভৈরব, শায়েস্তাগঞ্জ বা ভানুগাছ।