শস্য নিয়ে বিরোধের জেরে ইউক্রেনকে আর অস্ত্র না দেওয়ার ঘোষণা পোল্যান্ডের
রাশিয়ার সাথে চলমান যুদ্ধে প্রথম থেকেই ইউক্রেনের বেশ বিশ্বস্ত প্রতিবেশী ছিল পোল্যান্ড। তারই অংশ হিসেবে এতদিন দেশটি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবারাহ করেছে কিয়েভকে। খবর বিবিসি।
তবে সম্প্রতি ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিয়েভকে আর অস্ত্র সরবারাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোল্যান্ড।
গত বুধবার রাতে পোল্যান্ডের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল পোলস্যাট নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি বলেন, "আমরা আর ইউক্রেনে অস্ত্র স্থানান্তর করছি না। কারণ, আমরা এখন পোল্যান্ডকে আরও আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করছি।"
যদিও পরবর্তীতে পোল্যান্ড প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা জানান, প্রধানমন্ত্রী মাতেউসের বক্তব্য যতটা ভুলভাবে সম্ভব ততটা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোনো অস্ত্রই সরবারাহ করা হবে না; এমন তথ্য সঠিক নয়। শুধু নতুনভাবে অস্ত্র সরবারাহ করা হবে না।
যুদ্ধে সহযোগিতার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ৩২০ টি সোভিয়েত যুগের ট্যাংক ও ১৪ টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সরবারাহ করেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, কিয়েভকে নতুন করে অস্ত্র সহযোগিতা করার মতো খুব অল্প রসদই আছে পোল্যান্ডের কাছে।
পোল্যান্ড তার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ওয়ারশ ও কিয়েভের মধ্যে উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। এমতবস্থায় গত মঙ্গলবার ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলাদেমির জেলেনস্কি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে পরোক্ষভাবে এমন নীতির তীব্র সমালোচনা করেন।
জেলেনস্কি অভিযোগ করে বলেন, শস্য রপ্তানি ইস্যুতে ইউরোপের কিছু দেশ এমন অবস্থান নিয়েছে, যা বাস্তবিক অর্থে রাশিয়াকেই সহায়তা করছে। তারা 'রাজনৈতিক মঞ্চে শস্য নিয়ে একটি রোমাঞ্চকর নাটক তৈরি করেছে'।
জেলেনস্কির কড়া ভাষায় কড়া এ মন্তব্য অবশ্য খুব ভালো চোখে দেখেনি পোল্যান্ড। শস্য ইস্যুতে জেলেনস্কির এ অভিযোগের নিন্দা জানিয়েছে ওয়ারশ।
একইসাথে পোল্যান্ডকে অভিযুক্ত করায় দেশটি গত মঙ্গলবার ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। ওয়ারশ বলেছে, "পোল্যান্ডকে নিয়ে ইউক্রেন অযৌক্তিক মন্তব্য করেছে যারা কি-না যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে ইউক্রেনকে সমর্থন করে আসছে।"
ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবারাহের কারণে পোল্যান্ডের সামরিক মজুদ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। এমতবস্থায় ওয়ারশ আধুনিক পশ্চিমা কিট দিয়ে নিজেদেরকে আপডেট করার চেষ্টা করছে।
তবে পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবারাহ এখনই থেমে যাচ্ছে না। ওয়ারশ মুখপাত্র পিওটার মুলার জানান, পূর্বে চুক্তি করা অস্ত্রগুলো ঠিকই সরবারাহ করা হবে।
স্থানীয় কৃষকদের রক্ষায় গত মে মাসে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়ায় ইউক্রেনের শস্য আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা গত ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। তবে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া এই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ইউক্রেনের সাথে বিরোধ চরমে পৌছায়।
আর তারই ধারাবাহিকতায় ইউক্রেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় দেশ তিনটির নিষেধাজ্ঞা প্রদানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কিয়েভের দাবি, এই নিষেধাজ্ঞা প্রদান আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া স্ভিরিডেনকো বলেন, "এটি আমাদের জন্য প্রমাণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, একটি সদস্য রাষ্ট্র ইউক্রেনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারে না।"
বিবিসির সূত্রে জানা যায়, নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কিয়েভ স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে মামলা উঠিয়ে নিয়েছে। একইসাথে আগামী মাসে দুই দেশের মধ্যকার শস্য আমদানি-রফতানির লাইসেন্স প্রক্রিয়া নিয়েও কাজ করা হবে।
তবে পোল্যান্ড নিজেদের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তে অনড়। ওয়ারশ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে অভিযোগের ফলে দেশটি নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না।
উল্টো পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি বলেন, "আমি ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করছি। কারণ, তারা যদি এভাবে বিরোধ বাড়াতে চায়, আমরা পোল্যান্ড থেকে আমদানির নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরও পণ্য যুক্ত করব। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছে না যে পোল্যান্ডের কৃষি খাতকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। আমরা পোলিশ কৃষকদের রক্ষা করছি।"
মূলত কৃষ্ণসাগরের রাস্তা দিয়ে ইউক্রেন বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আফ্রিকায় পাঠাতো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই রাস্তা অবরুদ্ধ হয়। সে সময় থেকেই ইউরোপে খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু করে ইউক্রেন।
পরে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি হয়। ইউরোপের রাস্তা দিয়ে খাদ্যশস্য সরবরাহ শুরু করে ইউক্রেন। তখনো পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বহু দেশ ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য কিনতে থাকে। কিন্তু এতে ট্রানজিট আমদানি করা ঐ দেশগুলোর কৃষকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
যদিও গতকাল (বৃহস্পতিবার) পোল্যান্ডের কৃষিমন্ত্রী রবার্ট তেলাস ইউক্রেনের কৃষিমন্ত্রী মাইকোলা সোলস্কির সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। পরবর্তীতে কিয়েভের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে সমাধান বের করার উদ্দেশ্যে দেশ দুটি সম্মত হয়েছে।
নিজ দেশের বাজারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করলেও পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ইউক্রেনকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করছে। অর্থাৎ, দেশ তিনটি ব্যবহার করে কিয়েভ অন্য দেশগুলোতে পণ্য পরিবহন করতে পারবে ইউক্রেন।
এতদিন অস্ত্র সরবারাহ ছাড়াও ইউক্রেনকে সার্বিকভাবেও নানাভাবে সাহায্য করেছে পোল্যান্ড। কিয়েভের পক্ষে অন্য দেশের সহযোগিতা আদায় ছাড়াও পোল্যান্ড ইউক্রেনের প্রায় ১৫ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।