তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য, পর্যটকদের ভীড়
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা পঞ্চগড় জেলা থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর তৃত্বীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা।
চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য মেলে ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রকৃতিপ্রেমি ভ্রমণপিপাসুদের দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। কুয়াশা বিহীন মেঘমুক্ত নীলাকাশে অক্টোবরের শেষ সময় থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। গত কদিন ধরে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী রুপলাবন্য।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় মনোমুগ্ধকর শোভা উপভোগ করতে হাজারো ভ্রমন পিপাসু প্রকৃতিপেমী পর্যটকরা আসছেন পঞ্চগড়ে। হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকরা। পর্যটকদের নির্বিঘ্ন ভ্রমণে নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।
পঞ্চগড় জেলার পশ্চিম উত্তর কোণে শুভ্র সাদা মেঘের পিরামিডটিই কাঞ্চনজঙ্ঘা। গত কদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজন নিয়ে পর্যটকরা আসছেন পঞ্চগড়ে। স্পষ্টভাবে খালি চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য দেখেছেন পর্যটকরা।
পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতের সিকিম ও নেপাল জুড়ে অবস্থিত হলেও আকাশ পথে কম দূরত্বের কারণে ৮,৫৮৬ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন কাঞ্চনজঙ্ঘা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার পর পরই সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুক, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও একাধিক গ্রুপে ছবি ও ভিডিও আপলোড হতে থাকে। ফেসবুকে নানান গল্প স্মৃতি নিয়ে দুর্লভ ছবি দিয়ে পোস্ট করেন অনেকেই। এরপর থেকে পর্যটকদের ঢল নামে তেঁতুলিয়ায়।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রথমে কালচে এরপর লালচে হয়ে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এরপর সকাল হতে না হতেই সফেদ সাদায় রুপ নেয়। দুপুরের পর কোন কোন সময় তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। তবে শেষ বিকেলে গোধূলীর আলোয় লালচে রূপ ধারণ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যা সন্ধ্যা অবধি দেখা যায়।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার সময়গুলোতে তেঁতুলিয়ায় নানা শ্রেণী পেশার মানুষের মিলন মেলা বসে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। মহানন্দা নদীর পাড়ে বসে থাকা, কারো সেলফি তোলা, ভিডিও করা, পর্যটকদের যত্রতত্র হাঁটাচলা, মহানন্দা নদী থেকে শত শত মানুষের পাথর উত্তোলনের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার উৎসব চলছে।
তবে আবাসন সংকট, সন্ধ্যার পর পাবলিক বাহন বিশেষ করে বাস চলাচল না থাকাসহ পর্যটন কেন্দ্রিক সুযোগ সুবিধা গড়ে না উঠায় অনেক পর্যটককে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তেঁতুলিয়ার বাসিন্দা শামীম রেজা বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার সংবাদ ফেসবুকে পেয়েই পর্যটকরা বিশেষ করে রাইডাররা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি তেঁতুলিয়ায় আসতে শুরু করেন। রিকশা-ভ্যানের পাশাপাশি এখানে কার, মাইক্রো, বাসে করেও পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসছেন।
"কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। যা জেলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।"
তেঁতুলিয়া সদরের অটো ভ্যান চালক সাইদুল বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার এই মৌসুমে শত শত মানুষ এখানে আসে। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি তারা দলবেঁধে চা বাগান, রওশনপুরের আনন্দ ধারা, জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখতে যান।
"এ সময়টাতে আমাদের ভালো আয় হয়। অনেকে ভাড়ার পাশাপাশি বখশিশও দেয়।"
ডাকবাংলোর পাশের শেখ ফরিদ ও হাবিব নামে দুজন দোকানদার বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার মৌসুমে প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। এসময় বেচা বিক্রিও বেড়ে যায়। বিশেষ করে আবাসিক হোটেল খাওয়ার হোটেল, পান সিগারেটের দোকান, ছোট ছোট খাওয়ার দোকান, বিভিন্ন যানবাহন চালকসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয় বেড়ে যায়।
জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার হাবিব ও শাহীন জানান, ডাকবাংলোগুলো আগাম বুকিং হয়েছে। আবাসিক হোটেলগুলোতেও কোন সিট খালি নেই। পর্যটকদের যে পরিমাণ চাহিদা সে পরিমাণ আসন এখানে নেই। অনেকে তেঁতুলিয়ায় রাত্রিযাপন করতে না পেরে পঞ্চগড় শহরে চলে যাচ্ছেন।
কুমিল্লা থেকে আসা মিজানুর রহমান বলেন, প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল, সান্দাকফুু বা ফালুটে যান। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যাদের পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা নেই তারা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পান।
রংপুর থেকে আসা মোতালেব ইসলাম বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ রুপ না আসলে বলে বোঝানো যাবে না। অনেকে একাধিকবার এসেও দেখতে পায় না। আমরা এসেই দেখতে পেরেছি এটা আমাদের সৌভাগ্য।
ঠাকুরগাঁও থেকে আসা নজমুল হুদা শাহ অ্যাপোলো বলেন, মাঝে মাঝে ভারতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। তবে মনোরম ও প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার বিষয়টি অন্যরকম।
"এত ক্লিয়ার ও সুন্দর ভিউ দেখতে অনেক আনন্দের। পর্যটন কেন্ত্র হিসেবে তেঁতুলিয়ায় যদি আরও কিছু স্থাপনা সংযোজিত হয় তাহলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তেঁতুলিয়া বাংলাদেশের বুকে স্থান করে নিবে।"
ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই পর্যটকরা তেঁতুলিয়ায় আসেন। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও শীতকালে এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করে যাচ্ছি। যে কোন সমস্যায় পর্যটকরা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতা পাবেন।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ্ বলেন, আবহাওয়া অনূকুল থাকলে মেঘ বা কুয়াশামুক্ত আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধ রুপ স্পষ্ট দেখা যায়। এবার সেপ্টেম্বরে মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিয়েছিল।
"অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিস্কারভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার সাপেক্ষে নভেম্বর পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা তার রুপলাবন্য পর্যটকদের জন্য মেলে ধরবে।"
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে পঞ্চগড় জেলার সর্বত্রই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তবে তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীর পাড়, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, মাগুরমারী বিজিবি ক্যাম্পের সামনে, তেঁতুলিয়া থানার পেছন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভালোভাবে উপভোগ করা যায়।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সরকারি ডাকবাংলোর পাশাপাশি বেসকারি উদ্যোগে এবং বিভিন্ন এনজিওর হোটেল মোটেল রয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের জন্য এখানে কমিউনিটি ট্যুরিজম চালু রয়েছে। এখানকার যে কোন ফ্যামিলির সাথে ট্যুরিস্টরা এসে মিশে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য উপভোগ করে।
"এই সময়টাতে এখানকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আয়ের খাত তৈরি হয়। যেটি পঞ্চগড়ের অর্থনীতিতে দিনের পর দিন লাভবান করছে।"
কাঞ্চনজঙ্ঘা পঞ্চগড়ের পর্যটনের জন্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের কারণে স্থানীয়রা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছে। শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকে অনুভব করার উপভোগ্য ভ্রমনের একটি উৎকৃষ্ট জায়গা হতে পারে পঞ্চগড়।