যে রাতে আমরা বড় হয়ে উঠেছিলাম
১৯৭১ এর সেই রাতটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার একটা রাত। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলি ভুট্টো, পাকিস্তানের কসাই টিক্কা খান । শুধু 'মুসলিম ভাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে' এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা থেকে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, জন্মের সেই ধারণার সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
সেই রাত আমাদের শিখিয়েছিল এইসব ধারণা ভুল এবং ২৪ বছরের এই ধারণা, তাসের ঘরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশ ভেঙে পড়েছে ।
সেই রাত আগুন দিয়ে বিশ্বাসঘাতক কষাইদের নাম খোদাই করে দিয়েছে আমাদের স্নায়ুকোষে। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান; প্রেসিডেন্ট অব দ্য পিপলস পার্টি অব পাকিস্তান (পিপিপি) জুলফিকার আলি ভুট্টো; বেলুচিস্তানের কসাই বলে পরিচিত পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার এবং পরে গভর্নর টিক্কা খান; লেফ. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী, কমান্ডার অব দ্য ইস্টার্ন কমান্ড; মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ৫৭ ডিভিশনের জিওসি; মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, ১৪ ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং এবং তাদের কিছু বাঙালি সহযোগী, যারা নিজেদের চিন্তায় পাকিস্তানি ভাবতেন।
এই নামগুলো স্মরণে রাখি। স্মরণে রাখি এজন্য যে, তারাই সেইসব ব্যক্তি যারা চেয়েছিল বাংলাদেশের সবুজ ভূমিকে বাঙালির রক্ত দিয়ে লাল করে দিতে। তারা সেইসব লোক, যারা পরিকল্পনা করেছিল ঘুমন্ত ও অস্ত্রহীন বাঙালির ওপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে গণহত্যা চালাবে। ২৫ মার্চ রাতের বাংলাদেশের ওপর এই নৃশংস পরিকল্পনা 'অপারেশন সার্চলাইট' ছিল বিশেষ করে রাও ফরমান আলী এবং খাদিম হোসেন রাজার ছক কাটা।
১৯৭১ সালের মার্চ জুড়ে আমরা অস্থির ছিলাম। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে যে, আমরা, বাঙালিরা, আমাদের নিজেদের জন্য একটা ভিন্ন ভবিষ্যৎ চাই। পাঞ্জাবি শাসকেরা যেভাবে চাইছে, সেভাবে নয়। এই 'পাঞ্জাবি' শব্দটাই ছিল আমাদের কাছে শোষণ ও পরিহাস বা তামাশার নাম।
মার্চের ৩ তারিখের নির্ধারিত জেনারেল এসেম্বলি অধিবেশন যখন ইয়াহিয়া খান একদিন আগে বাতিল করে দিলেন, তখন আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে এসেছিলাম, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলাম, লাখ লাখ মানুষ আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে ঐক্য প্রকাশ করেছিল, আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিল।
আমরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলাম। যা আইনসঙ্গতভাবে আমাদের প্রাপ্য, সেটা না পাওয়ায় আমরা প্রবঞ্চিতবোধ করছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শান্ত। তিনি তার জনগণকে আত্মপ্রতিজ্ঞ করেছিলেন এবং ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার কথাও শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যার যা কিছু হাতিয়ার আছে, তাই নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং প্রয়োজনে আত্মত্যাগ করতে। কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন-- আমরা স্বাধীনতা পাবই, একটি স্বদেশ পাব এবং এর নাম হবে আমাদের নিজেদের ভাষা, অর্থাৎ বাংলায়। সেইসঙ্গে পাব একটি নতুন পতাকা, যেখানে লেখা থাকবে আমাদের স্বপ্নের কথা। স্বাধীনতার দিক থেকে ঠিক এইটাই বাঙালিরা চাইছিল।
তবে যা আমরা জানতাম না, তা হচ্ছে-- পাকিস্তানিরা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেছিল, আমাদের অধিকার অস্বীকার করার। তারা পরিকল্পনা করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সংলাপের একটি মিথ্যা নাটক করার। ঠিক অন্যদিকে তাদের সমরাস্ত্র সজ্জিত সামরিক বাহিনী খুব সতর্কতার সঙ্গে কঠিন শাস্তির পরিকল্পনা করেছিল, যেন উদ্ধত 'বিশ্বাসঘাতক' বাঙালিকে এমন শিক্ষা দেওয়া যায়, যা তারা জীবনেও ভুলবে না।
কিন্তু তারা ছিল ভুল; ভয়ঙ্করভাবে ভুল চিন্তা করেছিল। আমরা নয় মাসে তাদের ভুল প্রমাণ করেছিলাম, ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে। তারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় মেনে নিয়েছিল, বিকেল ৪টার সময়, রেসকোর্স ময়দানে। ঠিক যেখান থেকে ৯ মাস আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
কিন্তু এগুলো সবই এসেছিল অনেক পরে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং পিপিপি-এর প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে পৌঁছান ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কথা বলতে। প্রতিদিনই শহরের কেন্দ্র রমনায় অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ভবনের সবুজ চত্বরে বৈঠক হতে থাকল। বঙ্গবন্ধু সেখানে সকালে এসে পৌঁছলেন। সারাদিন কথা চলল। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে দুপুরের পর তার সহযোগীদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আর ভুট্টো নিজেকে খুব কাছেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সুইটে আরাম করতে ঢুকে গেলেন।
এদিকে এই ছলচাতুরিময় সংলাপকে সামনে রেখে পেছন দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা এবং যুদ্ধাস্ত্র পিআই-এর বিমানে করে আনা হচ্ছিল পরবর্তীকালে বাঙালি নিধন করার জন্য।
আমরা কানাঘুষা শুনতে পেলাম এমন একজনের থেকে, যার পরিচিত একজন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পিআইএতে কাজ করতেন। তিনি দেখেছেন, গভীর রাতে অসংখ্য মানুষ, অস্বাভাবিকভাবে পিআই-এর বিমান থেকে নামছে। যদিও তারা বেসামরিক পোশাক পরা ছিল; কিন্তু তারা আসলে বেসামরিক লোক ছিল না। তাদের কাছে বড় বড় বাক্স ও পিঠে শক্ত কাপড়ের ব্যাগ ছিল, যা সাধারণত সেসময় বেসামরিক লোকজন ব্যবহার করত না। তাদেরকে সামরিক বাহিনীর গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
চারদিকে একটা ফিসফাস চলছিল-- পাকিস্তানিরা গণহত্যার পরিকল্পনা করছে; কারণ বাঙালিদের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল না। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু এটা জানতেন। কারণ বাংলাদেশ ৭ মার্চের পর থেকে তার কথা অনুযায়ীই চলছে। তিনিই আমাদের নেতা এবং তিনিই জানবেন।
তবে আমরা এও নিশ্চিত ছিলাম, সঠিক সময়ে আমাদের কী করতে হবে, এটাও উনিই আমাদের জানাবেন। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক হামলা প্রতিরোধ করার জন্য ডামি রাইফেল দিয়ে অনুশীলন করে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু আমরা জানতাম, আমরা অমিত শক্তিশালী এই স্বঘোষিত বিশ্বের সেরা যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে পারব না।
সেই খাকি পোশাকে সজ্জিত সেনাদের হাতে ছিল পোড়ামাটি রঙা অস্ত্র, মাথায় জলপাই সবুজ হেলমেট, জলপাই সবুজ বেডফোর্ড ট্রাকে সমরাস্ত্র ভর্তি অনেক বাক্স এবং তাদের ভিনদেশি চোখের কঠোর চাহনি আমাদের মধ্যে বিরক্তি ও বীতস্পৃহা তৈরি করেছিল। কিন্তু তাও আমরা জানতাম, 'খান সেনাদের' বিরুদ্ধে, যারা ১ হাজার মাইল দূর থেকে শুধু আমাদের হত্যা করতে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াব।
২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চলছিলই। সন্ধ্যার দিকে শহরে গুজব ছড়াতে শুরু করল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে। ভুট্টোও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তার সুইটে ফিরে গিয়েছেন।
যাহোক, যারা সবসময় মিছিলের সামনে থাকে, যারা পিকেটিং করে, পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় যুদ্ধ করে, তারা যেন কীভাবে বুঝে গিয়েছিল-- সময় এসে গেছে।
আমরা যখন রাতের খাবার খেতে ৯টার দিকে ডাইনিং টেবিলে বসেছি, তখনই আমার বড় ভাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ভয়াবহ একটা খবরটা দিলেন। তিনি জানালেন, আশেপাশের সব কিশোর-তরুণ ফার্মগেটে জড়ো হয়েছে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য। কারণ তারা আশঙ্কা করছে, পাকিস্তানি সেনারা আজ রাতেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়বে সারা শহরে তাদের ক্রোধোন্মত্ত তাণ্ডব চালানোর জন্য। এত বছর পরও আমি আজো বুঝতে পারিনি, এই ছেলেগুলো কীভাবে সেই খবর জানতে পেরেছিল।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের এই ধারণা সত্যে পরিণত হলো।
আমি আর আমার ছোট ভাই মিঠু দৌড়ে গেলাম কী হচ্ছে দেখার জন্য। যা আমরা দেখলাম, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ফার্মগেটে তখন অনেক বড় বড় গাছ ছিল। প্রায় শতবর্ষ বয়সী কর্পুর, দারুচিনি গাছ, দেবদারু ও তাল গাছ ছিল। স্থানীয় ছেলেপেলেরা কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই গাছগুলো কেটে ফার্মগেট ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দিলো।
সেখানে তারা ঠেলাগাড়ি উল্টে রাখল, তেলের ড্রাম, আলকাতরার ড্রাম দিয়ে সেনাদের চলার পথে ব্যারিকেড দিয়ে রাখল। সেইরাতেই অসংখ্য মানুষ এসে ভিড় করেছে। এই মুখগুলোকে আমরা চিনি। এরাই সব যুদ্ধের সামনে থাকে। আবার কিছু অপরিচিত মুখও দেখলাম। তবে তাদের সবারই চোখে-মুখে অসম্ভব দৃঢ়তা ছিল। তাদের শক্ত চোয়াল, তাদের ঘর্মাক্ত চকচকে চেহারা সেই মৃদু আলোতেও দেখা যাচ্ছিল। আমরা যেন তখন তৈরি মরণপণ যুদ্ধের জন্য।
মিঠু এবং আমি, যাদের সঙ্গে আমাদের লড়াই হবে, সেই সামরিক বাহিনীর শক্তি ও ব্যাপকতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমরা আমাদের শিরায় শিরায় সেই উত্তেজনা অনুভব করছিলাম-- কোথাও না থেমেই ১০০ মাইল দৌড়ে যেতে পারব। আমরা জানতাম সেই কৈশোরই আমাদের জন্য প্রকৃত সময়।
এদিকে বাসায় কাউকে না জানিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য আব্বা আম্মা ব্যাপক বকাবকি করছেন। তবে মিঠুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হয়েছে। কারণ ও তখন শিশু এবং আমরা গুলিও খেতে পারতাম। তবে সেইসময় সেখানে কোনো সেনা বা প্যারামিলিটারি ছিল না। ফলে সেসময় সেই চত্বরটা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। আমরাই সেই রাতে ঐ জায়গাটা দখল করেছিলাম।
আমার বড় ভাই শহীদ ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানীদের ঠেকাতে পারা সম্পর্কে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি সাধারণত অনেক রাত অব্দি পড়াশোনা করতেন, এমনকি আমরা বিছানায় যাওয়ার পরও। তিনি জানালেন, তিনি দেখেছেন গভীর রাতে মার্কিন নির্মিত এম-২৪ চ্যাফি ট্যাংকের বহর ফার্মগেট দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাসাটি ছিল ইন্দিরা রোডের একেবারে শেষ মাথায়, সেখান থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূর দিয়ে ট্যাংকগুলো চলেছে। তাদের জোরাল ঘরঘর শব্দ এবং সেগুলোর ডিজেল চালিত কাডিল্যাক ইঞ্জিনের ডিজেলের গন্ধ মেশানো কালো ধোঁয়া তাকে পড়ার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি ভেতর থেকে চুপিচুপি দেখেছেন, পাঁচটি ট্যাংক সেই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। যদিও রাস্তার সেই মৃদু আলোতে সেই জলপাই রঙা ট্যাংকগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি ধারণা করেছিলেন, এত গভীর রাতে ট্যাংক চলাচল করাটা খুব অশুভ লক্ষণ। তার সেই ধারণা সেই রাতেই সত্যে পরিণত হয়েছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত রাত ১১টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর সেই দুর্বল ব্যারিকেড সরিয়ে দিয়ে পরে শহরে অভিযান চালিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করার জন্য পরে আরও ট্যাংক বের করা হয়েছিল।
তখনকার মতো আমরা ক্লান্ত হয়ে শুতে গেলাম এবং পরদিন ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম ।
আমি ঠিক বলতে পারব না তখন রাত কয়টা বাজে; কিন্তু আমার ঘুম ভাঙল আমার ছোট বোনের ঝাঁকুনিতে। আমি যখন জেগে উঠলাম, তখন চারদিকে শুধু গোলাগুলি আর মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড বোমার শব্দ। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। আমার বোন বলল, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। আসলে শুরু হয়েছিল সেই কুখ্যাত 'অপারেশন সার্চলাইট'-- এই কোড নামটা আমরা অনেক পরে জেনেছিলাম।
আমাদের বাসাটা রাস্তার ঠিক পাশেই ছিল। আব্বা আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বললেন। তীক্ষ্ণ ও অবিরত গুলির শব্দ, অটোম্যাটিক অস্ত্রের অনর্গল গুলির শব্দ এবং বোমার শব্দ আমাদের কানে তালা ধরিয়ে দিলো। কোনদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে, সেদিকটা আব্বা ধারণা করে বললেন, পিলখানা আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মূল হামলাটা চালানো হয়েছে। আব্বা ঠিকই বলেছিলেন। পিলখানার ইপিআর স্টেশন এবং রাজারবাগের পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ সদর দফতর প্রথম হামলার জায়গা ছিল; কারণ এখান থেকেই প্রথম প্রতিরোধ এসেছিল।
আমরা দেখলাম, উজ্জ্বল কমলা রঙের আলো রাজারবাগের ওপর। সেই রাতে আগুনের ছটায় চারদিক এমন উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, পাকিস্তানিরা যেন স্পষ্টভাবে দেখে দেখে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সামরিক নেতারা তাদের সেকেন্ড ক্যাপিট্যালের (এখনকার সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেল) সুদৃশ্য লনে সোফায় আর আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে চা কফি পান করতে করতে সেই অপারেশন প্রত্যক্ষ করছিল।
আমরা পরে আইএসপিআর মেজর সিদ্দিক সালেকের 'উয়েটনেস টু সারেন্ডার' বই থেকে জানতে পেরেছি, রাত ১১ টার দিকে ঢাকার কমান্ডার আগানোর জন্য অনুমতি চেয়েছিল-- সবাই তাদের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেক যুদ্ধাস্ত্র, ব্যাপক সেনা-সরঞ্জাম, বিস্ময়, প্রতারণা এবং প্রচণ্ড গতি নিয়ে 'দ্য অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলো। অন্যভাবে বলা যায়, নরকের দরজা খুলে দেওয়া হলো।
অপারেশনটা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে। ওয়ারলেসে ওদের বার্তাটি ছিল এমন-- 'বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ'।
সালেক খুব বেদনাদায়কভাবে সেই রাতকে বর্ণনা করেছেন, 'ঢাকা শহরে একটি গৃহযুদ্ধের তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। আমি বারান্দা থেকে চার ঘণ্টা ধরে সেই দৃশ্য দেখেছিলাম। সেই রক্তাপ্লুত রাতের সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল আকাশজুড়ে বন্দুক থেকে ছোড়া আগুনের হলকা। সে সময় প্রথমদিকে কিছু আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে কিছু দুখী মেঘকে দেখা গেলেও, পরে তারা আগুনের তলে চাপা পড়ে যায়। চাঁদের আলো এবং তারাদের উজ্জ্বলতা ঢাকা পড়ে যায় মানুষের তৈরি প্রজ্জ্বলিত আগুনের কাছে। সবচেয়ে উঁচু কালো ধোঁয়াটি দেখা গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে।'
আমরা সারারাত আমাদের দুইরুমের দোতলা বাসাটাতে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলাম। যখনই একটি গাড়ির শব্দ শুনি, তখনই মনে করি এই বুঝি আমাদের সময় শেষ হয়ে এলো। একটি জিপ এসে দাঁড়াল আমাদের বাসার সামনে এবং গাড়ি থেকে আমাদের লম্বা বেলগাছটার দিকে ভারি মেশিনগানের দীর্ঘ একটা ব্রাশফায়ার করা হলো। গাছের পাতাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত এক শব্দে কেঁপে উঠল।
এরমধ্যেও আমরা পাশের এলাকার গলিমুখ থেকে বেশ কয়েকবার 'জয়বাংলা' স্লোগান শুনতে পেলাম। এরপর শুনতে পেলাম গুলির শব্দ এবং এরপর সব চুপ।
সকাল হয়ে গেল। আব্বা আর আম্মা নামাজ পড়ছেন। আমরা জানি না আমাদের পরবর্তী করণীয় কী। একটি ট্রাকে করে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলো। তারা আরও বলল সব বাসা থেকে বাংলাদেশি পতাকা নামিয়ে ফেলতে, যা মার্চের শুরু থেকে সব বাসাতেই উড়ছিল।
আমরা শুধু বুঝতে পারছিলাম একটি সময় শেষ হয়ে গেছে এবং একটি নতুন সময় শুরু হলো। এবং সেই মুহূর্তে আমরা এও জেনে গেলাম, আমরা আর শিশু নই; কারণ আমরা একটি যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এখনই সময় আমাদের বড় হয়ে ওঠার।