ফোনে আড়ি পাতা, স্যাবোটাজ এবং হত্যার পরিকল্পনা: জার্মানি কি ২য় স্নায়ুযুদ্ধে প্রবেশ করছে?
সেনা ঘাঁটির বেড়ায় রহস্যময়ভাবে ছিদ্র, জার্মানির প্রধান অস্ত্র নির্মাতাকে হত্যা করার কথিত ষড়যন্ত্র এবং লুফটওয়াফের উচ্চপর্যায়ের ফোন কলে আড়ি পাতা– এগুলো ১৯৬০-এর দশকের কোন গুপ্তচরবৃত্তির গল্প নয়, বরং এ বছর জার্মানিতে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা।
এই সব ঘটনার জন্য মস্কোর সরাসরি দায় দিতে না পারলেও, কিয়েভকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখায় বার্লিনের ওপর সম্ভাব্য রুশ স্যাবোটাজ ঠেকাতে জার্মানি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইউরোপ সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধে (কোল্ড ওয়ার) প্রবেশ করছে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) সিনিয়র ফেলো এবং মায়াক ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক মার্ক গ্যালিওটি বলেন, "আমরা যখন স্নায়ুযুদ্ধের কথা ভাবি তখন আমাদের মনে ১৯৭০-এর দশকের কথা আসে, যখন স্নায়ুযুদ্ধের নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠিত এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। কিছুটা হলেও আমরা ৫০ এবং ৬০ এর দশকের মতো স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। তাই সময়টা অনেক বেশি অস্থির।"
কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং একসময় আয়রন কার্টেন দিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত দেশের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ জন্য কেমন হতে পারে?
[আয়রন কার্টেন ছিল একটি রাজনৈতিক, সামরিক, এবং আদর্শিক বাধা, যেটি সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেকে এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপীয় মিত্রদের পশ্চিমা এবং অন্যান্য অ-কমিউনিস্ট অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য তৈরি করেছিল]
সবচেয়ে বড় চমক এসেছিল মাত্র গত মাসে যখন সিএনএন-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাশিয়া জার্মানির সবচেয়ে বড় অস্ত্র কোম্পানি রাইনমেটালের প্রধান নির্বাহীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এবং মার্কিন কর্মকর্তারা বার্লিনকে বিষয়টি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন।
ক্রেমলিন এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক রাশিয়াকে "হাইব্রিড আগ্রাসন যুদ্ধ" চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেন।
রাইনমেটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আর্মিন প্যাপারগার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে পুনরায় সরবরাহ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তা বাড়াতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করায় প্যাপারগারের গুরুত্ব অনেকে বেড়েছে।
তিনি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী বোরিস পিস্টোরিয়াস এবং ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে লোয়ার স্যাক্সনিতে একটি নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে অংশ নেওয়ার সময় প্যাপারগার বেশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন।
যদি তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র সফল হতো তাহলে এটি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি বড় ধাক্কা হত।
এর কিছুদিন পরই একটি নিরাপত্তা ভুলের কারণে গুপ্তচররা জার্মান বিমানবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যকার অত্যন্ত সংবেদনশীল কথোপকথনে আড়ি পাততে সক্ষম হয়, যা পরে রাশিয়ান টিভিতে সম্প্রচারিত হয়
এই ঘটনা বার্লিনের জন্য চরম লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লুফটওয়াফের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অসুরক্ষিত লাইনে কল করে গুপ্তচরদের কথোপকথনে আড়ি পাতার সুযোগ করে দেন।
এমন ঘটনায় গুপ্তচরবৃত্তি ঠেকানোর ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির দুর্বলতা অনেকটাই প্রকাশে এসেছে, যার জন্য দেশটির ভঙ্গুর ফেডারেল সিস্টেমকে [যা ব্যক্তির গোপনীয়তার ওপর জোর দেয়] দায়ী করা হয়।
কিছু সপ্তাহ পরে দুজন জার্মান-রুশ নাগরিককে বাভারিয়াতে মার্কিন সামরিক স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক রুশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে অভিযোগ করেন এবং ঘোষণা দেন, "আমরা পুতিনকে তার সন্ত্রাস জার্মানিতে আনতে দেবো না।"
কিছুদিন আগেই নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়ার দুটি সামরিক ঘাঁটিতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার বেড়ায় ছিদ্র পাওয়া যাওয়ায় কেউ পানির সরবরাহ দূষিত করার চেষ্টা করছে বলে সন্দেহ করা হয়।
জার্মানি একমাত্র দেশ নয় যেটি এই ধরনের নাশকতার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। তবে এটি অনেক মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কেন্দ্রস্থল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্থাপন করা হয়েছিল।
মার্ক গ্যালিওটি বিশ্বাস করেন, মস্কো জার্মানিকে একটি বড় কিন্তু "অবহেলিত" শক্তি হিসেবে দেখায় রাশিয়া জার্মানির ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে।
জার্মানিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বড় নাশকতার ঘটনা ছিল ২০২২ সালে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনের বিস্ফোরণ, যা বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে রাশিয়া থেকে এসেছে। কে এই হামলার নির্দেশ দিয়েছিল তা নিয়ে জল্পনা চলছেই। তবে একটি নাটকীয় ঘটনায় জার্মানি একজন ইউক্রেনীয় ডাইভিং প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
গত সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, এই অপারেশনটি পরিচালনা করতে বেসরকারিভাবে তহবিল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এটি ইউক্রেন থেকে পরিচালিত হয়েছিল। কিয়েভ এই রিপোর্টকে 'ননসেন্স' বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আবার প্রত্যেকটি নাশকতার ঘটনাকে সরাসরি রাশিয়ার সাথে যুক্ত করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে রুশ গুপ্তচরদের পরিবর্তে কট্টর বামপন্থিদের বিরুদ্ধে দেশের হাই-স্পিড রেল নেটওয়ার্ককে লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগ উঠেছে।
নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণের জন্য ইউক্রেনের বিভিন্ন ব্যক্তি এখন নজরদারির আওতায় আসায়, জার্মান সরকার থেকে কিয়েভের সমর্থন দেওয়া নিয়ে নতুন সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ডানপন্থি এএফডি দলের সহ-নেতা অ্যালিস ওয়াইডেল কিয়েভকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার পাশাপাশি নর্ড স্ট্রিমের আর্থিক ক্ষতি ইউক্রেনের কাছ থেকে আদায় করার দাবি জানিয়েছেন। এএফডি দলটি সাবেক কমিউনিস্টপন্থী পূর্ব জার্মানিতে বেশি সমর্থন পায়, যেখানে রাশিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং প্রধান দলগুলোর প্রতি অসন্তোষ বেশি দেখা যায়।
জার্মান সরকার নিরাপত্তা জোরদার করতে একটি নতুন আইন তৈরি করছে, যেটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর সুরক্ষা বাড়ানোর দিকে নজর দেবে। এ ব্যাপারে জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজা বলেছেন, "সর্বোচ্চ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা" থাকা উচিত।
রুশ ভূখণ্ডে অভিযান চালাতে জার্মানির তৈরি সাঁজোয়া মার্ডার যান ব্যবহার করছে ইউক্রেন।
যখন রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন চ্যান্সেলর শলৎজ জার্মানির প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নীতিতে একটি "টার্নিং পয়েন্ট" এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, বিশেষ করে জার্মানির অন্ধকার অতীতের কথা বিবেচনা করলে।
মার্ক গ্যালিওটি বলছেন, শুধু প্রতিরক্ষা পুনর্গঠন নয়, সাইবার নিরাপত্তা এবং গুপ্তচরবৃত্তি মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি।
তিনি বলেন, "নিরাপত্তা পরিকল্পনা সপ্তাহ বা মাস নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে করতে হয়।"