কেন রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে?
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/24/gl3rrtdwgamcujk.jpg)
গত মাসে রাশিয়ার একজন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি অধিদপ্তরের প্রধানকে আদালতে তোলা হয়। এ সপ্তাহে আরও দুই জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সবারই বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে, যদিও প্রত্যেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পঞ্চম মেয়াদ শুরুর পর গত এপ্রিলে সাবেক রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টিমুর ইভানভকে ঘুষের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর পরই মে মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে দীর্ঘদিনের মিত্র শোইগুকে সরিয়ে দেন পুতিন। পরে তার স্থলাভিষিক্ত হন অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলোসভকে। এরপর থেকেই একে একে গ্রেপ্তার শুরু হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পুতিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন কিনা, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছে কিনা, নাকি ক্রেমলিনে পর্দার আড়ালে অন্য কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই গ্রেপ্তারের পেছনের কারণ কি এবং কেন এসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে:
রাশিয়ায় দুর্নীতি কতটা গুরুতর রূপ নিয়েছে?
দেশটিতে দুর্নীতির কেলেঙ্কারি নতুন নয়। কয়েক দশক ধরে বার বার কর্মচারী ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের ডেমোক্র্যাটিক রেজিলিয়েন্সের পরিচালক স্যাম গ্রিন বলেন, রুশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি একই সঙ্গে বিপুল ঐশ্বর্য ও গলার ফাঁস। এটি 'আনুগত্য ধরে রাখা এবং সবাইকে এক সুতোয় বেধে রাখা' এবং সবার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি পদ্ধতি।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মার্ক গালিওত্তি সম্প্রতি এক পডকাস্টে বলেন, পুতিন চান প্রত্যেকের আলমারিতে একটি করে কঙ্কাল (দুর্নাম) থাকুক। সরকার যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অস্বস্তিকর কিছুর তথ্য পায়, যাতে মুহূর্তে তারা টার্গেটকে ধরতে পারে।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো নাইজেল গোল্ড-ডেভিস বলেন, দুর্নীতি হচ্ছে এই ব্যবস্থার মূল কথা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দুর্নীতির সুযোগ কিছুটা বেড়েছে মাত্র।
কাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী টিমুর ইভানভ গত এপ্রিলে গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/24/download-ezgif.com-webp-to-jpg-converter.jpg)
টিমুর ইভানভ সামরিক বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প তদারকি করতেন, তাই তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়েছিলেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে ইউক্রেনের ধ্বংসপ্রাপ্ত বন্দর নগরী মারিউপোলের কিছু অংশ পুনর্নির্মাণ অন্যতম।
প্রয়াত বিরোধী দলীয় নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনির দলের অভিযোগ, ৪৮ বছর বয়সী ইভানভ এবং তার পরিবার অভিজাত রিয়েল এস্টেটের মালিক। এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও বিলাসবহুল পার্টি এবং বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তারা।
তাদের আরও অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞা এড়াতে এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন চালিয়ে যেতে ২০২২ সালে ইভানভের স্ত্রী সভেতলানা তাকে ডিভোর্স দেন।
যদিও পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বৃহস্পতিবার বলেছেন, 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এটা কোনো অভিযান নয়। এটা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমের একটি অংশ।'
গত এপ্রিলে রাশিয়ার শীর্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি তদন্ত কমিটি জানায়, বড় অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার সন্দেহে ইভানভকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে তার।
তারপর থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। এর মধ্যে রয়েছে: প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি পরিদপ্তরের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইউরি কুজনেটসভ, ইউক্রেনের সাবেক শীর্ষ কমান্ডার মেজর জেনারেল ইভান পোপোভ এবং রুশ সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম শামারিন। জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের উপপ্রধান ছিলেন শামারিন।
বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্ট বিভাগের প্রধান ভ্লাদিমির ভার্টেলেটস্কিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ভ্লাদিমির ভার্টেলেটস্কির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। যে কারণে ৭০ মিলিয়ন রুবেল (প্রায় ৭ লাখ ৭৬ হাজার ডলার) ক্ষতি হয়েছে।
রুশ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, মস্কোর ফেডারেল কারা বিভাগের উপপ্রধান ভ্লাদিমির তেলায়েভকে বৃহস্পতিবার বড় আকারের ঘুষের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এখন কেন এসব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার হচ্ছে?
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের রুশ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ রিচার্ড কনোলি বলেন, এই গ্রেপ্তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে 'সত্যিকার অর্থে' ভয়াবহ দুর্নীতি আর সহ্য করা হবে না বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অভিষেকের পরপরই পুতিন শোইগুকে সরিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলোসভকে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/24/download1-ezgif.com-webp-to-jpg-converter.jpg)
পেসকভ বলেন, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা বাজেটকে অবশ্যই দেশের বৃহত্তর অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেট মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সোভিয়েত আমলের পর থেকে এমনটা কখনো দেখা যায়নি।
কনোলি বলেন, 'তাদের এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, তারা ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিরক্ষা বাজেট আরও বিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যয় করা দরকার।'
গত বছর রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে ভাড়াটে বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন দেশটির সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তিনি অভিযোগ করেছিলেন, সামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা করছে এবং তার বাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিতে চাইছে না।
গোল্ড-ডেভিস বলেন, বেলোসভের নিয়োগ ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে একটি স্বীকৃতি যে এই সমস্যাগুলোর প্রতি তারা মনোযোগ দিচ্ছে।
রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটির অর্থনীতি এর উপর নির্ভরশীল। প্রতিরক্ষা খাতের বিকাশের কারণে রাশিয়ানরা উচ্চ বেতন পাচ্ছে। যদিও এতে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা তৈরি হয়েছে, তবে পুতিন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রেখেছেন।
গ্রিন বলেন, 'অর্থনীতি সচল রাখার জন্য সরকারকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।' তবে সামরিক ব্যয় ও দুর্নীতিও যেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে।
কনোলি বলেন, এটাও সম্ভব যে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেলোসভ তার পূর্বসূরির সহযোগীদের সরিয়ে দিচ্ছেন এবং বার্তা দিচ্ছেন যে 'এরপর থেকে তারা ভিন্নভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে'।
পোপোভের ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে শীর্ষ কমান্ডারেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে প্রিগোজিনের মতোই সরাসরি প্রতিরক্ষা নেতৃত্বের সমালোচনা এবং অস্ত্রের অভাব ও দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য সামরিক বাহিনীকে দোষারোপ করায় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তাকে বরখাস্ত হয়েছিল। তিনি হয়ত এখন সেই সমালোচনার ফল ভোগ করছেন।
এটা কি টার্ফ যুদ্ধ হতে পারে?
তবে এই গ্রেপ্তারের পেছনে চালিকা শক্তি ক্রেমলিন, নাকি রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী; বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা এফএসবি, তা স্পষ্ট নয়।
এটা হতে পারে যে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগের পর পুতিনের ঘনিষ্ঠ নয় এমন কর্মকর্তারা একটি টার্ফ যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে গেছেন।
গ্রিন বলেন, ২০২২ সালে পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর আধিপত্যের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টাও হতে পারে এসব।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/24/download2-ezgif.com-webp-to-jpg-converter.jpg)
গ্রিন বলেন, ক্রেমলিন কোনো ধরনের শুদ্ধি অভিযানের কথা অস্বীকার করলেও 'পুতিন যদি এসব না চাইতেন, তাহলে এগুলো হতো না।'
এরপর কী হবে?
কনোলি বলেন, নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেখাতে চান যে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য 'মূল্য দিতে হবে'।
গ্রিন আরও বলেন, এটিও হতে পারে যে 'সোৎসাহী' তদন্তকারীরা মনে করছেন, কোনো জেনারেলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করা তাদের ক্যারিয়ারের অগ্রগতির একটি দুর্দান্ত সুযোগ।
তবে দেশটিতে দুর্নীতি এতটাই সর্বজনীন যে এভাবে গ্রেপ্তার চালু থাকলে তা পুরো ব্যবস্থায় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।
গ্রিন বলেন, যদি কর্মকর্তাদের এমন আচরণের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় যা আগে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও অনুমোদিত ছিল, তবে এটি 'রেড লাইন' পরিবর্তন করতে পারে।
তিনি বলেন, যদি গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকে বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরেও বিস্তৃত হয়, তবে কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে যেতে পারে এবং পুতিনের 'নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে', ক্রেমলিন তা চায় না।
গ্রিন বলেন, যেহেতু পুরো সিস্টেমটি দুর্নীতির উপর নির্মিত, তার এর ব্যাপারে খুব বেশি খোঁড়াখুড়ি হলে পুরো ব্যবস্থা 'ভেঙে পড়তে' পারে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি