ইরানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলি বাগেরি কানি মার্কিনিদের পরিচিত মুখ
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্যদের মৃত্যুতে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা মোকাবিলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় খুব দ্রুতই নতুন উত্তরসূরি নির্বাচন করেছে ইরান।
গত সোমবার ইরানের সরকারি মন্ত্রিসভা আলি বাগেরি কানিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগে অনুমোদন দেয়।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া কানি আগে থেকেই মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে পরিচিত এক নাম। ইরানের পরমাণু আলোচনা থেকে শুরু করে সমগ্র অঞ্চলে প্রক্সি বাহিনী ব্যবহার প্রভৃতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংবেদনশীল বিভিন্ন আলোচনায় পরিচিত মুখ কানি।
দেশটির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহেও কানি ওমানে একটি ঊর্ধ্বতন ইরানি প্রতিনিধিদলের অংশ ছিলেন। তারা পরোক্ষভাবে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তাই প্রতিনিধিদল দুটি ভিন্ন কক্ষে বসেছিলেন এবং ওমানি কর্মকর্তারা তাদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করেন।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, কানি তাদের পূর্বপরিচিত। এছাড়া তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগই প্রমাণ করে যে কেন বাইডেন প্রশাসন মনে করে রাইসি এবং অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের মৃত্যুতে ইরানের নীতি-নির্ধারণে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।
কারণ ইরানের প্রকৃত নেতা হলেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। রাইসি তার একজন কার্যনির্বাহক ছিলেন।
এই অঞ্চলের একজন প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা বিশ্লেষক জোনাথন প্যানিকফের মতে, তার (রাইসি) 'প্রভাব ও প্রতিপত্তি' ছিল। 'কিন্তু প্রতিটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব শুধু সর্বোচ্চ নেতার।'
উত্তরাধিকার পরিকল্পনার ওপর প্রভাব
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হন এবং তখন থেকে দেশের শাসনক্ষমতার ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন তিনি। সংবিধান বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পরই সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের, যিনি ইরানের সরকার প্রধান হিসেবে বিবেচিত হন।
তবে ৮৫ বছরের আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে এবং তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আর তাই তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল।
অনেকে মনে করেন রাইসি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন।
২০১৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা তাকে বিচার বিভাগের প্রধানের শক্তিশালী পদে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও রাইসি বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন। ইরানে ৮৮-সদস্যের এই বোর্ড দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন ইরানের পরবর্তী শীর্ষ নেতা হিসেবে হয়ত রাইসিই নির্বাচিত হবেন।
শীর্ষ নেতা হওয়ার জন্য রাইসি সকল ধর্মীয় ও আদর্শিক মানদণ্ড পূরণ করতেন। তিনি ছিলেন বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ছাত্র ও অনুসারী। খামেনির মতো তিনিও মাশহাদ থেকে এসেছেন।
খামেনির পর ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হওয়ার খুব কাছাকাছি ছিলেন গত রবিবার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট নিহত ইব্রাহিম রাইসি।
তবে তার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে খামেনির উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, নতুন করে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, রাইসির মৃত্যু ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা এবং নীতি-নির্ধারক মহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, খামেনি তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে এমন কাউকেই নির্বাচিত করবেন, যিনি তার 'কট্টর বিশ্বদর্শন' মেনে চলবেন এবং তা নিশ্চিত করতে কাজ করবেন।
মার্কিন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্যানিকফ বলেন, 'বিশ্ব মঞ্চে ইরানের আচরণে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।'
তিনি বলেন, রাইসি এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুতে কিছুদিন হয়ত ইরান কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল- গাজা যুদ্ধ এবং সামগ্রিক আঞ্চলিক অস্থিরতায় ইরানের নতুন প্রশাসন কী ভূমিকা রাখবে, তা নিশ্চিত হওয়ার মতো সময় এখনও আসেনি। তবে আপাতত, বাইডেন প্রশাসন বিশ্বাস করে, ইরানের বিশ্বনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসবে না।
কিছু বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, খামেনির ছেলে এখন তার বাবার উত্তরসূরি হওয়ার জন্য আরও বেশি সুযোগ পেতে পারে।যদিও এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শীর্ষ নেতা নির্বাচনের রহস্যময় প্রক্রিয়াটি কীভাবে কার্যকর হবে এবং এই দুর্ঘটনা খামেনির ছেলের তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে কি না এখনই তা মূল্যায়ন করা অসম্ভব।
প্যানিকফ বলেন, 'আমি মনে করি যদি আগামী মাসে (খুব দ্রুত) আয়াতুল্লাহ মারা যান তাহলে এমন কিছু হতেও পারে। তবে আমার মনে হয়, যদি আরও দুই বা তিন বছর পর এটি হয় (খামেনির মৃত্যু), তাহলে এমন কিছু নাও হতে পারে। কারণ এসময়ের মধ্যে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো আরও কিছু মানুষ প্রস্তুত হয়ে যাবে।'
বিশ্লেষকদের মতে, রাইসির মৃত্যুতে দেশটির অভ্যন্তরে বিক্ষোভ সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
ইরানি সংবিধান অনুযায়ী, রাইসির মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ইরানের বর্তমান সরকার ব্যবস্থার উপর জনসমর্থনের 'অভাব' রয়েছে। রাইসির মৃত্যুতে ইরানের কিছু নাগরিককে 'উদ্যাপন' করতে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান সরকার চাইবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে। এতে নতুন করে জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হবে। এক্ষেত্রে ইরানি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিতভাবেই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
প্রক্সি কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব
ইরানের নেতৃত্বে আকস্মিক পরিবর্তনের বিষয়টি, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে ঘিরে সক্রিয় আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
গত এপ্রিলে ইরান এই অঞ্চলে মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে আক্রমণ শুরুতে বেশ কিছু প্রক্সিকে সমর্থনের প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি তারা ইসরায়েলের ওপর সরাসরি বড় আকারের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
মার্কিন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে, চলমান বহুমুখী সংঘাত পরিচালনায় সমন্বয় রাখতে চায় ইরান। তারা প্রতিপক্ষদের ক্ষতি চায়, তবে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত যেতে চায় না। এখন পর্যন্ত তারা তাদের এ কৌশলে সফল।
মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিমান দুর্ঘটনায় রাইসি ও অন্যান্যদের মৃত্যুর পর প্রক্সিদের কোনো ধরনের সক্রিয়তার লক্ষণ দেখেননি তারা।
ওই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাইসির মৃত্যু বা কানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া দুটোর কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন কোনো সুযোগ এনে দেয়নি। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিসহ অন্যান্য সংকটগুলো আগের মতোই আছে।
প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে ওমানে ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় ফের মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ড, আচরণ এবং নীতিগ্রহণের অভিযোগ করেন।
মার্কিন কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পদক্ষেপের ঝুঁকি বাড়াবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গত সপ্তাহের আলোচনার মতোই প্রতিরোধ ও কূটনীতির সংমিশ্রণে গড়া সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে।
সন্ত্রাসবাদের প্রতি ইরানের সমর্থন, এর বিভিন্ন প্রক্সি গ্রুপ এবং এর পরমাণু কর্মসূচির মতো বিষয়গুলো নিয়ে গত সপ্তাহেও আলোচনা হয়েছে।
অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই পক্ষ একাধিকবার এভাবে পরোক্ষ যোগাযোগ করেছে। কয়েক মাস বিরতির পর, গত সপ্তাহে ফের এ ধরনের বৈঠক হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে রাইসির বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর, উদ্ধার প্রচেষ্টায় মার্কিন সাহায্য চেয়েছিল ইরান।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাট মিলার জানান, 'মূলত লজিস্টিক্যাল কিছু কারণে' ইরানকে সাহায্য করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি