গাজা থেকে ইসরায়েলের বেশিরভাগ সেনা প্রত্যাহার, এরপরে কোন ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছে?

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
10 April, 2024, 02:15 pm
Last modified: 10 April, 2024, 02:25 pm
“বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথাবার্তা ছিল নাটকীয়। বাইডেন নেতানিয়াহুকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নেতানিয়াহু (গাজায়) বিজয় অর্জনের থেকে একধাপ দূরে নন, বরং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার মিত্রতা চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা থেকে এক ধাপ দূরে আছেন।”

রোববার গাজা থেকে অধিকাংশ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ইসরায়েল, এই ঘোষণা বিস্মিতই করেছে পর্যবেক্ষকদের। যদিও সেনা প্রত্যাহার তেমন 'তাৎপর্যপূর্ণ' নয় বলেই বারবার জায়নবাদী সেনাবাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। খবর বিবিসির।   

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঝটিকা এক অভিযান চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস। তারপর থেকে সমস্ত গাজা উপত্যকার সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে এক প্রতিহিংসামূলক যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ইসরায়েল। গত ৬ মাস ধরে গোলাবর্ষণ ও নির্বিচার ধবংসযজ্ঞের মাধ্যমে সমগ্র গাজাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

ইসরায়েলের এই লাগামহীন বর্বরতা দেখেছে পুরো বিশ্ববাসী, ফলে তাদের পক্ষে এটা সত্যিই বিশ্বাস করা শক্ত যে মাত্র এক ব্রিগেড সেনা গাজায় মোতায়েন রেখে, বাকিদের প্রত্যাহার করেছে তেল আবিব। ফলে অনেকেই মনে করছেন, চলমান (তথাকথিত) যুদ্ধে এটি নতুন মোড় পরিবর্তন, এবং ইসরায়েল যতই অস্বীকার করুক এটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। 

এমন ধারণার পেছনে ঘোষণার সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ ভয়াল এই যুদ্ধ শুরুর যেদিন ছয়মাস পূর্তি– ঠিক সেদিনই এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। 

তা সত্ত্বেও এটি গুরুত্ব দিয়ে না দেখারই পরামর্শ দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখমাত্র আভি হাইম্যান। তিনি বলেন, 'এটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবেন না।' গাজা ইসরায়েলের সন্নিকটে এবং চাইলেই যেকোনো সময়ে ইসরায়েল সেখানে পদক্ষেপ নিতে পারে– সেকথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। সেক্ষেত্রে গাজায় সেনা উপস্থিতি থাকা বা না থাকায় কোনো পার্থক্য তৈরি হবে না।
 
আর এই বিষয়টি প্রমাণ করতেই যেন ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা হাতেম আল-ঘামরিকে বিমান হামলা চালিয়ে 'হত্যা' করা হয়েছে। 

ইসরায়েলের গণমাধ্যম যদিও সরকার ও সেনাবাহিনীর চেয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। 

বহুল পঠিত ডানপন্থী সংবাদপত্র ইসরায়েল হায়মে পত্রিকাটির কূটনৈতিক প্রতিবেদক অ্যারিয়েল কাহানা বলেছেন, সর্বশেষ দফার আলোচনার ভিত্তিতে হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তি সইয়ের জন্য চাপে আছে ইসরায়েলি সরকার। সেজন্যই এ সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে।  

তাঁর বিশ্লেষণ হচ্ছে, "স্থলযুদ্ধে লাগাম টানার বিষয়ে ইসরায়েলি মুখপাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে যেসব কারণ উল্লেখ করছেন– সেখানে তাঁরা সামরিক কৌশলের জন্যেই এটা করার যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু, যে সময়ে এটা করা হয়েছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রই বুঝবেন সেটি নিছক কাকতালীয় হতেই পারে না। গুরুত্বপূর্ণ (যুদ্ধবিরতি) আলোচনার আগে, স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করেও– ইসরায়েলের নতিস্বীকারের বিষয়টি সাজানো হয়েছে – হামাসকে একটি বার্তা দেওয়া জন্য। আর সেটা হচ্ছে, ইসরায়েল তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ নিয়ে হামাসের সাথে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত আছে।"

সেনা প্রত্যাহারের আরো কঠোর বিশ্লেষণ করেছেন মধ্যপন্থী মারিভ পত্রিকার সাংবাদিক বেন ক্যাসপিট।  

তিনি লিখেছেন, "যদি নেতানিয়াহুকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর উত্তর হবে, রাফায় অভিযানের তার প্রস্তুতি নিতেই এটি করা হয়েছে। যদিও এর আরেকটি ব্যাখ্যা সারাবিশ্বের প্রায় সকল ভাষার গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ওই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জিম্মি-মুক্তির নিয়ে আলোচনার সাথে খান ইউনিস থেকে ৯৮তম ডিভিশন প্রত্যাহারের সম্পর্ক আছে।" 

"বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথাবার্তা ছিল নাটকীয়। বাইডেন নেতানিয়াহুকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নেতানিয়াহু (গাজায়) বিজয় অর্জনের থেকে একধাপ দূরে নন, বরং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার মিত্রতা চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা থেকে এক ধাপ দূরে আছেন।"

তবে জনসাধারণের সামনে এখনও রাফায় অভিযান নিয়ে তাঁর কঠোর অবস্থান রয়েছে জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন নেতানিয়াহু। অভিযানের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট অবশ্য নেতানিয়াহুর কথার সাথে সামান্য ব্যবধান রেখে বলেছেন, এখনই হামাসের সাথে (সামরিকভাবে) বোঝাপড়ার উপযুক্ত সময়। 

তবে গ্যালান্ট এটাও বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার অর্থই যুদ্ধ শেষ হওয়া নয়। "আমাদের কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য মূল্য দিতেও আমরা প্রস্তুত থাকব, তারপর আবার লড়াইয়ে ফিরব"- যোগ করেন তিনি।  
গ্যালান্টের ভাষ্যমতে, লড়াই অব্যাহত থাকবে। তবে এর ধরন উল্লেখযোগ্যভাবে বদলাতে পারে। 

ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ পরিচালনার ধরন নিয়ে সমালোচনা করছে। এই অবস্থায়, বেসামরিক নাগরিক হতাহত ও ত্রাণ সংকটের বিষয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগকে তেল আবিব কানে তুলেছে, সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনকে ইসরায়েল এ বার্তা দিতে চাইছে।   

প্রচণ্ড লড়াই ও ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছে খান ইউনূসের অধিকাংশ এলাকা। ছবি: গেটি ইমেজেস/ ভায়া বিবিসি

খান ইউনূস থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে ফিরতে শুরু করেছেন ফিলিস্তিনিরা। তাঁরা ফিরেছেন বোমা হামলায় ধবংসস্তূপে পরিণত হওয়া এক শহরে। খান ইউনূসের সাম্প্রতিক সময়ের ছবিগুলো যা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এই অবস্থায়, ইসরায়েলের প্রতি ওয়াশিংটনের অগাধ আস্থা পুনরুদ্ধারে স্রেফ সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ হয়তো– এই মুহূর্তে যথেষ্ট হবে না। 

তবে এই আস্থাও আবারো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়বে, গাজায় ইসরায়েলের পরবর্তী অপারেশন শুরু হলে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, রাফায় পূর্ণমাত্রার অভিযানের আগে সেনাদের বিশ্রাম দিতেই সাময়িকভাবে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, ১০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির সাথে রাফায় আশ্রয় নিয়েছে হামাসের অবশিষ্ট যোদ্ধারা।    

রাফায় সামান্য যেকটি আশ্রয়কেন্দ্র আছে সেখানে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে এই বিপুল জনগোষ্ঠী। বেশিরভাগ ইসরায়েলি সেনা চলে যাওয়ায় এখন তাঁদের অনেকে বাড়ি (যদিও তার কিছুই অবশিষ্ট নেই) ফিরবে–  ইসরায়েলের সরকার ও সেনাবাহিনী হয়তো এমন ধারণা করছে। তখন রাফায় অভিযান পরিচালনা করার পথ অনেকটাই সহজ হবে। 

কিন্তু, খান ইউনূসে ফেরা ফিলিস্তিনিরা প্রত্যক্ষ করেছেন ব্যাপক ধবংসযজ্ঞ। অধিকাংশের বাড়িঘরকে কংক্রিটের স্তূপে পরিণত করেছে ইসরায়েল।
 
গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরকে এখন বসবাসের অযোগ্যই বলছেন ফিলিস্তিনিরা। যেখানে এমনকী পশুরাও বাস করতে পারে না। ফলে রাফায় আশ্রয় নেওয়ারা যে সেখান থেকে বাড়ি ফিরবেন– ইসরায়েলের এই আশা অবান্তর। ফলে সেখানে অভিযান চালানোও ইসরায়েলের জন্য সহজ হবে না। এরপরেও অভিযান চালালে নতুন করে বিপুল বেসামরিক প্রাণহানি হবে– বিশ্ব জনমত যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে– সে অবস্থায় এই মুহূর্তে হয়তো সে পরিকল্পনা করছে না তেল আবিব।
   
ইসরায়েল বলেছে, 'আরো অভিযানের' পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে সেটা হতে পারে উত্তর সীমান্তে লেবাননের হিজবুল্লাহ'র বিরুদ্ধে। ৭ অক্টোবরের পর থেকেই হিজবুল্লাহ'র সাথে প্রতিনিয়ত সীমান্ত সংঘাত চলছে। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলের বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে– যা আরো তীব্র রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে ওই হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হন।  

লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রক্সি সংগঠন। তেহরান যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দূতাবাসে হামলার কঠিন প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয়, তখন হিজবুল্লাহও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এই অবস্থায়, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজা থেকে ফিরিয়ে আনা সেনাদের অনেককে হয়তো উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে মোতায়েন করা হতে পারে।
  
ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য যাই হোক– এর পেছনে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক ঘটনাপ্রবাহ আছে। এবং, গাজায় ইসরায়েলি অভিযান খুব শিগগিরই শেষ হবে– এর সম্ভাবনাও খুবই কম। গাজায় লড়াই চলা অবস্থায় যেসব এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনারা পিছু হটে– খুব শিগগিরই সেখানে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে হামাস। এসব এলাকায় নির্বিচার হামলার পরেও প্রতিরোধ সংগঠনটিকে নির্মুল করতে পারেনি আইডিএফ। তাই হামাসের বিরুদ্ধেও যে লড়াই অব্যাহত থাকবে এটা সহজেই অনুমানযোগ্য। 


অনুবাদ: নূর মাজিদ 


 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.