সারার টিকে থাকা: শেষ ইহুদি সূচিকর্মের দোকান!

আন্তর্জাতিক

আল জাজিরা
10 April, 2024, 07:15 pm
Last modified: 25 April, 2024, 09:18 pm
এই দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ‘সারা থাহা থৌফিক’- নামে একটি ডকুমেন্টারির পরিচালক শরথ কোট্টিক্কাল বলেছেন, ‘প্রথম দিকে সারা আন্টি ও থাহা ইক্কার কাহিনীটি আমার কাছে আন্তঃধর্মীয় প্রগতিশীলতার কারণে আগ্রহের বিষয় ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আমি তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরে স্পষ্ট বুঝেছি, ধর্মীয় পার্থক্য বাইরের মানুষের বিবেচনার বিষয়, তাদের কাছে এটি শুধু ছেলের সঙ্গে তার মায়ের যত্ন ও ভালোবাসার সম্পর্ক।’

১৯৮০'র দশকের গোড়ার দিকে ১৩ বছর বয়সে একদিন তিনি ইহুদি শহরটিতে আসা পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করছিলেন। সেদিনের একটি সুযোগ থাহা ইব্রাহিমের জীবনের গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল।

দক্ষিণ ভারতের শহর কোচিনের (বর্তমানে কোচি) মশলা বাণিজ্যের এক ব্যস্ত কেন্দ্র মাত্তানচেরিতে বেড়ে ওঠে থাহা ইব্রাহিম। দুরন্ত এই কিশোরের কাছে সবসময় তার শ্রেণিকক্ষের সীমানার চেয়ে বাইরের জগতকে অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর বলে মনে হতো।

তাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি যখন স্কুল ছেড়ে দেন, তার পরিবার তখন তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তিনি তার দর্জি বাবাকে কাপড় সেলাই করতে সহায়তা করা থেকে শুরু করে মশলার ব্যবসায় তার চাচাকে সহায়তা করা ইত্যাদি নানা কাজের চেষ্টা করেছেন। তবে একসময় বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোতে দলে দলে আসা পর্যটকেরা তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়।

ইহুদি শহরটির শতাব্দী প্রাচীন প্যারাদেশি সিনাগগ, কোচি দূর্গ প্রভৃতি দেখতে দলে দলে পর্যটক ভিড় করত। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পর্তুগিজ, ডাচ ও ব্রিটিশ বণিকেরা এই এলাকায় বাস করতেন।

থাহা রোজ সকাল সকাল ইহুদি শহরটিতে পৌঁছে যেতেন, সারাদিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সিনাগগে আসা পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে দিন কাটাতেন এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন।

একজন ভারতীয় মুসলমান হিসেবে তিনি সবসময় ইহুদি পাড়ার মানুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতেন।

১৯৮২ সালের এক রবিবার পর্যটকভর্তি একটি জাহাজ ভিড়েছিল বন্দরে। সেদিন থাহার পোস্টকার্ড বিক্রির কাজে একটি অপ্রত্যাশিত বাধা আসে।

থাহা প্রতিদিন তার পোস্টকার্ডগুলো 'গোডাউন' নামে পরিচিত একটি ছোট গুদামে রেখে যেতেন। প্রতি সন্ধ্যায় তার পোস্টকার্ডগুলো গোডাউনে রেখে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল গুদামটির মালিক। কিন্তু সেদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রখর রোদে অপেক্ষা করার পরও কেউ গোডাউনের তালা খুলতে আসেনি।

ঠিক সেসময় ইহুদি টাউনের বাসিন্দা প্যারাদেশি ইহুদি জ্যাকব ইলিয়াস কোহেন গোডাউনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি থাহাকে অপেক্ষা করতে দেখেন।

ছবি: থাহা ইব্রাহিমের সৌজন্যে

দেখেই তিনি ছেলেটিকে চিনতে পারেন। তার মনে পড়ে ছেলেটিকে তিনি তার বাড়ির বাইরে পোস্টকার্ড বিক্রি করতে দেখেছেন।

তৎক্ষণাৎ তিনি এই দুর্দশাগ্রস্ত কিশোরটিকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি থাহাকে বললেন, আগামীকাল বিক্রি সেরে আমার বাসায় এসো। তুমি আমার বাড়িতে তোমার জিনিসগুলো রাখতে পারো।'

সারার দোকানের ভেতরে বসে তার স্মৃতিচারণ

পরের দিন সন্ধ্যায় এই দম্পতির বাড়িতে জ্যাকবের স্ত্রী সারার সঙ্গে থাহার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয়।

তিনি এর আগেও সারাকে পাড়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে দেখেছেন। তিনি মাঝে মাঝে সবজি বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পণ্য কিনতে যেতেন। সবজি বিক্রেতারা আর থাহা প্রায়ই একই স্থানে নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য ঘুরে বেড়াতেন। তবে তিনি কখনো তার (সারা) সঙ্গে কথা বলেননি।

সারা তখনো তার হস্তশিল্পের দোকান খোলেননি। তবে তার সেলাইয়ের দক্ষতার জন্য তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তার বাড়িতে কাজ করা তিন চাকরের সহায়তায় তিনি ততদিনে বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের জন্য কাপড় সেলাই করতেন।

বর্তমানে ৫৪ বছর বয়সী থাহা 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি' নামের দোকানের ভিতরে বসে সারাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।

কারণ তিনি আজও 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি'- নামের এই দোকানে থাকা ইহুদিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, স্যুভেনির এবং হস্তশিল্প যেমন: মেনোরাহ, টেবিল লিনেন, প্লেসম্যাট, তোয়ালে, কিপ্পা এবং চালা কভারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

দোকানের ঢোকার দরজাটি মনমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফিতে 'সারা কোহেনের বাড়ি' লেখা এবং স্টার অব ডেভিড দিয়ে সজ্জিত। এর ঠিক পাশে একটি ইস্পাত ফলকে 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি' লেখা এবং সারা কোহেনের একটি ছবি রয়েছে।

দোকানের দেয়ালগুলোতে কোহেনদের জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সাদাকালো ছবিতে সাজানো। যেমন: যৌবনে জ্যাকব ও সারার তোলা ছবি, তাদের বিয়ের ছবি, পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বৈঠকের ছবি এবং তার দোকানে বসে থাকা সারার একটি ছবি প্রভৃতি।

থাহা বলেন, 'জ্যাকব আঙ্কেল ও সারা আন্টি প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। তারা সবকিছুতেই একে অপরের সিদ্ধান্ত খুশি মনে মেনে নিতেন, শুধুমাত্র আমার বিষয়টি ছাড়া।'

জ্যাকবের পরামর্শে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে সারার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে করে তিনি এ কথা বলেন।

১৯৮২ সালে যেদিন প্রথমবার তিনি তাদের বাড়ি যান, সেদিন সারা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে কী করতে এসেছে।

ছবি: থাহা ইব্রাহিম

জবাবে ১৩ বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটি বুক ভরা আশা নিয়ে বলেছিলেন: 'জ্যাকব আঙ্কেল বলেছেন আমি এখানে আমার বোর্ড ও পোস্টকার্ডগুলো রাখতে পারি।'

থাহা আজও মনে করতে পারেন কীভাবে পরিবেশ হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সারা অসন্তুষ্ট হয়ে তার স্বামীকে ফোন করেন।

জ্যাকব সারার বিরক্তি ঝেড়ে ফেলতে দ্রুত বলে ওঠেন, 'ও একটি বাচ্চা ছেলে, সারা। ওর জিনিসপত্র এখানে রাখতে দাও।'

এরপরে যা হয়েছিল, থাহার কাছে তা ছিল একটি দুর্বোধ্য নাটক। কারণ এই দম্পতি সাধারণত মালয়ালম ভাষায় কথা বলতেন। তবে তার সামনে তারা ইংরেজিতে তর্ক করছিলেন, যাতে তিনি তাদের কোনো কথা বুঝতে না পারেন।

থাহা জানান, সেই মুহূর্তে তিনি দোয়া করছিলেন তিনি যেন ওই ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। কারণ তার সব আশা ততক্ষণে হতাশায় পরিণত হয়েছে।

তিনি তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, 'আমি চলে যাচ্ছি, কোনো সমস্যা নেই। আমি আমার জিনিসপত্র সব গোডাউনেই রাখব।'

এর উত্তরে জ্যাকব তাকে ঠান্ডা গলায় বলেন, 'তুমি যদি আজ তোমার জিনিসপত্র এখান থেকে নিয়ে যাও, তবে আর কখনো ইহুদি শহরে কিছু বিক্রি করতে আসবে না।'

স্বামীর কথা শুনে সারা রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ফিরে গেলেন।

তবে সেদিন তাদের কেউই জানতেন না, এই বিদ্বেষপূর্ণ ঘটনাটি থাহা ও সারার মধ্যে একটি গভীর বন্ধনের সূচনা মাত্র। যা তার জীবনের শেষ হওয়ার পরেও অটুট থাকবে এবং তার উত্তরাধিকার হয়ে থাকবে।

আজ 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি' শপ কোচিতে টিকে থাকা শেষ ইহুদি হস্তশিল্পের দোকান।

ছবি: স্নেহা থমাস/আল জাজিরা

'ভারতের প্রথম এম্পোরিয়াম'

সারা ও থাহার প্রায় ৪০ বছরের বন্ধন ছিল দুই অসম বন্ধুত্বের। একজন মুসলিম ছেলে, আরেকজন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণির এক বয়স্ক ইহুদি নারী।

এই দুজনের সম্পর্ক নিয়ে 'সারা থাহা থৌফিক'- নামে একটি ডকুমেন্টারির পরিচালক শরথ কোট্টিক্কাল বলেছেন, 'প্রথম দিকে সারা আন্টি ও থাহা ইক্কার কাহিনীটি আমার কাছে আন্তঃধর্মীয় প্রগতিশীলতার কারণে আগ্রহের বিষয় ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আমি তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরে স্পষ্ট বুঝেছি, ধর্মীয় পার্থক্য বাইরের মানুষের বিবেচনার বিষয়, তাদের কাছে এটি শুধু ছেলের সঙ্গে তার মায়ের যত্ন ও ভালোবাসার সম্পর্ক।'

শরথ কোট্টিক্কাল ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালে সারার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কাহিনী নথিভুক্ত করেন।

এটি অবশ্যই কোচির মুসলিম ও ইহুদি সমাজের চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম একটি ঘটনা।

প্রাচীন ইসরায়েল এবং রাজা সলোমনের রাজত্বকাল থেকে কেরালার প্রথম ইহুদি বসতি শুরু। খ্রিস্টপূর্ব ৯৭০ থেকে ৯৩১ অব্দ পর্যন্ত এই স্থানান্তর ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলের বাণিজ্যের সঙ্গে এই সময়ে আসা ইহুদিদের নাম জড়িয়ে আছে, এটি 'ভারতের প্রথম এম্পোরিয়াম'।

কোচিনে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়েছিল ১৪৯২ সালে। স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা সে বছর পর্তুগাল, তুরস্ক ও বাগদাদ হয়ে কোচিনে এসে পৌঁছায়।

এই নবাগতরা 'প্যারাদেশি' (বিদেশি) ইহুদি নামে পরিচিত। প্রথমে বসতি স্থাপনকারী 'মালাবার ইহুদিদের' সঙ্গে তারাও যুক্ত হন।

মালাবারি ইহুদিরা প্রথমে ভারতের মালাবার উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল এবং সেখান থেকে তারা কোচিন ইহুদি সম্প্রদায় গড়ে তোলে। এটি বর্তমানে ভারতের প্রাচীনতম ইহুদি সম্প্রদায়গুলোর একটি।

তারা স্থানীয়দের মতো মালয়ালম ভাষায় কথা বলতেন এবং হিব্রু, আরামাইক ও মালয়ালম ভাষা মিলে গঠিত জুডিও-মালয়ালম ভাষায় তাদের স্তোত্র পাঠ করতেন। তবে তারা কঠোরভাবে তাদের ধর্মীয় নিয়ম-নীতি মেনে চলতেন।

কোচিন রাজা মাট্টানচেরিতে মালাবাড়ি ইহুদিদের বসবাসের এলাকার পাশেই প্যারাদেশি ইহুদিদের জমি দিয়েছিলেন। সেখানে তারা ১৫৬৮ সালে প্যারাদেশি সিনাগগ নির্মাণ করেন। 

একসময় ইহুদি টাউন রোড, মাতানচেরি প্রাসাদ থেকে প্যারাদেশি সিনাগগ পর্যন্ত প্রসারিত রাস্তাটি মূলত প্যারাদেশি ইহুদিদের একটি ছিটমহল ছিল।

ছবি: থাহা ইব্রাহিমের সৌজন্যে

কয়েক শতাব্দী পরে, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গঠন কোচিন ইহুদিদের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ ছিল।

১৯৫২ সাল থেকে ধীরে ধীরে তারা ইসরায়েলে ফিরে যেতে শুরু করেন। ১৯৪০'র দশকের শেষের দিকে ইহুদি টাউনের ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫০। তবে থাহা যখন সেখানে যেত সেসময় তাদের সংখ্যা মাত্র ৩০ জনেরও কম ছিল।

যারা সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কোহেনেরা তাদের একজন।

তারা দুজনেই ইহুদি টাউনে জন্ম নেন, বেড়ে ওঠেন এবং ১৯৪২ সালে বিয়ে করেন। এই দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। তাদের পূর্বপুরুষরা কোচিনের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকায় ওই স্থানের সঙ্গে তারা নাড়ির টান অনুভব করতেন। তাই তারা কখনো এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেননি।

সারা বলতেন 'আমি ভারত ছেড়ে যাব না। এটা আমার বাড়ি।'

'তাহলে তুমি সেলাই করতে পারো!'

কোহেনদের সঙ্গে থাহার বন্ধুত্বের প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারণের সময় তার মনে আসে তিন চাকরসহ একটি ব্যস্ত পরিবারের কথা। বয়স ৭০ বছরের বেশি হওয়ার পরে জ্যাকব প্রায় অবসর নিয়েছিলেন। তিনি সেসময় বেসরকারি কর পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন।

অন্যদিকে, সারার বয়স যখন ৬০ বছরের কিছু বেশি, তখন তিনি ইহুদি টাউনের জনপ্রিয় দর্জি হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যবাহী ইহুদি হস্তশিল্পের মাস্টার।

প্রাথমিকভাবে, থাহা জ্যাকবের সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সাইকেল চালিয়ে দ্রুত জ্যাকবকে কাগজ ফটোকপি করে এবং তার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস এনে দিতেন। জ্যাকব তখন তাকে শুধু হাতখরচ দিতেন।

থাহা তার প্রিয় 'ডিকি আঙ্কেল'-এর কথা স্মরণ করে বলেন, 'যখনই আমি কোহেনদের বাড়ির জানালা দিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখতাম, তিনি আমাকে ভিতরে আসতে বলতেন এবং আমাকে বসার জন্য একটি আসন দিতেন।'

থাহার বয়স যখন ১৯ বছর, একদিন জিউ টাউনে তিনি নিত্যদিনের মতো পোস্টকার্ড বিক্রি করছিলেন। সেদিন সারা তার সঙ্গে প্রথম কথা বলেন এবং তাকেও সাহায্য করার জন্য বাড়ি যেতে বলেন।

সিনাগগের গদির ঢাকনা সেলাইয়ের কাজে সাহায্য করার জন্য সারার থাহার বাবাকে দরকার ছিল। কিন্তু তার বাবা বার্ধক্যজনিত কারণে সেলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাই থাহা তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন। থাহা তার বাবার সঙ্গে কাজ করে ততদিনে কতটা দক্ষতা অর্জন করেছেন, সে সম্পর্কে সারা তখনো কিছুই জানতেন না। তাই তিনি তার প্রস্তাব শুনে দ্বিধা করছিলেন।

তবে থাহা ওই কুশনের জন্য যে প্যাটার্নটি তৈরি করেছিলেন, তা দেখে সারা খুব আনন্দিত হন।

ছবি: স্নেহা থমাস/আল জাজিরা

থাহা স্মৃতিচারণ করে বলেন, সারা তার কাজ দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, 'তাহলে তুমি সেলাই করতে পারো!'

তিনি বলেন, আন্টি বলেছিলেন এতদিনেও তার নিজের সহকারীও এই কাজ শিখতে পারেনি। 'তখন থেকেই সারা আন্টি আমায় স্নেহ করতে শুরু করেন।'

১৯৮০'র দশকের শেষের দিকে সারা তার বসার ঘরে 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি'- নামের দোকানটি খুলেছিলেন। সেখানে তিনি কিপ্পা (ইহুদিদের ঐতিহ্যবাহী মাথার টুপি) এবং চাল্লাহ কভার (রুটি ঢাকার কাপড়) বিক্রি করতেন।

থাহা তার সেদিনের 'উত্তেজনা ও উদ্বেগ'-এর কথা স্মরণ করেন, যেদিন সারা প্রথম তাকে তার প্রিয় সিঙ্গার সেলাই মেশিনটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

১৯৪০ এর দশকে জ্যাকবের কাছ থেকে তিনি এটি উপহার পান। সেই সময় এরকম একটি মেশিন কেনা একটি গাড়ি কেনার মতো ব্যাপার ছিল।

সারার কাছ থেকে শিখে ক্রমেই থাহা কিপ্পাস এবং ঐতিহ্যবাহী ইহুদি কারুশিল্প সেলাইয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি তার পোস্টকার্ড বিক্রির পরের অবশিষ্ট সময়ে সারাকে সহায়তা করতেন।

প্রথমে থাহা সেলাইকে একটি তুচ্ছ কাজ মনে করতেন। কিন্তু সারার পরামর্শে তিনি এর প্রতি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে আস্তে আস্তে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে যায়।

সারা তাকে মজা করে 'খুব ভাল দর্জি, তবে অলস' বলে তিরস্কার করতেন।

১৯৯০ এর দশকের মধ্যে ওই শহরের ইহুদির সংখ্যা ২০ এর নিচে নেমে যায়। তবে ওই অঞ্চলে পর্যটন বৃদ্ধির পাশাপাশি সারার পণ্যগুলোর চাহিদাও বেড়ে যায়। তিনি তার নকশাগুলো ব্যবহার করে স্থানীয় সেলাই ইউনিটগুলোতে আউটসোর্সিং উৎপাদন শুরু করেন, থাহা সেখানে লজিস্টিক পরিচালনা করতেন। 

থাহা বলেন, 'সেসময় সারা আন্টি আমাকে তার লাভের টাকার একটি অংশ দিতেন।'

১৯৯৯ সালে মারা যাওয়ার আগে জ্যাকব খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি থাহাকে তার নিজের সন্তানের মতো অনুরোধ করে বলেন, 'সারার কেউ নেই। তুমি অবশ্যই ওর পাশে থাকবে।'

থাহা এই অনুরোধের গুরুত্ব বুঝতে পেরে একটি শর্তে রাজি হয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, 'তিনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তবে আমি খুশিমনে সারা আন্টির দেখাশোনা করতে রাজি।'

ছবি: থাহা ইব্রাহিম

তিনি তার শর্তের ব্যাপারটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন,আমি 'যদি তিনি আমাকে অনুমতি দেন' এই কথাটা বলি, কারণ (যদি সারা বিষয়টি না চায় তাহলে) আমাদের মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি না রাখা একটি গুরুতর পাপ।

এরপর থেকে থাহা ও সারা একই পরিবারের মানুষ হয়ে ওঠে।

থাহা বলেন, 'আমি আমার মায়ের চেয়ে সারা আন্টির সঙ্গে বেশি সময় কাটিয়েছি।'

থাহা জানান, খুব সকালে পৌঁছে যেতেন তিনি এবং রাতে দোকান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতেন।

থাহা গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে, তার (সারা) জন্য রান্না করা এবং তিনি চলে যাওয়ার পরে রাতে তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন মহিলা যোগাড় করেন।

সারার স্বাস্থ্যের অবনতির পরে থাহাও ইহুদি শহরের কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করেন।

২০০০ সালে ৭৭ বছর বয়সী সারা থাহাকে তার হয়ে দোকানটি চালাতে বলেন।

তিনি তাকে স্পষ্ট নির্দেশ দেন, 'তার ব্যবসা যেন ধ্বংস না হয়ে যায়। সব লাভ নিয়ে নাও, কিন্তু আমার খেয়াল রেখো।'

এরপর থেকে তিনি একা হাতে দোকান সামলানো এবং সারা আন্টির দেখাশোনা করা শুরু করেন।

দোকান চালানোর পাশাপাশি থাহা (কোচিতে যতদিন পাওয়া যেত ততদিন) তার কোশের মাংস (কোশের খাবার হল এমন খাবার যা ইহুদিদের খাদ্যতালিকাগত নিয়ম কাশরুত বা খাদ্যতালিকা আইন অনুযায়ী) এবং মাছ নিয়ে আসতেন। তাছাড়া তিনি শুক্রবার তার জন্য রুটি আনতেন, যাতে তিনি বিশ্রামবার পালন করতে পারেন।

থাহা বলেন, 'আজও আমি শনিবারে শব্বাত এবং অন্যান্য ইহুদি ছুটির দিনে দোকানটি বন্ধ করে দেই, ঠিক যেমন সারা আন্টি করতেন।'

সারা কোহেনের এক পারিবারিক বন্ধু নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, 'থাহা সারাহ আন্টির কাছে ছেলের মতো ছিল এবং তিনি তাকে নিজের মায়ের মতো যত্ন করতেন।'

এই আত্মীয় একসময় কোচিতে থাকতেন, বর্তমানে তিনি ইসরায়েলে থাকেন।

প্যারোচেট তৈরি করা

২০১৯ সালের শেষদিকে ৯৬ বছর বয়সে সারা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৩৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে সারার সঙ্গে থাহার বন্ধন অটুট ছিল।

তিনি আকুলভাবে একটি প্যারোচেট (ইহুদি শিলালিপি ও নকশা সম্বলিত একটি লম্বা কাপড়। যা কফিন ঢেকে রাখার পরে সিনাগগে তাওরাত ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়) চেয়েছিলেন। 

সারা চেয়েছিলেন থাহা নিজেই যেন তার কাফন ঢাকার জন্য একটি প্যারোচেট সেলাই করে দেন।

থাহা স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'তিনি বেঁচে ছিলেন, তাই তিনি জীবিত অবস্থায় আমি কখনো এটি তৈরি করতে চাইতাম না। কিন্তু সারা আন্টি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলতেন, এসব বলার মতো তার আর কেউ নেই।'

এটাই তার উপর অর্পিত একমাত্র দায়িত্ব ছিল না।

সারার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল স্বামী এবং তার নিজের কবরের মাঝের স্থানে সমাধিস্থ হওয়া। 

থাহাকে তিনি প্রায়ই মায়ের মতো শাসন করার ভঙ্গিতে বলতেন, 'আমি চাই তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এসে আমার কবর পরিষ্কার করবে।'

শরথের ডকুমেন্টারিটির একটি দৃশ্য বিশেষ মর্মস্পর্শী।

ছবি: স্নেহা থমাস/আল জাজিরা

চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেছেন, 'সারা আন্টি থাহা ইক্কাকে তার বিয়ের আংটি দিতে চাইছেন, এই একটি দৃশ্যই যথেষ্ট তার কাছে থাহার গুরুত্ব কতটা ছিল তা বোঝানোর জন্য।'

ওই দৃশ্যে দেখানো হয়, সারা তার প্রিয় জানালার পাশে বসে আছেন এবং তার বিয়ের দিনের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে বিবর্ণ স্মৃতগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

থাহা আংটিটা সারার বাঁ হাতের অনামিকায় পড়িয়ে দেন এবং আস্তে আস্তে বলেন, 'এটা এই হাতের জিনিস। এটাকে আর খুলবেন না, ঠিক আছে?'

তারপরে তিনি তাকে আংটির গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং জোরে জোরে আংটিতে খোদাই করা অক্ষরগুলো পড়ে জ্যাকবের স্মৃতি মনে করান। এতে লেখা ছিল 'সিও এইচ ই এন কোহেন।'

সারা স্নেহমাখা মুখে থাহার দিকে তাকিয়ে বলেন, 'বেচারা দয়ালু থাহা। আমি যা বলছি, তুমি তাই শোনো'।

থাহা জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি এখন আমাকে 'দয়ালু' বলছেন কেন?'

জবাবে সারা তার আংটির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'তুমি কি এটা নিতে চাও না?' থাহা কিছুটা অবাক হয়ে মাথা নেড়ে 'না' বলে বলেন, 'আপনিই এটা পরুন। ঠিক আছে?'

সারাহ তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, তার চোখ জলে ভরে ওঠে। থাহা জিজ্ঞাসা করেন: 'আপনি এখন কাঁদছেন কেন?' সারা জবাবে বলেন, 'আমার এটার দরকার নেই, কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো।'

থাহা তার আবেগ লুকানোর চেষ্টায় ঠাট্টা করে বলেন, 'সোনার আংটি দিয়ে আপনি আমাকে ভালবাসা দেখাচ্ছেন?' দৃশ্যটি এখানেই শেষ হয়।

তার মৃত্যুর পরে সারা তার মূল্যবান সম্পদ যেমন: বিয়ের আংটি, তার সিঙ্গার সেলাই মেশিন এবং তার দোকান থাহার জিম্মায় রেখে যান।

থাহা বলেন, 'আমাদের জীবনের কিছু জিনিস সব আর্থিক দামের ঊর্ধে।'

বর্তমানে থাহার চালানো দোকানটি কেরালার বাইরেও তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের ওয়ার্কশপগুলোতে সেলাইয়ের কাজ আউটসোর্স করে, ঠিক যেমনটি সারা চেয়েছিলেন। শতাধিক নারী এই কাজে নিয়োজিত।

গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধ তার বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি। কোহেনদের সঙ্গে তার যে ভালোবাসার বন্ধন তা কখনো নষ্ট হবে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন না।

থাহা বলেন, আমি এই যুদ্ধকে মুসলিম বনাম ইহুদি হিসেবে দেখি না। এটি স্পষ্টই একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। নেতারা তাদের লাভের জন্য ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছেন। অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করা থেকে বিরত থাকার জন্য আমাদের এটুকু বুঝতে পারাই যথেষ্ট। আমাদের ধর্ম থাকা উচিত, তবে মানবতাকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে।'

ইহুদি শহরটি এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। একসময়ের ইহুদি পরিবারগুলোর বসবাস করা বাড়িগুলো এখন অ্যান্টিক শপ, ক্যাফে ও হোমস্টে। একসময় যা একটি ইহুদি ছিটমহল ছিল, তা এখন একটি প্রাণবন্ত পর্যটন স্থান। তবে শুধু একটি দোকান একই রকম রয়ে গেছে – 'সারাহ'স হ্যান্ড এমব্রয়ডারি'।

এখন শুধু রূপালি-সাদা বব চুলের ফাইবার-ফ্রেমের চশমা, রঙিন ম্যাক্সি এবং ম্যাচিং কিপ্পা পড়া সারা কোহেনকে সেই জানালার পাশে দেখা যায়না। যেখান থেকে তিনি পর্যটকদের আনাগোনা দেখতে ভালোবাসতেন। বর্তমানে তার উত্তরাধিকার থাহা নামের একজন মুসলিম ব্যক্তি সেখানে বসে থাকেন।

থাহা জোর দিয়ে বলেন, এটি এখনও 'সারা আন্টির দোকান'।

 

 


ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.