ভারতীয় ধনীদের নতুন প্রজন্ম ৩৮২ বিলিয়ন ডলার সম্পদের অধিকারী হবেন

আন্তর্জাতিক

ব্লমবার্গ
04 April, 2024, 09:55 pm
Last modified: 05 April, 2024, 12:55 pm
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, ভারতের শীর্ষ ১০ ধনী পরিবারের মোট সম্পদমূল্য ৩৮ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এসব পরিবারের ৪০ বা তারও কম বয়সী সদস্যরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একই বয়সের চীনা সমকক্ষরা যে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে পারেন, তার তুলনায় এটি তিনগুণ বেশি।

বাবা ও মা- নীতা ও মুকেশ আম্বানির মাঝে তিন সন্তান (বাম থেকে) ইশা, আকাশ ও অনন্ত আম্বানি। ছবি: ধীরাজ সিং/ ব্লুমবার্গ

ভারতের বড় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপে পারিবারিক আধিপত্য নতুন ঘটনা নয়। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধি যে পরিবারের হাত ধরে– তাদের উত্তরসূরীরাই পান ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দেশটির পরিবার-চালিত এসব গ্রুপের নতুন প্রজন্মের উত্তরাধিকারীদের দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা বা তার বাস্তবায়ন– কিন্তু জোরকদমেই শুরু হয়েছে।   

ফলে বয়স বাড়তে থাকা ভারতীয় ধনকুবেরদের অনেকেই তাঁদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে– পরিবারের তরুণ সদস্যদের আরো গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসাচ্ছেন। আম্বানি, আদানি ও বিড়লা-সহ ভারতের শীর্ষ বিলিয়নিয়ারদের ক্ষেত্রে এই ঘটনাই দেখা যাচ্ছে।   

ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, ভারতের শীর্ষ ১০ ধনী পরিবারের মোট সম্পদমূল্য ৩৮ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এসব পরিবারের ৪০ বা তারও কম বয়সী সদস্যরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একই বয়সের চীনা সমকক্ষরা যে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে পারেন, তাঁর তুলনায় এটি তিনগুণ বেশি। 

সম্পদের এই তারতম্য দুটি দেশের ভিন্ন অর্থনৈতিক গতিপথকেও তুলে ধরছে। ধনীদের সম্পদমূল্য বাড়তে বা কমতে ভূমিকা রাখে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ। চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হওয়ায় অনেক কোম্পানির শেয়ারমূল্যে পতন হয়েছে। এতে ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর বিত্তে পড়েছে ভাটা। অন্যদিকে, ভারতের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা দেখছেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফলে সর্বোচ্চ মূল্যেই লেনদেন হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার।  

ভারতের অর্থনীতি প্রসারিত হচ্ছে দিনকে দিন, তার সাথে সাথে জ্বালানি ও ই-কমার্সের মতো বৈচিত্র্যময় অন্যান্য খাতে পরিবার-নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো জড়িত হচ্ছে। ভারত বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ– তরুণরাই যেখানে প্রধান ভোক্তা। ভারতের ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বর্তমান কর্তাব্যক্তিরা আশা করছেন, তাঁদের সন্তানেরা নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে– নিত্যনতুন পণ্য ও সেবার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের ভোক্তাদের ধরতে পারবে। এজন্য তাঁদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। 

ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবার হচ্ছে -বিড়লারা। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে– প্রায় ১৬৫ বছর আগে তাদের ব্যবসার গোড়াপত্তন। এই পরিবারের বর্তমান কর্তা হচ্ছেন- কুমার মঙ্গলাম বিড়লা। সম্প্রতি নিজের দুই সন্তান- আর্যমান বিক্রম এবং অনন্যাকে তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বোর্ডের সদস্য করেছেন। পরিবারের সম্পদমূল্য ১৮.৮ বিলিয়ন ডলার।   

অনন্যা বিড়লা একজন গায়িকা হিসেবে সুপরিচিত, অন্যদিকে সাবেক ক্রিকেটার হলেন আর্যমান। তাঁদেরকে বিড়লা পরিবারের মালিকানাধীন ফ্যাশন, পেইন্ট ব্যবসার পাশাপাশি গ্রুপের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা হয়েছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আর্যমান ও অনন্যা প্রথমে আদিত্য-বিড়লা গ্রুপের ফ্যাশন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। সেটাই ছিল  পারিবারিক ব্যবসায় প্রথম পদার্পণ। এসময় তাঁদের বাবা কুমার মঙ্গলাম বলেন, "নতুন যুগের ব্যবসায়িক মডেল এবং ভোক্তাদের পরিবর্তিত চাহিদা সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান পরিচালক বোর্ডে নতুন উদ্যম যোগ করবে।"

ভারতের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর প্রতিষ্ঠাতারাই সাধারণত ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি অংশীদারত্ব নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার থাকায় নিজ সন্তানদের তাঁরা সহজেই পরিচালক বোর্ডের সদস্য করতে পারেন। এই বিষয়টিকে ভারতে স্বাভাবিক উত্তরাধিকার হিসেবেই দেখা হয়; যদিও এ ধরনের নিয়োগকে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় কর্পোরেট সুশাসনের লঙ্ঘন হিসেবে ধরা হয়।

ভারতের তথা এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হচ্ছেন মুকেশ আম্বানি। তিনিও নতুন প্রজন্মকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছেন ব্যবসায়িক দায়িত্ব। সম্প্রতি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান– রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটিডের বোর্ডে নিজের তিন সন্তান– আকাশ, ইশা ও অনন্তকে নন-এক্সিকিউটিভ পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মুকেশ। আগামী পাঁচ বছর তাঁদের নিজ হাতে গড়ে তোলার দিকেই এখন মনোযোগ দেবেন বলে জানান সেসময়। এই পরিবারের বর্তমান সম্পদমূল্য ১১৩.৫ বিলিয়ন ডলার।  

সফলভাবে উত্তরসূরীর পরিকল্পনা করা কতোটা জরুরী– সেটা হয়তো আম্বানি পরিবার এখন ভালোমতোই জানে। বাবা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পরে রিলায়েন্স গ্রুপের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুকেশ ও তাঁর ছোট ভাই অনীল আম্বানি বিরোধে জড়ান। এরপর তাঁদের মায়ের হস্তক্ষেপে ২০০৫ সালে এই বিরোধের অবসান হয়। সমঝোতা অনুযায়ী, অনীল রিলায়েন্স টেলিকম, আর্থিক পরিষেবা ও অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ পান। আর মুকেশ পান জ্বালানি তেল ও পেট্রোকেমিক্যালসের ব্যবসা। বড় ভাইয়ের ব্যবসা দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠলেও– অনীল ব্যবসা সফল হতে পারেননি, তাঁর সম্পদও দিন দিন কমতে থাকে। এমনকী ২০১৯ সালে রিলায়েন্সের টেলিকম ব্যবসা দেউলিয়া ঘোষণা চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়।

তাই মুকেশ আম্বানি সতর্কই হয়েছেন। সন্তানদের ধীরে ধীরে ব্যবসার সব মারপ্যাঁচ আর কৌশল শেখাতে চান তিনি। 

একইভাবে ভারতের অন্য শীর্ষ ধনাঢ্য পরিবারের নতুন প্রজন্মকেও– প্রবীণ প্রজন্মের তত্ত্বাবধানে থেকে দায়িত্ব সামলাতে হবে। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজরই থাকবে পরিবারের অগ্রজ সদস্য ও বিনিয়োগকারীদের। সবাই দেখতে চাইবেন, তাঁদের ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং জ্যেষ্ঠদের অর্জিত সাফল্য তাঁরা কতটুকু ধরে রাখতে পারছেন। 

হায়দরবাদের ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেসের টমাস স্মিডিনি সেন্টার ফর ফ্যামিলি এন্টারপ্রাইজের অধ্যাপক কাভিল রামচান্দ্রান বলেন, এ ধরনের বিশাল দায়িত্ব পালনের জন্য ব্যবসায়ীক পেশাদারিত্বের ট্র্যাক রেকর্ড নতুন প্রজন্মের সবার নেই। "তাই বেশিরভাগই (পারিবারিক ক্ষমতার) এলিভেটরে  চড়ে শীর্ষে পৌঁছান।"

পারিবারিক সম্পদমূল্য বা উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে অবশ্য পরিবারগুলো ব্লুমবার্গের কাছে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি। আম্বানি ও বিড়লাদের কথা তো আগেই বলা হয়েছে, ভারতের শীর্ষ ধনী আরো কয়েকটি পরিবার, পারিবারিক সম্পদমূল্য এবং তাঁদের ৪০ বা তারও কম বয়সী উত্তরসূরিদের সম্পর্কে তথ্য এখানে দেওয়া হলো। 

গৌতম আদানির দুই ছেলে করন ও জিত আদানি

পারিবারিক সম্পদমূল্য: ১০২.৪ বিলিয়ন ডলার। 
মূল প্রতিষ্ঠান: আদানি গ্রুপ 

কৃষিপণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে অবকাঠামো খাতের এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে আদানি গ্রুপ। ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি বন্দর পরিচালনার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়সা ব্যবসা রয়েছে আদানিদের।

গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানির বড় ছেলে হচ্ছেন করন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন। তাঁকে আদানি পোর্টস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর ছোট ভাই জিত, যুক্তরাষ্ট্রের পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে তিনি গ্রুপের মূল কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজে গ্রুপ ফাইন্যান্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। 

শাপুর মিস্ত্রির ছেলে পাল্লন মিস্ত্রি

পারিবারিক সম্পদমূল্য: ৩৭.৭ বিলিয়ন ডলার। 
মূল প্রতিষ্ঠান: শাপুরজি পাল্লনজি গ্রুপ

১৮৬৫ সালে নির্মাণকাজের ঠিকাদারির মাধ্যমে এই পরিবারের ব্যবসার সূত্রপাত হয়। বর্তমানে আবাসন ও প্রকৌশল-সহ নানান খাতে রয়েছে শাপুরজি পাল্লনজি গ্রুপের ব্যবসা। তাঁরা বিলাসবহুল হোটেল, স্টেডিয়াম, কারখানা, রাজপ্রাসাদসহ এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মুম্বাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক– রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রধান কার্যালয় এবং ওমানের সুলতানের জন্য আল আলম প্রাসাদ। 

শাপুরজি পাল্লনজি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারটির ভারতের আরেক ব্যবসায়িক জায়ান্ট টাটা অ্যান্ড সন্সেও অংশীদারিত্ব আছে। এটিই টাটা গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান– যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গাড়ি থেকে শুরু করে চা এর মতো নানান পণ্য উৎপাদনের ব্যবসা।

শাপুর মিস্ত্রির ছেলে পাল্লন লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়েছেন। শাপুরজি পাল্লনজি অ্যান্ড কোং এর পরিচালক বোর্ডের তিনিও একজন সদস্য।    

দিলীপ সাংঘভির ছেলে অলোক 

পারিবারিক সম্পদমূল্য: ২৬.৭ বিলিয়ন ডলার। 
মূল প্রতিষ্ঠান: সান ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ

১৯৮৩ সালে দিলীপ সাংঘভির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সান ফার্মা, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারক। বর্তমানে তাঁদের ৪০টির বেশি কারখানায় ৪১ হাজার কর্মী রয়েছে। 

দিলীপের ছেলে অশোক যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেলুলার ও মলিকিউলার বায়োলজির ওপর ডিগ্রী নিয়েছেন। সান ফার্মার বোর্ডে তিনি একজন নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.