মাত্র এক ইউরোতেও বিক্রি হচ্ছে না ইতালির খালি বাড়িগুলো, কিন্তু কেন?

আন্তর্জাতিক

সিএনএন
29 March, 2024, 12:40 pm
Last modified: 29 March, 2024, 01:43 pm
ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জনশূন্য হয়ে পড়া শহরগুলোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মালিকদের অনুমতি ছাড়াই পরিত্যক্ত বাড়িঘর বিক্রির এখতিয়ার থাকলেও প্যাট্রিকা এবং এর মতো অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে এটি হয় না।

পাহাড়, সাগর আর বরফে ঢাকা ইতালির আব্রুজ্জোতে বাড়ি বিক্রি হয় মাত্র ১ ইউরো বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০০ টাকাতে। লোভনীয় মূল্যে বাড়ি বিক্রির অফার দিয়েও এখনও অনেক শহর পাচ্ছে না খদ্দের। 

মূলত জীবিকার সন্ধানে ইতালির বাসিন্দারা গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরের দিকে চলে যাচ্ছেন। এ কারণে, সেসব বাসিন্দাদের পরিত্যক্ত বাড়ি পুনর্নির্মাণ করে বসবাসের উপযোগী করা এবং সেসব অঞ্চলে বসবাসের ধারা বজায় রাখতেই ইতালির সরকার এত কম মূল্যে বাড়ি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। 

মুসোমেলি এবং জুঙ্গোলির মতো ইতালির কিছু শহর সফলভাবে বিদেশিদের কাছে পরিত্যক্ত বাড়ি বিক্রি করতে পারলেও প্যাট্রিকার মতো শহরগুলোতে এখন অনেক বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মনোরম শহরগুলো হিমশিম খাচ্ছে ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে। 

পরিত্যক্ত বাড়ি

উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্ধানে পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়ায় অনেক বাড়িঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ইতালির গ্রামগুলোতে। বছরের পর বছর বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের কারণে সেসব পুরোনো বাড়িগুলোর অবস্থা হয়েছে আরও বেশি জরাজীর্ণ।

মৃতপ্রায় গ্রামটিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করার প্রয়াসে শহরের মেয়র লুসিও ফিওর্দালিসো অন্যান্য ইতালীয় গ্রামগুলোর সাফল্যের অনুকরণ করার চেষ্টা করছেন, যারা তাদের খালি বাড়িগুলো এক ইউরোতে বিক্রি করেছে। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সফলতা পাননি তিনি।

ছবি সৌজন্যে: কমিউনে ডি প্যাট্রিকা

ফিওর্দালিসো সিএনএনকে বলেন, 'আমরা প্রথমে সমস্ত পরিত্যক্ত বাড়িগুলো চিহ্নিত করেছি এবং মূল মালিকদের তাদের জরাজীর্ণ পারিবারিক সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে একটি আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানিয়েছি, তবে আমরা এক ইউরোতে মাত্র দুটি বাড়ি বিক্রি করতে পেরেছি।'

ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জনশূন্য হয়ে পড়া শহরগুলোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মালিকদের অনুমতি ছাড়াই পরিত্যক্ত বাড়িঘর বিক্রির এখতিয়ার থাকলেও প্যাট্রিকা এবং এর মতো অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে এটি হয় না।

ফিওর্দালিসো বলেন, 'বাড়িগুলো বিক্রির জন্য প্রথমে আমাদের বাড়ির মালিক বা তার উত্তরাধিকার কারা আছেন তা খুঁজে বের করতে হয়। তারপরে তারা অনুমতি দিলেই তখন আমরা বাড়িগুলো বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি। এ প্রক্রিয়া অনেক জটিল। অনেকটা অসম্ভব।' 

ফিওর্দালিসো জানান,যখন তারা বাড়ির মালিকদের এক ইউরোতে বাড়ি বিক্রির আহ্বান জানান তখন ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিলেন। ১০ জন বাড়ির মালিক তাদের বাড়ি বিক্রি করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা সরে দাঁড়ান। আর বাকিরা কোনো সাড়া দেননি। 

ক্রেতারা কী চান? 

ফিওর্দালিসো মনে করেন, যারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন তাদের সম্পত্তিতে অন্য আত্মীয়ের ভাগ থাকার কারণেই এমনটা করছেন। 

শহরগুলোর পরিত্যক্ত ভবনগুলো অনেকসময় একাধিক উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ করা থাকে। যার ফলে প্রত্যেকের বাথরুম, বারান্দা বা রান্নাঘরের মতো নির্দিষ্ট অংশের মালিকানা আলাদা আলাদা থাকে। এই ধরনের সম্পত্তি বিক্রির জন্য সমস্ত উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে লিখিত সম্মতি প্রয়োজন, যা প্রক্রিয়াকে জটিল করে দেয়।

আরও কিছু অসুবিধাগুলো হলো—এই সম্পত্তিগুলোর মালিকানাধীন একাধিক ব্যক্তিরা পরস্পর কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি। মতবিরোধের কারণগুলোও ভিন্ন ভিন্ন:  কারও কারও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল, কেউ বা একে অপর থেকে দূরে বিভিন্ন শহর বা দেশে বাস করছিল। এই সব কারণগুলোর কারণেই বিক্রয় প্রক্রিয়ায় আটকে আছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর মালিকানা উত্তরাধিকারদের মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় কাগজে কলমে নির্দিষ্ট করা ছিল না। যার ফলে এর প্রকৃত মালিক কে তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

ছবি সৌজন্যে: কমিউনে ডি প্যাট্রিকা

ফিওর্দালিসো জানান, বিদেশে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোতে পাড়ি জমানো পূর্ববর্তী সম্পত্তি মালিকদের বংশধরদের সন্ধানে উল্লেখযোগ্য অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই বংশধররা প্যাট্রিকার টাউন হলকে না জানিয়ে তাদের শেষ নাম পরিবর্তন করতে পারে বা বিদেশিদের কাছে তাদের ইতালীয় সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে। ফলস্বরূপ, এই ব্যক্তি বা তাদের উত্তরাধিকারীদের শনাক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল।

'এটা অনেকটা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো,' তিনি যোগ করেন।

প্যাট্রিকা তার এক ইউরো প্রকল্পের অংশ হিসেবে যে দুটো পরিত্যক্ত বাড়ি বিক্রি করতে পেরেছিল সেগুলো পুরোপুরি দু'জন স্থানীয়ের মালিকানাধীন ছিল। সুতরাং চতুর্থ প্রজন্মের চাচাতো ভাই বা প্রপিতামহ-নাতি-নাতিদের সাথে কোনও যোগাযোগের প্রয়োজন ছিল না এবং এজন্যই তারা কোনো জটিলতা ছাড়াই সম্পত্তি বিক্রি করতে পেরেছিল। 

পারিবারিক বন্ধন 

এছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আত্মীয়দের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে আইনি বিরোধের কারণে অনেকে তাদের অংশ বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারে। 

বিদেশে বসবাসকারী অনেক বাড়ির মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের মালিকানা সম্পর্কে তথ্য দিতে অনিচ্ছা পোষণ করেন। এর কারণ হলো সম্পত্তির ওপর বকেয়া ট্যাক্স। 

সম্পত্তির বকেয়া ট্যাক্স এবং বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য চার্জ, যা প্রতি বছর ২,৫০০ ইউরোর পরিমাণ হতে পারে। উপরন্তু, সম্পত্তির সাথে যুক্ত বকেয়া ইউটিলিটি বিলও থাকতে পারে। তাই এসব বকেয়া টাকা পরিশোধের ঝামেলা এড়াতেই অনেকে টাউন হলের কাছে তথ্য দিতে আগ্রহী হননি। 

প্যাট্রিকায় এক ইউরো বাড়ি বিক্রি প্রকল্প চালু না হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে এর পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর খারাপ অবস্থা। মালিকরা বিক্রি করতে ইচ্ছুক থাকলেও কিছু বাড়ি খুব জরাজীর্ণ হয়ে আছে যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। 

প্যাট্রিকার স্থানীয় বাসিন্দা জিয়ান্নি ভ্যালেকো এবং তার দুই ভাই পরীক্ষা করার জন্য তাদের বাবা-মায়ের পরিত্যক্ত বাড়িটি বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দেখা গেছে কেউ-ই বাড়িটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। 

ভ্যালেকো বলেন, 'হোক না এক ইউরো, তাও আমরা দেখতে চেয়েছিলাম বাড়িটি কেউ কিনে কিনা। এই অকেজো পাথরের স্তূপ থেকে মুক্তি পাব তাহলে।' 

তিনি আরও বলেন, 'অর্ধ শতাব্দী পার হওয়ার পর আমাদের পৈতৃক বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। ছাদ ও বেশিরভাগ দেয়াল ধসে পড়েছে, ঘাস ও ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। এখন এটি একটি খোলা ঘর। অবশিষ্ট ছিল শুধু এক টুকরো জমি, ঠিক মাঝখানে একটা কুৎসিত বাগান।' 

ভ্যালেকোর মতে, একজন প্রতিবেশী তাদের পুরানো জিনিসপত্র ফেলে দেওয়ার জন্য বাড়ির এক অংশ ব্যবহার করছিলেন।

তিনি বলেন, 'তখন আমরা বুঝতে পারি যে কেউ এটি কিনবে না। বাড়িটি পুনর্নির্মাণের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এখানে টাকা খরচ করে কোনো লাভ নেই, এর থেকে আশেপাশে একটি ছোট গ্রামীণ কুটির কেনা আরও মূল্যবান।' 

তবে সবগুলোর বাড়ির অবস্থা এরকম খারাপ নয়। অনেক বাড়িই আছে যেগুলো কিনতে ক্রেতারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মেয়র জানান, আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক ক্রেতা এক ইউরোর বাড়িগুলো দেখতে এসেছিলেন। যদিও তারা তাদের পছন্দমতো বাড়ি খুঁজে পাননি। 
এদিকে, ফিওর্দালিসো প্যাট্রিকাকে ক্রেতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নতুন কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তার লক্ষ্য শহরের আবেদন বাড়ানো এবং মানুষকে সেখানে বসতি স্থাপনে প্রলুব্ধ করা।

নতুন প্রকল্প

টাউন হল সম্প্রতি কিছু পুরোনো ঐতিহাসিক ভবনের বাহির সংস্কারের জন্য অর্থায়ন করেছে, যা অনেক স্থানীয়কে বছরের পর বছর অবহেলায় পড়ে থাকা তাদের নিজস্ব পারিবারিক বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেছে। 

আলেসান্দ্রা পাগলিয়ারোসি আরও একধাপ এগিয়ে তার স্বামীর ১৯৫০ এর দশকের প্রাসাদটিকে প্যাট্রিসিয়া নামে একটি বি অ্যান্ড বি হোটেলে রূপান্তরিত করেছেন।

স্থানীয় অর্থনীতিকে আবারও চাঙ্গা করে তুলতে মেয়র ট্যাক্সের ওপর সাময়িক বিরতি প্রদানের আদেশ দিয়েছেন। 

পাগলিয়ারোসি বলেন, 'আমরা প্রাসাদের ইন্টেরিয়র এবং ছাদ আবার নতুন করে সংস্কার করেছি। মেয়রকে ধন্যবাদ দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা সম্পত্তি অবশেষে সংস্কার করার উৎসাহ প্রদানের জন্য।' 

যারা এখানে বি অ্যান্ড বি বা বুটিক শপের মতো ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিবে তাদের ১০ বছরের জন্য বর্জ্য নিষ্পত্তি, বিজ্ঞাপন এবং পাবলিক স্পেস ব্যবহারের ওপর কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং পুনর্গঠন ব্যয়ের জন্য ট্যাক্স ক্রেডিটও দেওয়া হবে। 

পাগলিয়ারোসি জানান, একটি ছোট বি অ্যান্ড বি এর জন্য বছরে প্রায় ১২০০ ইউরো ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। 

বিদেশি যারা প্যাট্রিকায় এসে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করছেন তারাও স্থানীয়দের মতো একই ট্যাক্স সুবিধার পাবেন। এখন পর্যন্ত শহরে দুটি নতুন বেড এবং ব্রেকফাস্ট রেস্তোরাঁ (বি অ্যান্ড বি) এবং একটি সাধারণ রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। 

স্থানীয় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ইলারিও গ্রোসি প্যাট্রিকায় সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে অভিবাসী পরিবারের আমেরিকান বংশধরদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ লক্ষ্য করেছেন। তবে এই দর্শনার্থীরা শহরের আগে থেকে প্রস্তুত বাড়িগুলোকে আরও আকর্ষণীয় বলে মনে করেছেন। দুই বেডরুমের বাড়িগুলোর দাম ২০ হাজার ইউরো থেকে শুরু হয়। 

গ্রোসি বলেন, 'বিদেশিরা প্রাথমিকভাবে প্যাট্রিকায় পুরানো বাড়ি কেনার আগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে এগুলোর খারাপ অবস্থা দেখে অনেকে তাদের মন পরিবর্তন করে।'

পরিবর্তে, তারা টার্ন-কী অ্যাপার্টমেন্টগুলো কিনতে পছন্দ করে যা ইতিমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে বা কেবল ছোটখাটো মেরামতের প্রয়োজন। কারণ হিসেবে গ্রোসি বলেন, একটি নতুন বিল্ডিং থেকে বড় সংস্কার প্রয়োজন এমন একটি পুরানো বিল্ডিং কেনা বেশি ব্যয়বহুল।

এসব অসুবিধা সত্ত্বেও, ফিওর্দালিসো শহরের কিছু পরিত্যক্ত বাড়ি বিক্রি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রয়েছেন। 


অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.