বোয়িং: কোম্পানি কি সমস্যার গভীর খাদে!

আন্তর্জাতিক

বিবিসি
18 March, 2024, 01:40 pm
Last modified: 18 March, 2024, 01:56 pm
সমস্যার সূত্রপাত জানুয়ারিতে যখন পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের অব্যবহৃত জরুরি বহির্গমন দরজা মাঝ আকাশে খুলে পড়ে। এই ঘটনার জন্য বোয়িংকে ফৌজদারি তদন্তের পাশাপাশি বিমানে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং এটির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী এয়ারলাইন্সের চাপের মুখে আছে এবং এর খ্যাতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমেরিকান এয়ারলাইন্সের পাইলট ইউনিয়ন 'অ্যালাইড পাইলট অ্যাসোসিয়েশন'- এর প্রধান ক্যাপ্টেন ডেনিস তাজের জানিয়েছেন, "আমি সতর্ক অবস্থায় আছি যাতে আমাকে কখনো আর বোয়িং বিমানে উঠতে না হয়।"

তিনি বলেন, "আমি বিশ্বাস করি না তিন দশক আগেও প্রতিষ্ঠানটি যে প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে সবাইকে নিরাপদ রেখেছিল সেই প্রক্রিয়াগুলো এখন অনুসরণ করছে।"

তিনি জানিয়েছেন, তিনি যে বোয়িং বিমানের পাইলট ছিলেন সেটার নিরাপত্তা নিয়ে তিনি এখন শঙ্কিত।

সমস্যার সূত্রপাত জানুয়ারিতে যখন পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের অব্যবহৃত জরুরি বহির্গমন দরজা মাঝ আকাশে খুলে পড়ে।

ইউএস ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের একটি প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যে চারটি বোল্ট বিমানের দরজাকে নিরাপদে সংযুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয় সেগুলো ঠিকমতো না লাগানোর জন্য এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এই ঘটনার জন্য বোয়িংকে ফৌজদারি তদন্তের পাশাপাশি বিমানে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এই ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত না হলেও এটি বোয়িংয়ের কর্পোরেট সংস্কৃতির অভাব এবং সুরক্ষা মনোভাবের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

পাঁচ বছর আগে বোয়িং তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছিল যখন দুটো নতুন ৭৩৭ বোয়িং ম্যাক্স বিমান প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং তাতে ৩৪৬ জন নিহত হন।

দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ধরা হয়েছিল, ত্রুটিপূর্ণ ফ্লাইট কন্ট্রোল সফটওয়্যার যার বিবরণ নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল বোয়িংকে।

শুরুতে প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করে বোয়িং এই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে সম্মত হলেও পরবর্তীতে আদালতের শুনানিতে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিল। যাত্রীদের জীবনের থেকে আর্থিক লাভকে বেশী প্রাধান্য দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি অনেক অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছিল।

২০২০ সালের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাহী ডেভ ক্যালহাউন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বোয়িং নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিবে এবং আগের থেকে আরো বেশী ভালো করবে।

কিন্তু এই বছরের জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় চলমান তদন্ত সেই প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এ বছরের জানুয়ারিতে পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের অব্যবহৃত জরুরি বহির্গমন দরজা মাঝ আকাশে খুলে পড়ে। প্রতীকী ছবি: আলাস্কা এয়ারলাইন্স

এই মাসের শুরুর দিকে মার্কিন নিয়ন্ত্রক ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বলেছিল, বোয়িং এবং এর সরবরাহকারী স্পিরিট অ্যারোসিস্টেমের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের উৎপাদন প্রক্রিয়ার ছয় সপ্তাহের অডিট থেকে 'একাধিক উদাহরণ পাওয়া গেছে যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে'।

বোয়িংয়ের নিরাপত্তা সংস্কৃতি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং নিয়মিত কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চপদস্থদের ভয়ে অনেক কর্মী বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করে।

বোয়িংয়ের সাবেক সিনিয়র ম্যানেজার অ্যাডাম ডিকসন যিনি ৭৩৭ ম্যাক্স প্রোগ্রামে কাজ করেছিলেন তিনি এই ব্যাপারে সম্মত হয়ে বলেছেন, নির্বাহী এবং শ্রমিকদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব রয়েছে।

তিনি বলেন, "বোয়িংয়ের সংস্কৃতি এখন গত এক দশকেরও বেশি সময় থেকে বিষাক্ত হয়ে গেছে। আপনি নিরাপত্তা পদক্ষেপ বাড়াতে পারেন, আপনি বিভিন্ন পদ্ধতি যোগ করতে পারেন। কিন্তু একে অন্যকে অবিশ্বাস করার জন্য সেই পরিবর্তনগুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে যায়।"

এদিকে উৎপাদন সমস্যার জন্য কীভাবে নিরাপত্তাকে ঝুঁকি দেখা দেয় তার প্রমাণ এই সপ্তাহে পাওয়া গেছে।

মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) সতর্ক করে জানিয়েছে, ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানে ভুলভাবে সংযুক্ত করা তারের বান্ডিল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যার জন্য বিমানের ডানাগুলো নিয়ন্ত্রণের সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। যদি এটি সমাধান না করা হয় তাহলে পাইলট 'বিমানটির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে'। তাই বোয়িং এর আরো বিমানকে এর জন্য পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

বোয়িং এফএএর পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বলেছে, এটি অবিলম্বে এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করতে এবং নিরাপত্তা ও গুণমানকে শক্তিশালী করতে কাজ করছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের এবং যাত্রীদের আস্থা তৈরি করতে একটি বড় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

কিন্তু বিভিন্ন সংকটে গভীর খাদে পড়েছে বোয়িং!

এই বছরের ১১ মার্চ বোয়িংয়ের বিরুদ্ধে বিমান নির্মাণে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার নিয়ে করা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য ও প্রমাণ সরবরাহকারী জন বার্নেটের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি সাউথ ক্যারোলিনায় অবস্থিত বোয়িংয়ের কারখানায় ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে চাপের মধ্যে থাকা কর্মীরা উৎপাদন লাইনের বিমানে ইচ্ছাকৃতভাবে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেছিলেন।

বোয়িং তার দাবি অস্বীকার করেছে। কিন্তু তার অকাল মৃত্যু প্রতিষ্ঠানটিকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

বোয়িংয়ের এই সংকট এখন এয়ারলাইন্সের জন্যও সমস্যা তৈরি করছে।

রায়ানএয়ার সতর্ক করে জানিয়েছে, নতুন বিমান সরবরাহে বিলম্ব এই গ্রীষ্মে ইউরোপে যাত্রীদের জন্য খরচ বৃদ্ধি করবে। মার্কিন ক্যারিয়ার সাউথওয়েস্ট এই বছর তার ক্ষমতা কমানোর পরিকল্পনা করেছে কারণ এটি প্রয়োজনীয় বিমানগুলো ধরে রাখতে পারছে না।

কিছু গ্রাহক বোয়িং এর পরিবর্তে এয়ারবাসের বিমান ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বোয়িং থেকে এয়ারবাসে সমস্ত অর্ডার স্থানান্তর করা সম্ভব নয়।

চীনের বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কোমাক সি৯১৯ মডেলের বিমান তৈরি করছে যেগুলো ৭৩৭ ম্যাক্স এবং এ৩২০ নিও বিমানের বিকল্প হতে পারে।

কিন্তু এটি বাস্তবায়নে এখনো সময় লাগবে এবং ২০২৮ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ১৫০টি বিমান উৎপাদন করতে পারবে। এদিকে বাজারের চাহিদা পূরণ করতে বোয়িংয়ের বিকল্প নেই।

ফাউন্ডেশন ফর এভিয়েশন সেফটির নির্বাহী পরিচালক এড পিয়ারসনের মতে, এই সমস্যাগুলো জটিল কিন্তু সমাধানযোগ্য।

তিনি নিজে একজন প্রাক্তন বোয়িং হুইসেলব্লোয়ার (তথ্য ফাঁসকারী)। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে কয়েক বছর অনুরোধ করেছেন।

তিনি বলেন, "বোয়িং, প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহকারী, এয়ারলাইন্স এবং সরকারি সংস্থাগুলো এই সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। কিন্তু এই সমস্যাগুলো সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সৎ হওয়া।"

বোয়িং জানিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে, এটি 'সংকট সমাধানে সময় নিতে, উৎপাদন বন্ধ করতে বা সরবরাহ বন্ধ করতে কখনও দ্বিধা করেনি'।

প্রতিষ্ঠানটি আরো বলেছে, এটি একটি 'স্পিক আপ' প্রোগ্রাম চালু করেছে যা কর্মীদের সংকট জানাতে উৎসাহিত করবে।

 


অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়


 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.