ফসল নেই তো পাত্রী নেই! জলবায়ু যেভাবে প্রভাব ফেলছে ভারতের উপকূলীয় গ্রামগুলোয়

আন্তর্জাতিক

দ্য গার্ডিয়ান
14 March, 2024, 02:15 pm
Last modified: 14 March, 2024, 02:27 pm
বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে চলমান পরিবেশগত অস্থিরতা এবং ঘূর্ণিঝড়ের জন্য পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলীয় গ্রাম উদয়কানিসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে মাটি এবং পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি জমি, জীবিকা এবং বিয়ের সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়েছে

পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলীয় গ্রাম উদয়কানিতে বাড়ির দেয়ালগুলো একসময় শঙ্খ এবং সানাই দিয়ে সজ্জিত থাকতো কারণ এগুলো বর ও কনের জন্য শুভ বলে মনে করা হত। কিন্তু একসময় আনন্দ উদযাপনের কেন্দ্রস্থল এই গ্রামটিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কোন নববধূ আসেনি।

একদিকে সমুদ্র এবং অন্যদিকে মাঠ নিয়ে গড়ে ওঠা উদয়কানি গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী তান্দাহার গ্রামে একটি সুপার সাইক্লোন (ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার বা তার বেশি হলে সেটিকে 'সুপার সাইক্লোন' বলা হয়) প্রবলভাবে আঘাত হেনেছিল। ২৫ বছর আগে ওড়িশা রাজ্যে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড় উত্তর ভারত মহাসাগরে রেকর্ড করা সবচেয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছিল। বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে চলমান পরিবেশগত অস্থিরতার জন্য এই অঞ্চলে মাটি এবং পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি জমি, জীবিকা এবং বিয়ের সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়েছে।

৬৪ বছর বয়সী তান্দাহারের বাসিন্দা বৈদেহী কার্দি জানিয়েছেন, "মাটি যখন লবণাক্ত হয়ে যায় তখন আমাদের ফসলের আর্দ্রতা হারিয়ে যায়। ধীরে ধীরে পানি লবণাক্ত হয়ে গেল এবং আমাদের জীবন শুকিয়ে গেল। আমাদের ছেলেদের বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সবাই মনে করে আমাদের গ্রাম আর নিরাপদ নয়।"

ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির তথ্য অনুসারে, প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের উপকূল নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ ঘূর্ণিঝড়ের সংস্পর্শে এসেছে। বেশিরভাগই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় এবং পূর্ব উপকূলে আঘাত হানে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে চারগুণ বেশি ঘূর্ণিঝড় রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে গত বছরের জুনের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে নয়টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।

ওড়িশা রাজ্যের ২৮০ মাইল উপকূলরেখা বরাবর ২৮ শতাংশ ক্ষয়ক্ষতি রেকর্ড করা হয়েছে। রাজ্য বিধানসভাকে গত মার্চে জানানো হয়েছিল, রাজ্যের ১৬টি গ্রাম সমুদ্রের নিচে হারিয়ে গেছে এবং ২৪৭টি গ্রাম সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে একই পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে।

উদয়কানির ৭৪ বছর বয়সী বুধেশ্বর কার্দি বলেছেন, "১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আবারো শুরু করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। আমাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অধিকাংশই তাদের কৃষি জমি হারিয়েছে। সমুদ্র ভিতরের দিকে চলে আসায় আমরা আরো ভিতরের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছিলাম। আমরা ধীরে ধীরে আমাদের জমি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছি কিন্তু খুব একটা সফলতা পাইনি। এখন মনে হচ্ছে সমুদ্র প্রতি বছরই ভিতরের দিকে চলে আসছে।"

উদয়কানি গ্রামের একটি বাড়ির দেয়ালে বিবর্ণ হয়ে আসা ঐতিহ্যবাহী বিয়ের ছবি। গত এক দশকে এই গ্রামে কোন বিয়ের আয়োজন হয়নি। ছবি: ঐশ্বরিয়া মোহান্তি

৫৮ বছর বয়সী অর্জুন প্রধান পাঁচ বছর ধরে ছেলে অভিজিতের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। চার বছর আগে তিনি ছেলেকে শহরে চলে যেতে বলেন। তিনি বলেন, "একটা সময় ছিল যখন আমাদের গ্রামের পুরুষদের ২০ বা ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। আজ আমাদের ৩০ বছর বা তার থেকে বেশী বয়সীরা এখনো উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পায়নি।"

অর্জুন প্রধান আরো বলেন, "আমি আমার ছেলেকে গ্রাম থেকে চলে যেতে বলেছিলাম শুধু চাকরি খোঁজার জন্য নয়, একটা স্ত্রীর জন্যও। বিয়ে করার ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণত কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও আমি আমার ছেলের উপর কোনো নিয়ম চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি চাই সে ভালোভাবে থিতু হোক।"

শুধু বিয়ের সম্ভাবনা নয়, মাটির লবণাক্ততা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলের পানি পান করার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তান্দাহারের ৫০ বছর বয়সী কাঞ্চন বলেছেন, "কেউ আমাদের সাথে দেখা করতে আসলে রাতে থেকে যায় না। আমাদের কাছে পান করার জন্য উপযুক্ত পানি নেই। এমনকি যারা ত্বকের রোগকে ভয় পায় তাদের জন্য এই পানি দিয়ে গোসল করা অসম্ভব।"

গ্রামবাসীদের ১০ মাইল দূরের গ্রাম থেকে খাবার পানি আনার জন্য শস্য বা তেল বিনিময় করতে হয়।

কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ইউএন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ৮৩৩ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি মাটি ইতোমধ্যেই লবণাক্ত যার মধ্যে ১০ শতাংশ কৃষিজমি। কেউ কেউ অনুমান করছে, উচ্চ লবণাক্ততা সেচযোগ্য কৃষিজমির এক তৃতীয়াংশকে প্রভাবিত করে যেটি বছরে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য কৃষিজমি কমে আসছে, প্রথাগত জীবিকা (কৃষি) কমে যাচ্ছে। 

কার্দি বলেন, "আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে কৃষিকাজ করেছি কিন্তু আজ জমিতে ফলন হচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের বিদায় করা ছাড়া আমাদের আর কি উপায় আছে?"

উপকূলীয় গ্রামগুলো এখন বেশির ভাগ বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের আবাসস্থল। যুবকেরা দূরে চলে যাওয়ায় তাদেরই জমিতে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু অভিবাসনের পরেও অনেক যুবকের জন্য জীবনসঙ্গী পাওয়া এক‌টি কঠিন কাজ।

হায়দ্রাবাদে চলে আসা অভিজিৎ প্রধান বলেন, "এখানে আমার কাজ স্থায়ী নয়। আমি একটি হোটেলে ওয়েটার হিসেবে কাজ করি। আমি গত দুই বছরে তিনটি চাকরি পরিবর্তন করেছি। যখনই আমি কাজের বাইরে থাকি, আমি বাড়ি ফিরে যাই। এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাউকে বিয়ে করতে কে রাজি হবে?"

এই অঞ্চলের যুবকদের চাকরির জন্য তান্দাহারের মতো গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ছবি: ঐশ্বরিয়া মোহান্তি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উদয়কানির একজন ৩২ বছর বয়সী ব্যক্তি বলেছেন, তার পরিবার তার জন্য পাত্রী খুঁজতে চেষ্টা করার পর তাকে চারবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, "তারা প্রত্যেকেই আমার বাড়িতে আসার পর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল। আমার বাবা-মা আমাকে একজন পাত্রী খুঁজে চেন্নাইতে গিয়ে বিয়ে করতে বলেছেন। সেখানে আমি বর্তমানে কাজ করছি। তারা ভয় পায়, যদি সেই মেয়ে বা তার পরিবার আমাদের গ্রামে আসে তাহলে তারাও আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে।"

তান্দাহারের ২৭ বছর বয়সী সত্য কার্দির বাবা-মা এবং দাদা-দাদিও তাকে একটি পাত্রী খুঁজতে বলেছিলেন যেখানে তিনি কাজ করেন। কিন্তু সত্য কার্দি জানিয়েছেন, "আমি এখনও আমার মন স্থির করতে পারিনি যে আমি এমন কাউকে বিয়ে করব কি না যার সাথে আমার অনেক সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে এবং আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকে। এছাড়া আমি কীভাবে মাসে ১৭ হাজার রুপির সামান্য বেতনে আমার পরিবার চালাবো?"

কার্দির বাবা জগন্নাথ (৫৩) সমৃদ্ধ ক্ষেত এবং প্রচুর ফসলের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, "আমরা আমাদের ফসল (ফলন) পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি কিন্তু লবণাক্ততার জন্য সেগুলোর ক্ষতি হয়েছে। আমাদের ফসল কখনই পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পায়নি। আমরা যে সবজি চাষ করেছি তা কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। আমরা আমাদের নিজেদের খরচের জন্য পর্যাপ্ত ফসল সংগ্রহ করতে পারিনি, জীবিকা অর্জনের জন্য পণ্য বিক্রি করা তো দূরের কথা।"

উদয়কানি সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে একসময় কূপ ও জলাধার থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিকে লবণাক্ত করে তুলেছে। সেই থেকে গ্রামবাসীরা বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল যেহেতু এখানে উৎপাদিত হওয়া প্রধান ফসল ধান। যার ফলে বৃষ্টিপাত এবং মাটির অবস্থার উপর নির্ভর করে ফসল কাটা এবং রাজস্ব প্রতি বছরে পরিবর্তিত হয়।

এই অঞ্চলের সামাজিক কর্মী এবং তথ্য প্রচারকারী একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের মালিক এনএ আনসারি বলেছেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই গ্রামগুলোতে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়েছে। এর জন্য বন বিভাগ সমুদ্রের ভিতরে চলে আসা প্রশমিত করতে ক্যাসুরিনা গাছের বন তৈরি করছে। কিন্তু এই গ্রামগুলোকে সাহায্য করার জন্য গ্রামবাসীদের ক্ষতির পরিমাণ এবং আসন্ন পরিণতি সম্পর্কে এখনও সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি।"

 


অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়


 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.