আরব আমিরাতের মরুভূমিতে উৎপাদিত হচ্ছে কৃত্রিম হীরা

আন্তর্জাতিক

সিএনএন
08 March, 2024, 09:55 am
Last modified: 08 March, 2024, 09:33 pm
দুবাই মাল্টি কমোডিটি সেন্টারের সিইও ও নির্বাহী চেয়ারম্যান আহমেদ বিন সুলায়েম বলেন, “আরব আমিরাতের একটি শীর্ষ হীরা ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। এক্ষেত্রে তেলের ব্যবসার পাশাপাশি বৈচিত্র্য আনতে ল্যাবে-উত্পাদিত হীরা শিল্পে প্রসারিত করা অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।” 

হীরা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর দুর্লভ ধাতুগুলোর মধ্যে একটি। প্রকৃতিতে এটি খুঁজে পাওয়া তুলনামূলকভাবে বেশ কঠিন।

হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ হীরার সন্ধানে পৃথিবীর গভীরে খনন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট গর্তের তৈরি হয়েছে। গভীরতার দিক থেকে যা ৬২৫ মিটার কিংবা ২,০৫০ ফুট। 

হীরা খুঁজতে গিয়ে খনন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের প্রতিই ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে। এই কাজটি একদিকে যেমন বিপজ্জনক; অন্যদিকে এটি বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে।

কিন্তু হীরার চাহিদা মেটাতে খননই একমাত্র সমাধান নয়। বরং পাশাপাশি ভিন্ন উপায়ও রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল জেম সোসাইটি তথ্যমতে, ১৯৫০-এর দশকে প্রথম ল্যাবে হীরা উৎপাদন করা হয়েছিল।

সময়ের সাথে সাথে ল্যাবে তৈরি হীরার প্রযুক্তিটি বিকাশ লাভ করেছে। বর্তমানে ল্যাবগুলি প্রায় ৮০ ভাগ সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের হীরা তৈরি করছে। এতে খনন কিংবা নেতিবাচক প্রভাবের মতো জটিলতা নেই।

ছবি: সিএনএন

কৃত্রিমভাবে হীরা উৎপাদনের সুবিধা হচ্ছে এটি যেকোনো অঞ্চলেই করা যেতে পারে। এমনকি মরুভূমির মতো জায়গায়ও তা করা সম্ভব।

সংযুক্ত আরব আমিরাত হীরা আমদানি ও রপ্তানিতে প্রথমসারির দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবে আপাতত সেখানে হীরার কোনো প্রাকৃতিক খনি নেই। তাই দেশটির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ সাবেগ শুধু হীরার ব্যবসাই নয়, বরং এটিকে উৎপাদন করার সম্ভাবনাও দেখেছেন।

তারই ধারাবাহিকতায় সাবেগ ২০২২ সালে দুবাই-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ২ডিওটি৪ ডায়মন্ডস প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই আরব আমিরাতের প্রথম কোম্পানি যেটি ল্যাবে উৎপাদিত হীরা তৈরি, কাটা এবং পালিশের কাজ করে থাকে। 

এ সম্পর্কে সাবেগ বলেন, "আমাদের ধারণা ছিল হীরাকে বরং ভোক্তাদের কাছে সহজলভ্য করা। এক্ষেত্রে সারা বিশ্ব থেকে হীরা নিয়ে আসার পরিবর্তে বরং স্থানীয়ভাবে তা উত্পাদন ও বিক্রি করা।"

ডায়মন্ড তৈরি 
কৃত্রিমভাবে ডায়মন্ড তৈরি বিষয়টিও বেশ জটিল। এ সম্পর্কে সাবেগ বলেন, "প্রাকৃতিক ডায়মণ্ডের সাথে এর মূল পার্থক্য হচ্ছে আমরা চাপ, তাপ ও গ্যাস নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। কিন্তু খনির হীরায় তার প্রয়োজন হয় না। বরং তা প্রাকৃতিকভাবেই হয়ে থাকে।"

সাবেগ জানান, একটি ডায়মন্ড উৎপাদন করতে আরেকটি ডায়মন্ডের দরকার হয়। সেটা ল্যাবে উৎপাদিত কিংবা প্রাকৃতিক একটা হলেই চলে। এটিকে বলা হয়ে থাকে সীড; যা সাধারণত প্রায় ০.৩ থেকে ০.৬ মিলিমিটার পুরু হয়ে থাকে।

সীডটিকে মূলত একটি চুল্লির ভেতরে রাখা হয়। পরবর্তীতে এটিকে হাইড্রোজেন, মিথেন, অক্সিজেন ও আর্গনের মতো গ্যাসের সংস্পর্শে আনা হয়। এটিকে ১৮০ টর পর্যন্ত চাপ দেওয়া হয়; যা মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় চাপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। একইসাথে ১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে পাতলা স্লাইসে কার্বন জমা হয়। এরপর এটি আয়তনে যেন আরও বাড়ে সেটির জন্য অপেক্ষা করা হয়। 

সাবেগ বলেন, "বিভিন্ন প্যারামিটারের ওপর ভিত্তি করে ডায়মন্ডের উৎপাদনের সময় ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে উৎপাদনে গতি যত কম হবে মান তত বৃদ্ধি পাবে।"

২ডিওটি৪ কোম্পানিটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.০১ মিলিমিটার গতিতে হীরা উৎপাদন করে। অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় খণ্ডটি দুটি কাগজের শিটের পুরুত্বের সমপরিমাণ দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়।

ছবি: সিএনএন

এক্ষেত্রে হীরাটির উচ্চতা কমপক্ষে পাঁচ মিলিমিটার হয়ে গেলে টুকরোটিকে 'ব্লক' বলা হয়। তখন তিনটি কাজ করা যেতে পারে। এক, এটিকে সীড তৈরির জন্য আরও কাটা যেতে পারে; যা থেকে চুল্লিতে আরও হীরা উৎপাদন করা যাবে।

দুই, চাহিদার উপর ভিত্তি করে রত্নটি কেটে পালিশ করা যেতে পারে। এটি তখন হয় জুয়েলার্স ও ডিজাইনারদের কাছে বিক্রি করা যেতে পারে। তিন, ডায়মন্ডটিকে ঘরে ডিজাইন করা একটি গহনার টুকরোয় পরিণত করা যেতে পারে।

হীরা শিল্পের বিশ্লেষক ও পরামর্শদাতা মার্কিনি পল জিমনিস্কির মতে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত ল্যাবে তৈরি হীরা উৎপাদনে সবচেয়ে আধিপত্য বিস্তার করছে। এক্ষেত্রে চীন ও ভারত বিশ্বব্যাপী হীরা উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ বাজার দখল করে রেখেছে।

গহনা ছাড়াও ল্যাবে উৎপাদিত হীরা একাধিক শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বিশেষত কংক্রিট ও মার্বেলের মতো ঘন উপাদানগুলিকে কেটে সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়।

জিমিনিস্কি বলেন, "চীনের কয়েক দশক ধরেই শিল্পে বস্তু থেকে কিছু ঘষে তুলে ফেলতে কৃত্রিম হীরা উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি গয়নায় ব্যবহারের জন্যও দেশটিতে কৃত্রিম হীরা উৎপাদনের পরিকাঠামো আছে।" 

অন্যদিকে ভারত হীরা কাটা ও পালিশ করার ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য দেখিয়ে চলছে। এমনকি বৈশ্বিক বাজার দখল করতে দেশটি ল্যাবে উৎপাদিত ডায়মন্ড প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে। গত বছর দেশটির এই শিল্পে কর সংক্রান্ত সংস্কার হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম হীরা শিল্পকে আরও প্রসারিত করতে অতিরিক্ত তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে। 

দুবাই মাল্টি কমোডিটি সেন্টারের সিইও ও নির্বাহী চেয়ারম্যান আহমেদ বিন সুলায়েম বলেন, "আরব আমিরাতের একটি শীর্ষ হীরা ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। এক্ষেত্রে তেলের ব্যবসার পাশাপাশি বৈচিত্র্য আনতে ল্যাবে-উত্পাদিত হীরা শিল্প প্রসারিত করা অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।" 

বিন সুলায়েম বলেন, "ল্যাবে উৎপাদিত ডায়মন্ড প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের সাথে সংযোগের প্রতীক। এটির বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা এই রূপান্তরের যুগে দুবাইকে একটি অগ্রগামী শক্তি হিসাবে দেখতে উচ্ছ্বসিত।"

বিল সুলায়েম আরও বলেন, "ষাট বছর আগে কাউকে ল্যাবে উৎপাদিত হীরার কথা বললে তারা আপনার দিকে ফিরেও তাকাতেন না। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম খনির সাথে যুক্ত নৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলির বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে বিলাসবহুল পণ্যের ক্রয়ক্ষমতার দিকে মানুষ ক্রমেই আকৃষ্ট হচ্ছে। তাই এই শিল্পকে মানিয়ে নিতে হবে।"

ছবি: সিএনএন

তবে জিমনিস্কির মতে, ল্যাবে উৎপাদিত ডায়মন্ড শিল্পে নিজেদের অবস্থান তৈরি করা আরব আমিরাতের জন্য খুব একটা সহজ হবে না। কেননা দেশটিকে এক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে।" 

উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য কোম্পানি ২ডিওটি৪ এর দেখানো পথই অনুসরণ করছে। যার মধ্যে এইচআরএ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ইভিকিউএ ডায়মন্ডস অন্যতম; যা এইচআরএ গ্রুপের একটি অংশ। কোম্পানিটি মাত্র কয়েক মাস আগে আমিরাতে নিজেদের ল্যাব স্থাপন করেছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্র্যান্ড ইটিকা ও ইয়াইনি শুধু ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ড ব্যবহার করে তাদের ডিজাইন বাজারজাত করছে।

বিন সুলায়েম বলেন, "ল্যাবে উৎপাদিত হীরা শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি যে, হীরা বিক্রি করে আপনার সময় নষ্ট করবেন না। বরং চূড়ান্ত শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করুন।"

তবে সাবেগের জন্য আশার বিষয় হল, ২ডিওটি৪ এমন একটি দেশে ল্যাবে তৈরি হীরা উৎপাদনের যাত্রা শুরু করেছে যেটি বর্তমানে বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি হীরা আমদানি করে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এখন আমাদের উচিত হবে শিল্পটিতে একটি মান নির্ধারণ করা।" 


অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.