নগদ সহায়তা, গ্যাস, পানি সংযোগের সুবিধা দিয়ে নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন মোদি

আন্তর্জাতিক

রয়টার্স
28 February, 2024, 06:35 pm
Last modified: 28 February, 2024, 06:45 pm
রয়টার্স জানাচ্ছে, দিনকে দিন আরও নারী বিজেপিকে ভোট দিতে শুরু করেছেন। যার পেছনে অবদান রাখছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির প্রতিটি বাড়িতে পাইপের নিরাপদ পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও স্যানিটারি সুবিধা পৌঁছে দিতে মোদি সরকারের উদ্যোগ। 

বিজেপির সিনিয়র নেতা শিবরাজ সিং চৌহানকে এক অনুষ্ঠানে নারীদের সাথে জনসংযোগে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: আনুশ্রী পদনবিশ/ রয়টার্স

বিধবা মা আর ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে ভারতের মধ্য প্রদেশের এক বস্তিতে থাকেন নয়নতারা গুপ্ত। গত কয়েক বছরে দৈনন্দিন জীবন কিছুটা সহজ হয়েছে তাঁর। এজন্য নয়নতারা কৃতিত্ব দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল– ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-কে। 

২৮ বছরের এই নারী একাই মানুষ করছেন সন্তানদের, ওদের বাবা সে দায়িত্ব নেয়নি। কঠিন জীবন সংগ্রামে সাহায্যের জন্য তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশংসাই করেন। জানালেন,  গত দুটি সাধারণ (লোকসভা) নির্বাচনে তিনি বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও দলটিকে ভোট দেবেন। 

এর আরেকটি কারণ হিসেবে, নারী কল্যাণে দলটি ভালো মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানান নয়নতারা। বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার নারীদের নগদ অর্থ সহায়তা, পাইপের মাধ্যমে নিরাপদ পানি, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্যাস সংযোগও দিচ্ছে। নিজের ছোট্ট বস্তির ঘরে এসব সুবিধা পেয়ে নয়নতারাও খুশি।  

"তিনি (মোদি) আমাদের (নারীদের) জন্য অনেক কিছু করেছেন"- অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর।

লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মধ্যপ্রদেশ ও হরিয়ানা রাজ্যের এমন ৫১ জন নারীর সাথে কথা বলেছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। ভারতের কেন্দ্রীয় এসব অঞ্চল নির্বাচনী রাজনীতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানকার নারীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানারই চেষ্টা করে রয়টার্স। 

রয়টার্স জানাচ্ছে, কেবল নয়নতারাই নন, দিনকে দিন আরও নারী বিজেপিকে ভোট দিতে শুরু করেছেন। যার পেছনে অবদান রাখছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির প্রতিটি বাড়িতে পাইপের নিরাপদ পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও স্যানিটারি সুবিধা পৌঁছে দিতে মোদি সরকারের উদ্যোগ। 

ভারতীয় নারীদের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে বেশি ভোট দেওয়ার একটি ঐতিহ্য ছিল। কারণ এ দল থেকেই দেশটির পেয়েছিল প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। 

অন্যদিকে, হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপির রাজনীতিতে শুরুতে কেবল পুরুষদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্য করবার মতোন। দলটির পুরুষতান্ত্রিক ভাবমূর্তি শুরুতে নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেনি ততোটা। কিন্তু,ক্ষমতায় থাকার ১০ বছরে সে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন মোদি। ফলে গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক দূরবস্থা, কৃষক আন্দোলন, উচ্চ বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি নিয়ে অসন্তোষ থাকার পরেও– নারী সমর্থন বৃদ্ধির ঘটনা দলটিকে ব্যালট বাক্সে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।       

ভারত-ভিত্তিক ভোট-সমীক্ষা সংস্থা সি-ভোটার রয়টার্সকে জানায়, তাদের জরিপে আভাস মিলেছে দেশটির ৪৭ কোটি নারী ভোটারদের ৪৬ শতাংশ আসছে নির্বাচনে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন জোটকে আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪৩ শতাংশ।  এতে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে বিজেপি।  

দেশটির নির্বাচন কমিশন বলেছে, ২০১৯ সালের পর এবার দ্বিতীয়বারের মতো পুরুষদের তুলনায় উচ্চ সংখ্যক নারী এবছরের নির্বাচনে ভোট দিতে পারে।   

বিজেপির জন্য নারীদের সমর্থনে বড় উল্লম্ফন ঘটবে বলে জানানো হয় সি-ভোটারের পূর্বাভাসে। যা আগের ধারাবাহিকতারই অংশ। পাঁচ বছর আগের সাধারণ নির্বাচনে নারী ভোটারদের ৩৬ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেন, ২০১৪ সালে এই হার ২৯ শতাংশ ছিল বলে জানিয়েছে দ্য হিন্দুর প্রকাশিত লোকনীতি-সিএসডিএস জরিপ।   

এককথায়, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ  হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছে বিজেপির আবেদন বাড়ছে। সার্বিকভাবে দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ভোটারদের পক্ষে টানার অনুকূলে কাজ করছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নতি শুধু নারীদের নয়, বরং সব লিঙ্গের ভোটারকেই আকৃষ্ট করে থাকে। 

১৬ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদের জায়গায় হিন্দু দেবতা রামের মন্দির গত মাসে উদ্বোধন করেন নরেন্দ্র মোদি। এই উদ্বোধনের পরে করা মতামত জরিপে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ঘটনার যে উচ্ছ্বাস, তাতে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী সহজেই পার হবে বিজেপি। একইসময়ে, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর জোট ভাঙ্গন ঠেকাতেই হিমশিম খাচ্ছে। 

দারিদ্র্য মোকাবিলা ও অপরাধ দমন

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের হার রীতিমতো আশঙ্কাজনক, যা রোধ করতে মোদি সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুইয়েরই রেকর্ড আছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশটিতে দৈনিক ৮৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। 

এরপরেও, রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়াদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন নারী বলেছেন, তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের আরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভুপালের আদিবাড়ি তানিয়া সিনহার। দুবাইয়ে কর্মরত এই নারী সম্প্রতি ভুপালে আসেন। রয়টার্সকে তানিয়া জানান, তিনি মোদিকেই ভোট দেবেন, তবে বিজেপি সরকার নারীর নিরাপত্তায় আরও কাজ করুক এমন প্রত্যাশা করেন।  

সর্বভারতীয় পর্যায়ে বিজেপির বিরোধিতা করবার মতো সামর্থ্য থাকা একমাত্র দল কংগ্রস। তারা বলেছে, নারীদের নানান সমস্যা, দাবিদাওয়া আরও ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে কংগ্রস দেশব্যাপী এক জনসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দলটির দাবি, মূল্যস্ফীতি এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সার্বিকভাবে নারীরা বিজেপির প্রতি সন্তুষ্ট নয়।    
 
কংগ্রসের নারী শাখার প্রধান অলকা লাম্বা বলেন, "নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের কারণে নারীরাই সবচেয়ে বেশি দুর্দশার শিকার হয়। তার ওপর আছে নিরাপত্তা-জনিত উদ্বেগ। নারীরা নানান রকম শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।"

২০০৪ সালের পর থেকে ভারতে নারীদের কর্মসংস্থানের হার হয় কমেছে নাহলে স্থবির থেকেছে, কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে অভাব-অনটনের চাপের কারণে তা বেড়েছে বলে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। 

মধ্যপ্রদেশের গৌতমপুর গ্রামের একজন নারী দিনমজুর পূজা দাওয়ার বলেন, অন্যদের কৃষি খামারে বা ইটভাটায় কায়িক পরিশ্রম দেওয়াই হচ্ছে তাঁর কর্মসংস্থানের একমাত্র উপায়। বেশিরভাগ কর্মদাতাই তাঁকে দিনে সাড়ে তিনশ রূপির (৪ ডলার) কম মজুরি দেয়, যা জাতীয় গড় মজুরির দুই-তৃতীয়াংশ মাত্র। 
খড়ে ছাওয়া নিজের মাটির কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়টার্সকে পূজা বলেন, "(আমার মতোন) নারীদের জন্য কোনো কাজ নেই। দুই-এক সপ্তাহ চেষ্টা করে এক বা দুই দিনের জন্য কাজ জোগাড় করতে পারি। তা দিয়ে শুধু দৈনন্দিন খরচ কোনোরকমে চলে।" 

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবে– সেবিষয়ে কিছু বলতে চাননি পূজা। তিনি বলেন, "আমি কারোরই বিরোধিতা করতে চাই না। আমি শুধু কাজ চাই আর শান্তিতে থাকতে চাই।"

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.