টিকটক ব্রেইন: আপনার সন্তানের অমনোযোগিতার কারণ?

আন্তর্জাতিক

দ্য উইক ডটকম
28 February, 2024, 09:50 am
Last modified: 28 February, 2024, 12:25 pm
বিশেষ করে শিশু ও কিশোর বয়সীরা টিকটক বেশি মাত্রায় ব্যবহার করে থাকে। ফলে তাদের ওপর এর প্রভাবও অনেক বেশি। এমনকি বেশকিছু গবেষণায় এটি ব্যবহারে মনোযোগ ধরে রাখার সময়ের তারতম্য ঘটাতে শুরু করে বলে ধারণা পাওয়া যায়। 

প্রতিদিনের জীবনে অভূতপূর্ব এক প্রভাব বিস্তার করেছে টিকটক। তবে গত কয়েক বছরে প্ল্যাটফর্মটিকে বেশকিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা থেকে শুরু করে এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মানসিক স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের ক্রিয়ার উপর কেমন প্রভাব ফেলছে, সেটি নিয়েও হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।

বিশেষ করে শিশু ও কিশোর বয়সীরা টিকটক বেশি মাত্রায় ব্যবহার করে থাকে। ফলে তাদের ওপর এর প্রভাবও অনেক বেশি। এমনকি বেশকিছু গবেষণায় এটি ব্যবহারে মনোযোগ ধরে রাখার সময়ের তারতম্য ঘটাতে শুরু করে বলে ধারণা পাওয়া যায়। 

প্ল্যাটফর্মটি ছোট ভিডিওর মধ্য দিয়ে ব্যবহারকারীদের বিনোদন পৌঁছে দেয়। সাধারণত তরুণরা তাৎক্ষণিক ভালোলাগা কাজ করবে এমন জিনিসে অংশগ্রহণ করা থেকে নিজেদের সহজে বিরত রাখতে পারে না। ফলে তারা সাধারণত এ ধরনের ছোট আকারের টিকটক বা ইনস্টাগ্রাম ভিডিও অতিরিক্ত পরিমাণে দেখে থাকে। এ মাধ্যমগুলোর এই প্রভাবকে 'টিকটক ব্রেইন' হিসেবে অভিহিত করেছেন জুলি জার্গন।

সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে আসক্ত হয়ে পড়লে মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন ঘটে? 

'রিঅ্যাকশন' দেওয়ার বা পাওয়ার নেশায় মস্তিষ্ক টিকটক ভিডিওর মতো এসব সংক্ষিপ্ত বিনোদনধর্মী ভিডিও দেখতে আমাদের প্ররোচনা দেয়। সিনসিনাটি চিলড্রেন'স হসপিটালের 'রিডিং অ্যান্ড  লিটারেসি ডিসকভারি সেন্টার'-এর পরিচালক জন হুটোন এই মাধ্যমকে 'ডোপামিন যন্ত্র' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

ডোপামিন এক ধরনের 'নিউরোট্র্যান্সমিটার' রাসায়নিক পদার্থ, যা নিউরনের সাথে সমস্ত শরীরের যোগাযোগ করতে সাহায্য করে। আমরা কোন ধরনের পুরস্কারের আশা করলে মস্তিষ্ক থেকে নিষ্কৃত হয় এই ডোপামিন। সুস্বাদু খাবার, নেশা জাতীয় দ্রব্য অথবা টিকটকের মজার কোন ভিডিও ইত্যাদি উপভোগ্য জিনিস আরও আনন্দদায়ক করে তোলে এই ডোপামিন।

এক্ষেত্রে ডোপামিন আনন্দদায়ক অনুভূতির তৈরি করে এবং আরও বেশি আনন্দ খুঁজে পেতে প্ররোচনা দেয়। 

নিউরোসাইকোলজিস্ট ডা. সানাম হাফীজ বলেন, "যখন আপনি টিকটকে একটার পর একটা ভিডিও দেখতে থাকেন এবং তা আপনাকে হাসায় তখন ডোপামিনের একটা ধাক্কা পায় মস্তিষ্ক।"

টিকটকে কন্টেন্ট পছন্দ না হলেই তা পরিবর্তন করে পছন্দের অন্য কন্টেন্টে চলে যাওয়া যায়। এই চক্র বারবার চলতে থাকলে আমাদের মস্তিষ্ক এক সময় ডোপামিনের এই ছোট ছোট পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এভাবেই সংক্ষিপ্ত এসব কন্টেন্ট দেখার নেশা তৈরি হয়। কলেজগামী শিক্ষার্থীদের এই ছোট ভিডিও দেখার প্রবণতাকে পর্যবেক্ষণ করে চীনের গুইঝও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স এন্ড ইকোনমিক্স এবং ওয়েস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিটির গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে এই পর্যালোচনা। 

দুই বছর আগে ২০১৯ সালের 'নেচার কমিউনিকেশন' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও কন্টেন্ট খুবই স্বল্প সময়ে দেখতে অভ্যস্ত জনগণদের মধ্যে 'সমষ্টিগত মনোযোগ ধরে রাখার সময়' ক্রমশ কমছে বলে দাবি করা হয়। 

শিশুদের মনোযোগের ব্যাপ্তি বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

শিশুরা কিংবা তরুণদের অধিকাংশ কাজ করতে প্রয়োজন দীর্ঘ মনোযোগ। পড়াশোনার মতো কাজগুলোতে তারা নির্দিষ্ট মনোযোগ দিতে জয়। যার পুরোটাই মস্তিষ্কের যে অংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী অর্থাৎ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কাজ।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক চিলড্রেন্সের সেন্টার ফর অ্যাটেনশন এন্ড লার্নিং এর ক্লিনিক্যাল পরিচালক মাইকেল ম্যানোসবলেন, "নির্দিষ্ট বা নির্দেশিত মনোযোগ মূলত অমনোযোগিতা কমাতে, মনোযোগ ধরে রাখতে এবং সঠিক উপায়ে মনোযোগ সরাতে সাহায্য করে। পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার ঠিক করার জন্য খুবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হয়। বাচ্চাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সুগঠিত হয় না বলে তাদের জন্য এ ধরনের মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর। ২৫ বছর পর্যন্ত সবারই এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।"

প্রতিনিয়ত টিকটকের পরিবেশ পরিবর্তিত হওয়ায় নিবিড় মনোযোগের প্রয়োজন হয় না। শিশুরা এই পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তাদের মস্তিষ্ক 'ডিজিটাল নয়' এমন সব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মনোযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। 

'অ্যাটেনশন স্প্যান: এ গ্রাউন্ডব্রেকিং ওয়ে টু রিস্টোর ব্যালান্স, হ্যাপিনেস এন্ড প্রোডাক্টিভিটি' বইয়ের লেখক গ্লোরিয়া মার্ক বলেন, "তরুণরা এ ধরনের উচ্চ মাত্রার 'স্টিমুলেশনের' মধ্য দিয়ে গেলে তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক আনন্দ এবং পুরস্কৃত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এটাই তাদের সংক্ষিপ্ত মনোযোগের কারণ।" 

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কি সমস্যাটি নিয়ে ভাবছে?

তরুণদের মধ্যে অতিরিক্ত ব্যবহার কমানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলো তাদের অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে বিশেষ ফিচার যোগ করেছে। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের টিকটক রাত ৯টার পর কোনো ধরনের 'নোটিফিকেশন' দেয় না। এছাড়া 'বাহিরে যাও' ও 'নাস্তা করে নাও' জাতীয় আরো কিছু 'রিমাইন্ডার' যুক্ত করেছে টিকটক। 

এছাড়া ইউটিউব ১৮ বছরের নিচের সকলের জন্য 'অটোপ্লে' বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে করে তারা ব্রেক নিতে বা ঘুমাতে যেতে পারে।

ইউটিউবের মুখপাত্র আইভি চই বলেন, "সংক্ষিপ্ত ভিডিওগুলো তরুণদের প্রভাবিত করছে। তবে এটা শুরু মাত্র। আমরা কীভাবে তরুণ এবং তাদের পরিবারের জন্য আরো উপযুক্ত শর্টস বা সংক্ষিপ্ত ভিডিও বানানো যায় তার পরিকল্পনা করছি। এজন্য প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষের বিশেষজ্ঞদের সাথে একসাথে কাজ করার কথাও ভাবা হচ্ছে।"


অনুবাদ: জেনিফার এহসান 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.