‘বোম্বশেল’ খ্যাত সুন্দরী হেডি ল্যামার যেভাবে ওয়াইফাই আবিষ্কারে সাহায্য করেন!
আন্তর্জাতিক
১৯৪০-এর দশকে হেডি ল্যামার ছিলেন হলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন। এমজিএমের ভাষ্যমতে সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে পরিচিত হেডি ল্যামারের ক্যামেরা লেন্সের বাইরেও আরেকটি পরিচয় আছে।
আজকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ওয়ারলেস যোগাযোগ তাঁর আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয়েছে। তাঁকে অনেকে 'মাদার অফ ওয়াইফাই' বলে থাকেন।
আলজিয়ার্স জিগফেল্ড গার্লের মত কালজয়ী সিনেমার জন্য ল্যামারকে সবাই চিনেলেও বেশিরভাগ লোক জানে না যে তিনি ওয়াইফাই, ব্লুটুথ এবং স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তির বিকাশে অবদান রেখেছিলেন। তাঁর বাস্তব জীবনের অর্জন পর্দায় অভিনীত যে কোনও ভূমিকাকে ছাড়িয়ে গেছে। 'বোম্বশেল' নামে একটি ডকুমেন্টারিতে তাঁর অভিনয় ও উদ্ভাবনী প্রতিভা দুটোর চিত্রই ওঠে এসেছে।
হেডউইগ ইভা মারিয়া কিসলার ১৯১৪ সালে ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় এবং চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। ১২ বছর বয়সে, তিনি ভিয়েনায় একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন, যা চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৮ বছর বয়সে, চেক চলচ্চিত্র 'এক্সট্যাসি' (১৯৩৩)-এ সাহসী অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয় তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
১৯৩৭ সালে, কিসলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর নতুন জীবনের জন্য তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে 'হেডি ল্যামার' রাখেন। এমজিএমের লুই বি মেয়ার তাঁর অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে একটি ছবির চুক্তি দেন। তাঁর প্রথম হলিউড চলচ্চিত্র ছিল চার্লস বোয়ারের সাথে আলজিয়ার্স (১৯৩৮)।
হলিউডে লামার দ্রুত তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা এবং চরিত্রের গভীরতার জন্য পরিচিত একজন খ্যাতিমান অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে তিনি ক্লার্ক গেবল, স্পেন্সার ট্রেসি এবং জিমি স্টুয়ার্টের মতো অন্যান্য কিংবদন্তি অভিনেতাদের সাথে প্রায় ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
হলিউডের চলচ্চিত্র তারকা হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করলেও অভিনয় করে সন্তুষ্ট ছিলেন না ল্যামার। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে এবং অবসর সময়ে রাতে বাড়িতে থাকা অবস্থায় তিনি নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন।
বোম্বশেলের একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে, তিনি তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা, তাঁর ব্যর্থ পরীক্ষা (ইফারভেসেন্ট কোলা ট্যাবলেট) এবং তাঁর প্রেমিক হাওয়ার্ড হিউজেসের রেসিং বিমানের উন্নতি সাধন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, "আমাকে নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হয় না, এগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায় চলে আসে।"
ল্যামারের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অর্জন হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা 'গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা'। তাঁর আবিষ্কৃত এ যোগাযোগ ব্যবস্থাই আধুনিক বেতার যোগাযোগের ভিত্তি তৈরি করেছে। সুরকার জর্জ অ্যান্থেইলের সাথে মিলে তিনি 'ফ্রিকোয়েন্সি হপিং' নামের এ প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন।
১৯৪২ সালে হেডি ল্যামার এবং সুরকার জর্জ অ্যান্থেইল 'ফ্রিকোয়েন্সি-হপিং' প্রযুক্তির পেটেন্ট নেন। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার তাদের সংকেতের বাধা এড়াতে ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর মধ্যে অনবরত সুইচ করে। তাদের আবিষ্কারের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য জ্যাম-প্রতিরোধী রেডিও-নিয়ন্ত্রিত টর্পেডো তৈরি করা এবং জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ব্যর্থ করা।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনী এটি ব্যবহার করেনি। ১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় মার্কিন নৌবাহিনী কর্তৃক এর প্রথম পরীক্ষামূলক সংস্করণ ব্যবহার করা হয়।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিগুলো সুইচ করার জন্য লামারের উদ্ভাবনী পদ্ধতি স্প্রেড স্পেকট্রাম প্রযুক্তির বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এটি আজকের ওয়াইফাই, জিপিএস এবং ব্লুটুথ যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তি। তবে ল্যামার তাঁর এ উদ্ভাবনী প্রতিভার জন্য একটি পয়সাও পাননি।
অথচ লামারের উদ্ভাবনী দক্ষতাকে প্রকাশ না করে সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁর ছয়টি বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ এবং তাঁর প্রেমের জীবনের কাহিনি ছাপাচ্ছিল।
'স্যামসন এবং ডেলিলা', 'জিগফেল্ড গার্ল', 'হোয়াইট কার্গো' এবং 'এক্সপেরিমেন্ট পেরিলাস'-এর মতো হেডি ল্যামারের প্রধান চলচ্চিত্রগুলোতে তাঁর অ্যাকশনের চেয়ে চেহারা ও অবয়বের দিকে বেশি মনোনিবেশ করা হয়েছিল। তাঁর চরিত্রগুলো দেখানো হয়েছিল ন্যূনতম সংলাপ ও পুরুষ দৃষ্টির জন্য সুন্দর বস্তু হিসেবে। ল্যামার নিজেই, যিনি পর্দার সৌন্দর্যকে গতিহীন এবং বোকা বলে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কেন তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজকে একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ এটি এমজিএমের বিপণন কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
গণমাধ্যমে বৈচিত্র্যময় এবং সঠিক প্রতিনিধিত্ব কেন গুরুত্বপূর্ণ তাঁর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হেডি ল্যামারের জীবন। যদি তাঁর উদ্ভাবনী প্রতিভাকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হত এবং তিনি যদি তাঁর ক্যারিয়ারে নিজের মতো বুদ্ধিমান চরিত্রগুলো চিত্রিত করতেন তবে লোকেরা তাঁর সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাঁর বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানতে পেরে এতটা অবাক হত না। এটি ব্যাখ্যা করে যে গণমাধ্যম কীভাবে সামাজিক উপলব্ধি এবং প্রত্যাশাগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে এবং কেন প্রত্যেকের জন্য পর্দায় ইতিবাচক এবং বিচিত্র উপায়ে নিজেকে উপস্থাপন করা অপরিহার্য।
হেডি ল্যামার, তাঁর অভিনয় এবং আবিষ্কারের বাইরে, দেশপ্রেমেও নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি তাঁর তাঁরকা খ্যাতি ব্যবহার করে যুদ্ধের বন্ড বিক্রি করেন। এক অনুষ্ঠানে ২৫ হাজার ডলার মূল্যের বন্ড কিনলে কাউকে চুম্বনের প্রস্তাব দেন তিনি। এছাড়া তাঁর প্রচেষ্টায় এক সন্ধ্যায় একটি ইভেন্ট থেকে প্রায় সাত মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছিলেন, যার পুরোটাই যুদ্ধে দান করে দেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে হেডি ল্যামারকে 'ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেকট্রাম' প্রযুক্তিতে অবদান রাখায় আমেরিকার ন্যাশনাল ইনভেন্টোর্স হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.