মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা যেভাবে ভারতের ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি’কে চ্যালেঞ্জ জানাল
ভারতের ঝাড়খণ্ডে ১৩ বছর বয়সী এক মেয়ে মুখোমুখি হয় এক নির্মম অভিজ্ঞতার। প্রায় ছয় বছর আগে মেয়েটি তার বাবাকে জানায়, তাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। বাবা রঞ্জিত নৃশংস এই ঘটনার উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য লড়াই শুরু করেন। যদিও ভারতে এমন সাহসিকতার গল্প খুব কমই শোনা যায়।
নিজের মেয়ের সাথে হয়ে যাওয়া অবিচারের প্রতিবাদ করতে রঞ্জিতকে যেতে হয়েছে নিজ গ্রাম ও সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে। তারই ধারাবাহিকতায় এই কৃষক বাবা অপরাধের কথা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জানান এবং অভিযুক্ত তিনজনকে বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে মামলাটি চালিয়ে যান।
বাস্তব জীবনের এই ঘটনাটিই তুলে ধরা হয়েছে পুরস্কার বিজয়ী 'টু কিল আ টাইগার' ডকুমেন্টরিতে। ভারতীয়-কানাডীয় পরিচালক নিশা পাহুজা এটি তৈরি করেছেন।
ডকুমেন্টরিতে ধর্ষণের বিচারলাভের জন্য পরিবারটির দীর্ঘ ১৪ মাস ধরে লড়াইয়ের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অঞ্চলটিতে একজন নারী স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণই যেন বড় ভাগ্যের ব্যাপার। কেননা সেখানে বিপুল পরিমাণে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মামলা পর্যন্ত করা হয় না।
২০১৭ সালে ৯ এপ্রিল। সন্ধ্যার দিকে কিরণ (ছদ্মনাম) একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে মেয়েটি তার বাবা-মাকে ছাড়াই থেকে গিয়েছিল। আর সেটিই যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
মধ্যরাতে গ্রামের তিনজন লোক টেনে হিঁচড়ে কিরণকে জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং তার ওপর হামলা চালায়। অভিযুক্তদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইও রয়েছে।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী ধর্ষিত নারীর নাম গোপন রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে ডকুমেন্টরিটিতে তার নাম ঠিকই প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু অনস্ক্রিনে তাকে দেখিয়ে সুক্ষ্ম প্রতিবাদ জানানো হয়।
পরিচালক পাহুজা বলেন, "ডকুমেন্টরিটির কাজ শেষ হওয়ার সময় কিরণ প্রাপ্তবয়স্ক বয়স ছিল। সেই সময় তার বাবা-মায়ের সাথে ছবিটি দেখার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান না। তিনি সামনে এসে অন্য ভুক্তভোগীদের অনুপ্রাণিত করতে চান।"
মেয়ের বিচার চেয়ে রঞ্জিত যখন মামলা করেন, তখন তার পরিবার গ্রামের বহু মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়। কেননা গ্রামবাসীদের অনেকেই নির্যাতনকারীদের কোনো একজনের সাথে কিরণকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কেননা সেখানে এমনটা করারই রীতি হয়েছে।
ডকুমেন্টরিতে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রঞ্জিতের পরিবারের বঞ্চনার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেখানে গ্রামবাসীরা ভুক্তভোগী নয় বরং অভিযুক্তের পক্ষে ছিলেন। কেউ কেউ উল্টো নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে না পারায় রঞ্জিতের উপহাস করছিলেন।
এতসব চাপের মধ্যেও কৃষক বাবা রঞ্জিত এবং তার স্ত্রী জগন্তী হাল ছেড়ে দেননি। বরং ডকুমেন্টরিতে রঞ্জিত বলেন, "যখন আমি আমার মেয়ে কথা চিন্তা করি, তখন আমার ভয় চলে যায়।"
পরিচালক পাহুজা বলেন, "রঞ্জিত খুব বেশি কথা বলেন না। তাই তার মুখেই যেন সবকিছু ফুটে ওঠে। তিনি একজন অত্যন্ত সৎ মানুষ।"
পরিচালক পাহুজা মূলত মামলাটি সম্পর্কে জানতে পারেন যখন তিনি সৃজান ফাউন্ডেশনের একটি প্রজেক্টের হয়ে একটি সিনেমা তৈরি করছিলেন। ঐ প্রজেক্টেটি ছিল নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সেখানে রঞ্জিত নিজেও ঐ প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন।
সৃজান ফাউন্ডেশনের সমাজকর্মীরা রঞ্জিতের পরিবারকে মামলাটির বিষয়ে সহায়তা করছিলেন। এরমধ্যে একজন সমাজকর্মী নির্মাতা পাহুজাকে জানান, 'মামলাটি একটি গেইম চেঞ্জার ছিল'।
ঐ সমাজকর্মী বলেন, "একজন বাবা তার মেয়ের জন্য ধর্ষণের বিচারের দাবিতে মামলা লড়ছেন। এটা কোন ছোট ঘটনা নয়। বরং এটা খুব কমই হয়ে থাকে।"
তবে গ্রামবাসীর বক্তব্য শুনলেই বোঝা যায় যে, মামলা চালানো কতটা কঠিন ছিল। গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, "এটা গ্রামেই মীমাংসা করে ফেলা যেত।" অন্যদিকে আরেক নারী বলেন, "তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দিলেই ভালো হতো।"
পাহুজার ডকুমেন্টারিটিতে দেখা যায়, রঞ্জিতকে ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচিতে আদালত ভবনে বিচারের আশায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে প্রসিকিউটরের কাছে রয়েছে প্রায় একই ধরণের ৫০০ মামলা। তবে এই মামলাগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে ঠিকভাবে তদন্ত করা হচ্ছে না।
মামলার বিচারকাজ যত এগুতে থাকে, গ্রামবাসীরা রঞ্জিতকে ততই হুমকি দিতে থাকে। স্থানীয় নেতারা তাকে বারবার সতর্ক করে এবং গ্রামের সম্প্রীতির কথা চিন্তা করে মামলাটি তুলে নেওয়ার কথা বলেন।
পাহুজা বলেন, "২০১২ সালে দিল্লির একটি বাসে এক তরুণীকে গণধর্ষণ ও হত্যার পর ভারতের আইন পরিবর্তন করা হয়েছিল। 'দ্য প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন এগেইন্টস সেক্সুয়াল অফেন্সেস এক্ট' আরও জোরদার করা হয়েছে। তবে যা দ্রুত পরিবর্তন হয়নি সেটি হল এই সংক্রান্ত সংস্কৃতি।"
পাহুজা আরও বলেন, "ভারতে আমরা পুরুষত্বের সংজ্ঞা কিংবা ছেলেদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে না পারলে সংবাদের এমন শিরোনাম ও ভারতে নারীদের উপর সহিংসতা কমবে না। কেননা এই সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে আমরা যেভাবে ছেলেদের বড় করি সেটি।"