গাজাবাসীদের আশ্রয় দিতে মিশরকে রাজি করাতে গোপনে চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল

আন্তর্জাতিক

নিউ ইয়র্ক টাইমস
07 November, 2023, 02:00 pm
Last modified: 07 November, 2023, 02:11 pm
গাজার বসবাসরত ফিলিস্তিনি বাসিন্দারাও মিশরে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, এর ফলে ফের 'নাকবা' এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

চলমান যুদ্ধে গাজা থেকে মিশরে কয়েক লাখ বেসামরিক বাসিন্দাদের স্থানান্তরের জন্য গোপনে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে ইসরায়েল৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছয়জন বিদেশী সিনিয়র কূটনীতিকের বরাত দিয়ে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলি নেতা ও কূটনীতিকরা ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকটি দেশের কাছে এমনটা প্রস্তাব করেছেন। এক্ষেত্রে মিশরকে রাজি করাতে তারা প্রস্তাবটিকে একটি 'মানবিক উদ্যোগ' হিসেবে তুলে ধরেছেন। যাতে করে গাজার বেসামরিক নাগরিকেরা 'অস্থায়ীভাবে' প্রতিবেশী মিশরের সিনাই মরুভূমিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে পারেন। এক্ষেত্রে তেল আবিবের যুক্তি এই যে, এতে করে গাজায় চলমান সহিংসতা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বাঁচানো সম্ভব হবে৷ 

তবে ইসরায়েলের এমন প্রস্তাব বেশিরভাগ দেশই প্রত্যাখ্যান করেছে। এই তালিকায় রয়েছে তেল আবিবের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও। কেননা দেশগুলির আশঙ্কা, এই ধরনের পদক্ষেপ খোদ মিশরকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। একইসাথে ইতিহাস বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে তাদের মাতৃভূমি থেকে চিরতরে বিতাড়িত করতে পারে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে গোপনে এমনটাই জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কূটনীতিবিদ। কেননা বিষয়টি বেশ সংবেদনশীল ও গোপন কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ৷ স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনটির ঐ হামলায় প্রায় ১৪০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। তারই পাল্টা জবাব হিসেবে গাজায় ক্রমাগত বোমা হামলা করছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার ফিলিস্তিনও নিহত হয়েছে। 

এমতাবস্থায় মিশরের শরনার্থী হিসেবে গাজাবাসীদের আশ্রয়ের প্রস্তাবটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিন৷ তাদের আশঙ্কা, এই কৌশল ব্যবহার করে তেল আবিব প্রায় ২০ লাখ গাজাবাসীকে বাস্তুচ্যুত করে অঞ্চলটির দখলে নিতে পারে। 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন ঘিরে যুদ্ধের সময় প্রায় ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। তাদের নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যথায় আশ্রয়  নিতে হয়৷ যাকে ইতিহাসে 'নাকবা' বা বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়।  

তৎকালীন সময়ে বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের বংশধরদের অনেকেই সতর্ক করছেন যে, চলমান যুদ্ধে গাজায় একই রকমের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ বিশ্ব সাক্ষী হতে পারে দ্বিতীয় 'নাকবা' বা বিপর্যয়ের।

এদিকে সমর্থন আদায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সেখান থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য প্রদান করা হয়নি। 

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার পর থেকে হামাসকে দমনের নামে গাজায় ক্রমাগত হামলা অব্যহত রেখেছে ইসরায়েল। এক্ষেত্রে উপত্যকাটিতে স্থল অভিযান পরিচালনার জন্য উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিনাঞ্চলে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তেল আবিব। 

কিন্তু ইসরায়েল প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের মিশরীয় সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ দেয়নি৷ যদিও বর্তমানে সেই সুযোগও নেই। কেননা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সীমান্তটি বন্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে মিশরের পক্ষ থেকেও ফিলিস্তিনিদের অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ সম্পর্কে মিশর সরকারের একজন মুখপাত্রের কাছে জানতে চাওয়া হয়৷ তবে তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং তিনি মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির দেওয়া একটি বক্তৃতা উল্লেখ করে এমন সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। 

নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আল-সিসি বলেন, "মিশর ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর এবং সিনাইয়ে আশ্রয় প্রদানের বিষয়টি সম্পূর্ণরুপে প্রত্যাখ্যান করছে। কেননা এটি ফিলিস্তিনি চূড়ান্ত দুরবস্থা জারি রেখেই সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।"

তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গাজাবাসীদের মিশর ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশে অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করার ধারণাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন।

যেমন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির আইনপ্রণেতা ও জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানি ডানন গাজা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার ধারণাকে সমর্থন করেন। তার যুক্তি, এতে করে ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযান পরিচালনার সময় আরও ভালোভাবে নিজেদের কৌশল প্রয়োগ করতে পারবে৷ একইসাথে বেসামরিকদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে। 

ফোনকলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড্যানন বলেন, "আমরা আমাদের সৈন্য ও সকল বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের মাত্রা কমানোর চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি শুধু মিশর নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজার বাসিন্দাদের সমর্থন ও গ্রহণের জন্য সত্যিকারের চেষ্টা চালাবে।"

একইসাথে ড্যানন জানান, ধারণাটি বাস্তবায়নে শুধু ইসরায়েল নয়, বরং মিশর সরকারের সম্মতিরও প্রয়োজন রয়েছে। তবে তিনি বর্তমানে সরকারের কোনো অংশ নয়৷ তাই ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই ধারণা বাস্তবায়নের ঠিক কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টকরে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।

এমনকি সামরিক অভিযান শেষে হামাসকে নির্মূল করা হলে গাজার ভবিষ্যত কী হবে সেটা নিয়েও অনেকেই সন্দিহান। তখন ভূখন্ডটি সাময়িকভাবে কারা এবং কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। 

গত ২৭ অক্টোবর গাজায় স্বল্প মাত্রায় স্থল অভিযান পরিচালনা শুরু করে ইসরায়েল৷ এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, অঞ্চলটি থেকে হামাসকে নির্মূল করে জিম্মি থাকা প্রায় ২৪০ জনকে উদ্ধার করতে হবে। তবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে করতে পারলে পরবর্তীতে গাজার নেতৃত্বে কে দেবে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এরমধ্যে একটি প্রস্তাব হতে পারে, গাজাকে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা যারা কি-না ফিলিস্তিন সরকারের কাছে অঞ্চলটি হস্তান্তরের আগে শহরটির অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে ইসরায়েল যদি গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সম্মত না হয় তবে কেউই হয়তো এই দায়িত্ব নিতে চাইবে না।

অন্যদিকে কিছু ইসরায়েলি কট্টরপন্থী গ্রুপ ও রাজনৈতিক নেতারা গাজার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুতের পক্ষে। যেমন লিকুদ পার্টির আইনপ্রণেতা এরিয়েল ক্যালনার ১৯৪৮ সালের মতো আরেকটি নাকবার আহ্বান জানিয়েছেন। 

গত ৮ অক্টোবর এরিয়েল ক্যালনার বলেন, "এখন, লক্ষ্য একটাই, নাকবা। গাজায় নাকবা প্রযোজ্য করা।"

গাজা ইস্যুতে মিশর সীমান্তে তদারকি, বিবাদে মধ্যস্থতাকারী ও ত্রান সরবারাহে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে দেশটি নিজেই বর্তমানে বেশ অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে গাজায় সহিংসতা দেশটিতে আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে৷ 

মিশরের সামরিক বাহিনী এমনিতেই নিজ দেশে বিদ্রোহ দমনে লড়াই করেছে। এমতাবস্থায় দেশটি আশঙ্কা করছে যে, ফিলিস্তিনিদের আকস্মিক অভিবাসন উত্তর সিনাইকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। একইসাথে পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ব্যবহার করে ইসরায়েলে আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। যা মিশরকে ইসরায়েলের সাথে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

গাজার বসবাসরত ফিলিস্তিনি বাসিন্দারাও মিশরে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, এর ফলে নতুন একটি 'নাকবা' এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

এই বিষয়ে বোমা হামলায় বিপর্যস্ত গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা আমিদ আবেদ (৩৫) এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, "একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে আমি আরেকটি 'নাকবা' হতে দিতে পারি না৷ আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাব না।"

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গত মাসে অবশ্য জানান যে, স্থল অভিযানের পর গাজার উপর ইসরায়েলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ইচ্ছে নেই।

এদিকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ক্ষমতাবিহীন এক বিভাগ গত ১৩ অক্টোবর একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে৷ রিপোর্টে 'গাজা থেকে সিনাইয়ে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার' সুপারিশ করা হয়েছে৷

ডকুমেন্টটি 'লোকাল কল' নামের ইসরায়েলি এক গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এর সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তিনি এটি শুধুমাত্র একটি খসড়া রিপোর্ট বলে এড়িয়ে যান।  

অন্যদিকে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রী আমিচে ইলিয়াহু বলেন, দখলের পর গাজার জমি প্রাক্তন ইসরায়েলি সৈন্যদের দেওয়া উচিত যারা গাজায় যুদ্ধ করেছিল। কিংবা প্রাক্তন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের এই জমি দেওয়া উচিত যারা ২০০৫ সাল পর্যন্ত এখানে বসবাস করতেন। 

পরবর্তীতে আমিচে ইলিয়াহু ফের গত রবিবার বলেন, "ইসরায়েলের উচিত গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার বিষয়টি বিবেচনা করা।" যদিও এমন ধারণার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে খোদ নেতানিয়াহু সরকার।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েল মিশরের কাছ থেকে গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে সেখানে মোট ২১ টি ইহুদি বসতি স্থাপন করে তারা।

তবে ২০০৫ সালে ইসরায়েলি সরকার তাদের বাসিন্দাদের ইসরায়েলে সরিয়ে নিয়ে যায়। একইসাথে তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অঞ্চলটি হস্তান্তর করে।

কিন্তু এর দুই বছর পর ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা দখল করে নেয় হামাস। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মিশর গত ১৬ বছর ধরে উপত্যকাটিতে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.