গাজায় শহুরে যুদ্ধ যে কারণে ইরাকের চেয়েও নৃশংস হবে

ইসরায়েলের কাছে গাজাযুদ্ধ অস্তিত্বের প্রশ্ন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হামাসকে আইএস-এর মতো বলে অভিহিত করেন — এমন এক শত্রু, যার সঙ্গে আর আপসের অবকাশ নেই। ইরাকে আইএসবিরোধী লড়াইয়ের সময় স্বদেশবাসীর জন্য ইরাকি সেনারা যেটুকু সহানুভূতি দেখিয়েছিল, গাজার ফিলিস্তিন বেসামরিক নাগরিকদের জন্য আইডিএফ-এর অতটা নেই। ইরাকের মসুলের যুদ্ধের সময় দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব, খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মকর্তারা, সবাই বেসামরিক নিরাপত্তায় বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
মসুলের যুদ্ধে শহরটির সব অংশ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শহরের তুলনামূলক আধুনিক পূর্ব অংশটি কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অন্যদিকে পশ্চিমের পুরোনো অংশকে ইরাকি বাহিনী অনেকবেশি রক্ষণশীল ও আইএস-এর প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে বিবেচনা করেছিল। যুদ্ধে মসুলের এ অংশই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 'নিজের এলাকায় লড়াই করার বদলে অন্য এলাকায় লড়াই করলে বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সমান সহানুভূতি নাও থাকতে পারে,' বলেন ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অভ রেড ক্রস-এর বেসামরিক নাগরিকরক্ষা ইউনিট-এর একজন উপদেষ্টা ক্যারোলাইন বদত।
গাজায় চলমান যুদ্ধে নিয়মিত নিহত হচ্ছেন বেসামরিক নাগরিকেরা। হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজায় আট হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে নিহত শিশুর সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দ্য ইকোনমিস্ট ধারণা করেছে, গাজা'র বাসস্থানগুলোর এক-দশমাংশ ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়েছে। এর ফলে গৃহহীন হয়েছেন দুই লাখ ৮০ হাজারের বেশি গাজাবাসী।
অবকাঠামোর অবস্থান রয়েছে এমন এলাকায় যুদ্ধ সবসময় নৃশংস হয়। ২০০৪ সালে ফালুজায় মার্কিন বাহিনীর প্রথম আক্রমণে ৬০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন, যা ওই এলাকার জনসংখ্যার ০ দশমিক ২ শতাংশ। ওই বছরের দ্বিতীয় আক্রমণে ৮০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন, শহরটির বেশিরভাগ ভবন ধ্বংস হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয়েছিল ইরাকের মসুলে। ২০১৬–১৭ সালে মসুলে অন্তত নয় হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিলেন। শহরের ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ৮০ শতাংশই ছিল আবাসিক।
এসব নজির থেকে বলা যেতে পারে, গাজায় চলমান ধ্বংসাত্বক এ যুদ্ধ ঐতিহাসিক নিরিখে খুব বেশি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানর কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ও সবচেয়ে বড় পার্থ্যকটি হলো বেসামরিক ব্যক্তিদের পরিস্থিতি।
মসুলে আইএস বেসামরিক নাগরিকদের শহর ছেড়ে পালাতে বাধা দিয়েছিল। যদিও তারপরও অনেক মানুষই শহর ছাড়েন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে রাশিয়াও ইউক্রেনের মারিওপলে অবরোধের সময় সাধারণ মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে দিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যদের এ ধরনের যুদ্ধবিরতির আহ্বান ইসরায়েল এখন পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় গাজার ভৌগোলিক পরিস্থিতি বেশি জটিল। ইসরায়েল গাজাবাসীকে বাড়ি ছাড়তে বললেও অনেকেই তা শোনেননি, কারণ এসব ব্যক্তিদের বেশিরভাগ আগে থেকেই শরণার্থী — তাদের আশঙ্কা, এবার আবার বাস্তুচ্যুত হলে তারা আর একই স্থানে ফিরতে পারবেন না। এদিকে গাজার দক্ষিণে মিশরও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আরবান ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞ আমস ফক্স বলেন, 'গাজার ভেতরে যুদ্ধ অতীতের সমধর্মী যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী হতে পারে।' যেসব শরণার্থীরা ইতোমধ্যে গাজার দক্ষিণে আশ্রয় নিয়েছেন তারাও অমানবিক পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছেন।
গাজার হাসপাতালগুলোতে কেবল সাড়ে তিন হাজারের মতো শয্যা রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। অন্যদিকে মসুলের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্রন্ট লাইনের বেশ কাছেই অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করতে পেরেছিল। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সব জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া না হলে তারা গাজার বেসামরিক ব্যক্তিদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাবে না।
দ্বিতীয় মৌলিক পার্থক্যটি হলো, গাজার সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোর মিশ্রণ। ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর আগে মসুলে দুই বছর অবস্থান করেছিল গোষ্ঠীটি। এই কম সময়ের মাঝেই এটি শহরের ভেতরে বিস্ময়কর বহুস্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষাবেষ্টনী তৈরি করেছিল।
অন্যদিকে হামাস গাজায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। অর্ধশতাব্দী ধরে এটি গাজায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে, গাজা উপত্যকাও শাসন করেছে ১৬ বছর ধরে। হামাসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে গাজার বেসামরিক অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে, এমনকি শহরটির মাটির তলায়ও।
তৃতীয় পার্থ্যকটি হলো, বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা। যদিও ইসরায়েলের দাবি, এটি বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়, তারপরও গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বোমা হামলা এই ইতিহাসে নজিরবিহীন। যুদ্ধের প্রথম ছয়দিনে এটি গাজায় ৬,০০০ বোমা ফেলেছে যা মার্কিন ও পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশনের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি।
আগের যুদ্ধগুলোতে ইসরায়েলি সামরিক মানচিত্রে ফিলিস্তিনি হাসপাতাল ও ত্রাণকেন্দ্রগুলো অনাক্রমণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। অতীতে এসব স্থাপনার কিছুতে ইসরায়েলি হামলা হয়েছিল, তবে সেগুলো ইচ্ছাকৃত নয় বলে দাবি ইসরায়েলের। কিন্তু চলমান যুদ্ধে ইসরায়েল হাসপাতালগুলোও খালি করতে নির্দেশ দিয়েছে। এসব হাসপাতাল হামাস কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে ইসরায়েলের।
এদিক থেকেও মসুলের সঙ্গে গাজার তুলনা টানা যায়। আইএস মসুলের হাসপাতালগুলো দখল করে রেখেছিল। এসব হাসপাতালে আক্রমণ চালানো হবে কি না তার সিদ্ধান্ত নিতেই কয়েক সপ্তাহ ব্যয় করেছিলেন ইরাকি কমান্ডারেরা। শেষপর্যন্ত যখন নিশ্চিত হওয়া গেল, হাসপাতালগুলো আর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উপযুক্ত নেই, তখন ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই সেগুলোতে হামলা চালানো হয়েছিল।
ইরাক ও ফিলিস্তিনের সর্বশেষ পার্থক্যটি হলো যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দাতথ্য। মসুলে স্থানীয় জনগণ, যাদের অনেকেই আইএসকে ঘৃণা করত, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল। আবার বিপরীতক্রমে, ২০১৭ সালে সিরিয়ার রাক্কায় আইএস-এর বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ থেকে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলি গোয়েন্দাবাহিনী ৭ অক্টোবরের হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি যা তাদের মারাত্মক ব্যর্থতা। স্থলযুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে হয়তো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভান্ডার থাকবে। কিন্তু হামাসের বিরুদ্ধে গাজার মানুষদের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি আইডিএফ-এর।
গত কয়েক সপ্তাহ মারাত্মক নিষ্ঠুর ছিল গাজার মানুষদের জন্য। সামনের সপ্তাহগুলো আরও নিষ্ঠুর হবে।