৭০ বছরের যাত্রা পেরিয়ে শেষবারের মতো খাবার পরিবেশন করতে যাচ্ছে ইন্ডিয়া ক্লাব রেস্টুরেন্ট 

আন্তর্জাতিক

রয়টার্স
15 September, 2023, 01:15 pm
Last modified: 15 September, 2023, 01:25 pm
মূলত ভারতীয় ঘরানার খাবার পরিবেশনের জন্য বিখ্যাত রেস্টুরেন্টটির পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় সাময়িকভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাই আপাতত রেস্টুরেন্টটির গ্রাহকেরা আগামী রবিবারই শেষবারের মতো এখানে ভারতীয় খাবারের স্বাদ উপভোগের সুযোগ পাবেন।  

লন্ডনের বিখ্যাত ইন্ডিয়া ক্লাব রেস্টুরেন্টের সাথে জড়িয়ে আছে ভারতের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এবার প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পর আগামী রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বন্ধ হতে যাচ্ছে অসংখ্য স্মৃতি বিজরিত এই রেস্টুরেন্টটি।

মূলত ভারতীয় ঘরানার খাবার পরিবেশনের জন্য বিখ্যাত রেস্টুরেন্টটির পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় সাময়িকভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাই আপাতত রেস্টুরেন্টটির গ্রাহকেরা আগামী রবিবারই শেষবারের মতো এখানে ভারতীয় খাবারের স্বাদ উপভোগের সুযোগ পাবেন।

সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম এক সড়কের পাশে হোটেল স্ট্র্যান্ড কন্টিনেন্টালের ভেতরে অবস্থিত লাউঞ্জ-কাম-রেস্টুরেন্টটি লন্ডনে বসবাসরত দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের চার বছর পর এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ব্রিটেনভিত্তিক ভারতীয় স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইন্ডিয়া লীগের সদস্যরা মিলেই মূলত এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংগঠনটি ছিল একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ যারা ভারত থেকে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে প্রচারণা চালাতো।

১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় অভিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য দেখাসাক্ষাৎ ও যোগাযোগের একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্র হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন ইন্ডিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। এছাড়াও ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও আইনপ্রণেতা শশী থারুরের বাবা চন্দ্রন থারুরও ক্লাবটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯০'র দশকে মার্কার পরিবার এই সম্পত্তিটি ইজারা হিসেবে কিনে নেয়।

কয়েক দশক ধরেই ইন্ডিয়া ক্লাব রেস্টুরেন্ট নিয়মিত মসলাদার দোসা কিংবা চিকেনসহ নানা খাবার পরিবেশন করে আসছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লন্ডনবাসীর কাছে যা ব্যাপকভাবে বিখ্যাত।

ক্লাবটি সম্পর্কে শশী থারুর বলেন, "বহু শিক্ষার্থী, সাংবাদিক এবং ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ক্লাবটি বাড়ি থেকে দূরে যেন নিজেদের আরেকটি বাড়ির মতোন। এটিতে সাশ্রয়ী মূল্যে সহজে ভালো মানের ভারতীয় খাবার পাওয়া যেত। পাশাপাশি পরস্পরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা এবং বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য এটি বেশ আনন্দদায়ক একটি স্থান ছিল।"

আসলে অনেকদিন ধরেই রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বছর দুয়েক আগে রেস্টুরেন্টের মালিক ইয়ডগার মার্কার ও তার মেয়ে ফিরোজা মার্কার 'সেভ ইন্ডিয়া ক্লাব' আন্দোলনের মাধ্যমে রেস্টুরেন্টটি টিকিয়ে রাখার পক্ষে হাজারো লোকের স্বাক্ষর আদায়ের পর এটি ভেঙে দেওয়া প্রতিরোধে সক্ষম হন। কিন্তু গত সপ্তাহে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী ১৭ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে ইন্ডিয়া ক্লাবের দরজা।

ইন্ডিয়া ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা ফিরোজা মার্কার রয়টার্সকে জানান, ক্লাবটি চলতি সপ্তাহে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। রেস্টুরেন্টটির জন্য আশেপাশেই নতুন একটি জায়গা খোঁজা হচ্ছে।

ইন্ডিয়া ক্লাবের অন্দরসজ্জাও করা হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের কফিশপগুলোর আদলে, যেখানে মানুষ চা-সিগারেট খেতে খেতে সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতো ঘণ্টার পর ঘন্টা। আজ থেকে ৭০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও, ক্লাবের ঝাড়বাতি, ফরমিকা টেবিল এবং পেছনে হেলানের অংশে খাড়া-ধরনের চেয়ারগুলো এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।

রেস্টুরেন্টটিতে আসা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ইয়ান অ্যাঞ্জেল; যিনি প্রায় এক দশক ধরে ইন্ডিয়া ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করেন। রয়টার্সের কাছে রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হওয়ার খবরটি বেশ দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

ইয়ান অ্যাঞ্জেল বলেন, "জায়গাটির সাথে ঐতিহাসিক একটা সম্পর্ক রয়েছে। হোটেলটি অন্য কোথাও স্থাপন করা হলে একইরকমের অনুভূতি পাওয়া বেশ কষ্টকর হবে।"

বর্তমানে হোটেলটিতে রয়েছে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই নেতা গান্ধী ও নেহেরুর ছবি। ঐ ছবিগুলোর ফ্রেমের নিচে বসেই ইয়ান অ্যাঞ্জেল বলেন, "হোটেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বেশ লজ্জার।"

১৯৫৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পর থেকে নিয়মিত এই ক্লাবে যেতেন ইতিহাসবিদ কুসুম ভারগামা। তিনি বলেন, "১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এটাই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে ভারতীয়রা স্বদেশী ভাষায় কথা বলার মতো লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারতো এবং স্বদেশের খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারতো।"

কুসুম ভারগামা আরও বলেন, "বিদেশের নতুন জীবনে আমাদের একাকীত্ব কিছুটা হলেও দূর করতে সাহায্য করেছে ইন্ডিয়া ক্লাব। ভারতীয়রা প্রায়ই জন্মদিন, বিয়ে বা দিওয়ালির মতো উৎসব উদযাপনের জন্য এখানে জড়ো হতো।"

স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কয়েক বছরে ভারত থেকেও বহু মানুষ যুক্তরাজ্যে চলে এসেছিলেন। কিন্তু সেসময় লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য কোনো সাংস্কৃতিক স্থাপনা ছিল না বললেই চলে।

প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের জন্য সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে ইন্ডিয়া ক্লাব। ভারতীয়দের মধ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় খাবারগুলো এখানে পরিবেশন করা হতো; যেমন- দোসা, সাম্বার, বাটার চিকেন এবং পাকোড়ার মতো তেলেভাজা ভারতীয় স্ট্রিট ফুড; সেইসঙ্গে কফি আর মাসালা চা তো ছিলই।

সাংবাদিক ও লেখক শর্বাণী বসু ১৯৮০'র দশকে অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে এই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, "সেন্ট্রাল লন্ডনে ইন্ডিয়া ক্লাবই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে সুলভ মূল্যে ভারতীয় খাবার পাওয়া যেত।" তিনি ইন্ডিয়া ক্লাবকে এ শহরের 'লুকানো সম্পদ' বলে অভিহিত করেন এবং জানান, ভারত থেকে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে তিনি তাদেরকে ইন্ডিয়া ক্লাবে নিয়ে যান।

ক্লাবের সমৃদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চিহ্ন হিসেবে, যেসব বিখ্যাত ভারতীয় ও ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বরা বিগত বছরগুলোতে এই ক্লাব পরিদর্শন করেছেন, তাদের প্রতিকৃতি ক্লাবের দেওয়ালে টানানো রয়েছে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম ভারতীয় এমপি দাদাভাই নওরোজী এবং দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের নাম উল্লেখযোগ্য।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.