অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে রোবট তৈরিতে জোর দিচ্ছে চীন
শিল্পক্ষেত্রে পণ্য তৈরি কিংবা প্রক্রিয়াকরণে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে চীন। মূলত ভবিষ্যতের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সুশৃঙ্খল শিল্প ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করতেই দেশটি এ উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে রোবটের সবচেয়ে বড় প্রস্তুতকারক দেশ চীন। গত বছর বিশ্বের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের অর্ধেকেরই বেশি তৈরি করেছে চীন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ে শুরু হয়েছে ছয় দিনব্যাপী ওয়ার্ল্ড রোবট কনফারেন্স। ঐ কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে চীনের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী জিন গুওবিন রোবোটিক্স শিল্প নিয়ে সরকারের পরবর্তী পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
জিন গুওবিন বলেন, "অটোমেশন ও অ্যাপ্লিকেশনের অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে রোবট এখন নতুন প্রজন্মের তথ্য প্রযুক্তির সাথে গভীরভাবে একীভূত হয়েছে। এটি অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে।"
জিন গুওবিন জানান, বৈদ্যুতিক গাড়ি, লিথিয়াম ব্যাটারি ছাড়াও অন্যান্য উদীয়মান শিল্পে রোবটের ব্যবহার খুব দ্রুত বাড়ছে।
জিন গুওবিন আরও বলেন, "রোবোটিক্স শিল্প এখন একটি বৈপ্লবিক দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই শিল্পে বিপুল বিনিয়োগেরও সুযোগ রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে শিল্পটির উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
ইতোমধ্যেই চীন সরকারের পক্ষ থেকে রোবট প্লাস অ্যাপ্লিকেশন অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্ল্যানের অংশ হিসেবে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য মোট ১০ টি সেক্টরকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্ধারিত সেক্টরগুলোর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, লজিস্টিক, জ্বালানি, হেলথকেয়ার, শিক্ষা ও প্রবীণদের সেবা খাতগুলো অন্যতম। এসব ক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে চীন রোবটিক্সে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে চায়। চলমান কনফারেন্সে এই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন জিন গুওবিন।
রোবটিক্স শিল্পে চীন গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। গত বছরে এই খাত থেকে দেশটি প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। চীনের শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশটিতে ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শিল্পে ব্যবহৃত রোবটের উৎপাদন ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই চীনে তৈরি হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট রোবট। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫.৪ শতাংশ বেশি।
একইসাথে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার সার্ভিস ইউনিট রোবট তৈরি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৯.৬ ভাগ বেশি।
জিন গুওবিন জানান, চীন রোবোটিক্স প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত কররে আগ্রহী। একইসাথে বিদেশি রোবটিক্স কোম্পানিগুলোকে চীনে বিনিয়োগের উৎসাহী করার বিষয়েও কাজ করছে সরকার।
চলতি বছরের মে মাসে চীনের জিজিয়াং প্রদেশে চায়না রোবোটপ অ্যান্ড ইন্টিলিজেন্ট ইকোনোমিক ট্যালেন্টস সামিটের আয়োজন করা হয়। ঐ সামিটে চীনের শিল্প মন্ত্রণালয়ের রোবটিক্স বিশেষজ্ঞ ইউ উই বলেন, "ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরির ক্ষেত্রে মূল যে অংশগুলোর দরকার হয়; চীন সেগুলো স্বাধীনভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।"
বেইজিং মূলত দেশের উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরকে আরও উৎপাদনশীল করতে চাচ্ছে। একইসাথে শিল্পভিত্তিক সকল ক্ষেত্রে যথাসম্ভব স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে।
কেননা চীন একদিকে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। চিপের মতো উন্নত প্রযুক্তি সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।একইসাথে দেশের জনসংখ্যাও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এমতবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি চীনের জন্য ইতিবাচকতাই বয়ে আনবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
চীন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রোবটের মার্কেট হিসেবে বিবেচিত। গত বছরের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রোবটিক্সের পক্ষ থেকে অটোমেশনে অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য চীনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
২০২১ সালে চীন বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ অটোমেশন ব্যবহার করা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতি ১০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে অপারেশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট ব্যবহারের সংখ্যা গড়ে ৩২২ ইউনিটে পৌঁছেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম সিনহুয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯২ ইউনিটে।
অপারেশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর। প্রতি দশ হাজারে ১ হাজার অপারেশনাল রোবট নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান প্রথমে। আর ৬৭০ ইউনিট নিয়ে সিঙ্গাপুরের অবস্থান দ্বিতীয়তে।
চলতি বছরের জুন মাসে চীনের সাংহাই মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট আগামী তিন বছরে অন্তত ২০ হাজার নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এদিকে গত বুধবার বেইজিংয়ের স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে ১০ বিলিয়ন ইউয়ানের একটি ফান্ড গঠনের কথা জানানো হয়েছে। এই ফান্ডের লক্ষ্য হবে বিদ্যমান রোবটিক্স কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত ও আর্থিকভাবে সহায়তা করা।