ইউক্রেনের বিষয়ে আমেরিকান জনমতে চিড়
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/04/06/ron-desantis-gettyimages-1472685.jpg)
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রথম বছরের বেশিরভাগ সময়ই মার্কিন নাগরিকরা পররাষ্ট্রনীতির তুলনায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আরও দ্বিধাবিভক্ত ছিল। যুদ্ধের ব্যাপারে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানদের ঐকমত্য এবং ইউক্রেনের প্রতি তাদের জোরালো সমর্থন সবসময়ই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই ঐকমত্য চোখে পড়ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কতটুকু জড়ানো উচিত, সেই সিদ্ধান্ত দুই দলের রাজনীতিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্ভবত ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এটি একটি বড় ফ্যাক্টর হবে।
১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের দ্বিধাবিভক্ত পররাষ্ট্রনীতি তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলিও ইউক্রেনের সামরিক জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলোতে যখন বিষয়টি নিয়ে একের পর এক কলাম লেখা চলছে, মতামত প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান দুই দল ক্রমেই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
যখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ প্রথম শুরু হয়, তখন ইউক্রেনের প্রতি সমর্থনে খুব বেশি ফারাক ছিল না। গত বছরের মার্চ মাসে শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পোলিংয়ে দেখা যায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে রয়েছেন ৮২ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৭৫ শতাংশ রিপাবলিকান। ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার পক্ষে রয়েছেন ৮৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৮০ শতাংশ রিপাবলিকান। আর ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার পক্ষে রয়েছেন ৮৫ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৭৪ শতাংশ রিপাবলিকান। ২০২২ সালের জুলাই মাসে এই বিভক্তি আরেকটু বেড়ে যায়, তবে সেটা খুব সামান্য।
কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে এই বিভক্তি অনেক বেড়ে গেছে। সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে গত বছরের শেষে ৭৬ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৫৫ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থন দিয়েছে, যা ৩ পয়েন্টের ফারাক থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ পয়েন্টে। এদিকে অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রেও ৮১ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৫৫ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থন দিয়েছে। এই ফারাকও ১১ থেকে ৩১ পয়েন্ট বেড়েছে। তবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। নভেম্বরে এসে ৮৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৭৩ শতাংশ রিপাবলিকানরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার জন্য সমর্থন দিয়েছে। এই ৮ মাসে ব্যবধান বেড়েছে ৭ থেকে ১০ পয়েন্টে। এদিকে গ্যাস ও খাদ্যের দাম বাড়ার পরেও ইউক্রেনকে সমর্থন করার বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে, রিপাবলিকানদের সমর্থন জুলাইয়ের ৫০ শতাংশ থেকে নভেম্বরে ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন ৬৯ শতাংশ থেকে ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যবধান বেড়েছে ১৯ থেকে ৩১ পয়েন্টে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/04/06/screenshot_5.png)
হাউজ অভ রিপ্রেজেন্টেটিভসে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রায়ই বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সিবিএস নিউজের এক জরিপে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় সাহায্যের জন্য সামগ্রিক সমর্থন ছিল মাত্র ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে রিপাবলিকানদের সমর্থন ছিল ৪৮ শতাংশ, কিন্তু ট্রাম্পের ভক্তকূল 'মাগা' (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) রিপাবলিকানদের মধ্যে এটি ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ। সিনেটের রিপাবলিকানরা যদিও ইউক্রেনের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে ইউক্রেনের পক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করছেন, তবুও যুদ্ধ নিয়ে রিপাবলিকান এবং পুরো মার্কিন জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এই বিভক্তি উপেক্ষা করা যায় না।
গত মাসে রিপাবলিকানদের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং ফ্লোরিডার বর্তমান গভর্নর রন ডিস্যান্টিস ইউক্রেন ইস্যুকে রিপাবলিকানদের আলোচনায় এনেছেন। তিনি ইস্যুটিকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি 'আঞ্চলিক বিরোধ' হিসেবে তুলে ধরেছেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসন হিসেবে নয়। তিনি আরও বলেন যে, এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কোনো স্বার্থ নেই। এই বিবৃতি স্পষ্টতই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উদ্দেশ্যে ছিল।
ডিস্যান্টিস ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি বলবৎ হবে এবং ইউক্রেনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করার বদলে মাদক চোরাচালান বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত আরও সুরক্ষিত করতে ব্যয় করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে তিনি চীনকে আসন্ন প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে রাশিয়াকে 'তৃতীয় সারি'র হুমকি হিসেবে ব্যঙ্গ করেছেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন আরও বড় হুমকি। তবে ডিস্যান্টিস তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রাশিয়াকেই মূল প্রতিপক্ষ মনে করতেন। যদিও তিনি পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করে তার বক্তব্য কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে আসেন।
এদিকে আরেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনার প্রাক্তন গভর্নর নিকি হেইলি ডিস্যান্টিসের বিরুদ্ধে করা সমালোচনাকে পুঁজি করে রিপাবলিকানদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। হেইলি প্রথাগত রিপাবলিকানদের রক্ষণশীল পররাষ্ট্রনীতির পক্ষ নিয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে 'শক্তির মাধ্যমে শান্তি' নীতি অনুসরণ করতেন রিপাবলিকান নেতারা, যার মধ্যে রয়েছেন জেনারেল ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার (১৯৫২) ও জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ (১৯৯২)। এ দুই সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানই রিপাবলিকানদের প্রার্থী হওয়ার জন্য 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' তথা বহির্বিশ্বের তুলনায় আমেরিকাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দুই প্রার্থী রবার্ট এ. টাফট ও প্যাট্রিক বুকানানকে পরাজিত করে রিপাবলিকানদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালে এই হিসাব উল্টে যায়। রিপাবলিকানরা তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বুশ বা আইজেনহাওয়ারের মতো রক্ষণশীল পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলা মার্কো রুবিও, জেব বুশ, টেড ক্রুজ, লিন্ডসে গ্রাহামের মতো প্রার্থীকে সরিয়ে 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি মেনে চলা ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছিলেন।
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যারা রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হবেন, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের সমর্থনের চেয়ে এর সমালোচনার পক্ষেই থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর এতে সাধারণ নির্বাচনে দলের সুবিধা হতে পারে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/04/06/qjuy7dhwdvo45ged5yargvg5hq.jpg)
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে সেটি তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে একটি বাইডেনকে সাহায্য করতে পারে, তবে খুব সামান্যই। তবে বাকি দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি বাইডেনকে যথেষ্ট ক্ষতির মুখে ফেলবে।
১. ইউক্রেনের বিজয়: ইউক্রেনের বিজয়ের অর্থ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে, রাশিয়া তার বাহিনীকে তার সীমান্ত পর্যন্ত ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সংযুক্তি ইউক্রেনে ফেরত আসতেও পারে বা না-ও আসতে পারে এবং দুই দেশ যে শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছে তা শক্তিশালী ও টেকসই হবে। যুদ্ধের ফলাফল যদি এমন হয়, তবে বাইডেন প্রশাসন নিজেদের সফল দাবি করতে পারে, যেখানে তাদের পররাষ্ট্রনীতি ইউক্রেন সমস্যা নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল।
কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির বিজয় রাষ্ট্রপতির পুনঃনির্বাচনের খুব কমই সাহায্য করে। যেমন: ১৯৯২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে বড় জয় সত্ত্বেও পুনঃনির্বাচনে হেরে যান। ২০০৪ সালে জনমত ইরাক যুদ্ধের পক্ষে থাকলেও জর্জ ডব্লিউ বুশ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পুনর্নির্বাচিত হন। প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক অন্যান্য বেশ কয়েকটি নির্বাচনগুলোতে: আল গোর বনাম জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০০); বারাক ওবামা বনাম জন ম্যাককেইন (২০০৮); ট্রাম্প বনাম হিলারি ক্লিনটন (২০১৬); পররাষ্ট্রনীতির ওপর বেশি জোর দেওয়া প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন।
২. ইউক্রেনের পরাজয়: ইউক্রেনের পরাজয় ঘটলে বাইডেন প্রশাসনের নীতিগুলো প্রচণ্ড মাত্রায় সমালোচিত হবে। রিপাবলিকান প্রার্থীরা দুই ধরনের যুক্তি দেখাতে পারেন: একটি হলো, বাইডেন প্রশাসন যদি শুরু থেকেই রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করত, তবে রাশিয়া বিজয়ী হতে পারত না। অপরটি হলো, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন যুদ্ধে কেবল মার্কিন করদাতাদের অর্থ নষ্ট করেছে।
৩. যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়া: এর ফলে বাইডেন দাবি করতে পারেন যে, ইউক্রেন তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করছে। বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছোট প্রতিপক্ষ যে টিকে রয়েছে এটাই বড় ব্যাপার হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তিনি। এছাড়াও আগের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলতে পারেন, যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলে। তবে এটি ঘটলে বাইডেনের ঝুঁকিও কম নয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যুদ্ধ চলাকালে নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য সবসময় সুখকর ফলাফল বয়ে আনেনি। যেমন: উড্রো উইলসন তার ১৯১৬ সালের পুনঃনির্বাচনের সময় প্রচারণা চালিয়েছিলেন যে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। আবার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে পুনঃনির্বাচনের আগে ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট মার্কিন সৈন্যদের যুদ্ধে না পাঠানোর জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এই দুজনই নির্বাচনে হেরেছিলেন।
আবার এর উল্টো ঘটনাও কম নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগে রিচার্ড নিক্সন গোপন শান্তি পরিকল্পনার কথা বলে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন (যদিও বাস্তবে তা ঘটেনি)। আবার ইরাক যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ওবামার প্রতিশ্রুতি ম্যাককেইনের বিরুদ্ধে তাকে এগিয়ে রেখেছিল। ট্রাম্পও ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে প্রচারণা হিসেবে ঘোষণা করেন যে, আফগানিস্তান যুদ্ধ একটি 'অপচয়' এবং এখন 'ঘরে ফেরার সময়'।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ইউক্রেন সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে না; এই জায়গা দখল করবে দেশটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিত্ব। তবে সুইং স্টেটগুলোতে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেন ইস্যুর প্রচারণাও ভূমিকা রাখতে পারে।
সূত্র: ফরেন পলিসি