এত এত বছর পার হলেও ইউক্রেন আক্রমণের জন্য ২০২২-কে কেন বেছে নিলেন পুতিন?
মস্কো সবসময় ইউক্রেন দখল করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ভ্লাদিমির পুতিন তার বক্তব্য ও লেখায় ইউক্রেন দখলের ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ঠিক ২০২২ সালে এসেই পুতিন কেন ইউক্রেনে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন? এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বিপ্লবের সময়ও দেশটি দখল করার চেষ্টা করেননি তিনি, স্রেফ ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও দনবাসে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অল্প সহায়তা করেই ক্ষান্ত ছিলেন।
একথা সত্য ইউক্রেনে আরও আগে আক্রমণ না চালানোর জন্য কট্টরপন্থী রাশিয়ানরা দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে পুতিনের সমালোচনা করে এসেছেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ছিল মারাত্মরকমের দুর্বল। তখনকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিস ছিলেন রাশিয়াপন্থী। ওডেসাতে রাশিয়াপন্থী বিক্ষোভকারীদের হত্যা করার মতো নানা ঘটনাও রাশিয়ার আক্রমণের অনুকূলে ভালো পটভূমি তৈরি করেছিল।
অতীতের বছরগুলোতে পুতিনের ইউক্রেনে আক্রমণ পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত ছিল সেই ১৯৯০-এর দশক থেকে চলে আসা একটি রুশ কৌশলের অংশ — ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আরও দূরত্ব বাড়ানো এবং রাশিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ও সমীহযোগ্য ভূমিকায় রেখে ইউরোপে চূড়ান্তভাবে নতুন একটি নিরাপত্তা অর্ডার তৈরি করা।
এটা সবসময় পরিষ্কার ছিল যে, ইউক্রেনে পুরোদমে আক্রমণ চালালে পশ্চিমা ইউরোপীয়দের সঙ্গে রাশিয়ার পুনরায় সম্পর্ক তৈরি করার সব আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে যেত, একই সঙ্গে এ ইউরোপীয়রা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ত। পুতিন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটালে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং চীনের ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।
রাশিয়ার কৌশল ছিল পশ্চিমকে বিভক্ত করা এবং সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোকে রাশিয়ার প্রভাববলয়ে আনা। তবে ইউরোপে যদি রাশিয়াসহ কোনো নিরাপত্তা বলয় তৈরি হতো, সেক্ষেত্রে ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ও ইউক্রেনে রুশ হামলার ঝুঁকি দূর হয়ে যেত। এর ফলে রাশিয়া এর প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর কঠিনভাবে প্রভাব বজায় রাখতে পারত না। মিখাইল গর্বাচেভের ধারণা থেকে রাশিয়ার এ কৌশলের উৎপত্তি – একটা সময় পশ্চিমাবিশ্বও গর্বাচেভের 'সর্বজনীন ইউরোপীয় আবাসের' বিশ্বাসের এ ধারণাকে স্বাগতম জানিয়েছিল।
এক পর্যায়ে এ কৌশল পুতিনেরও মনে ধরেছিল। ২০২১ সালে তিনি লিখেছিলেন, রাশিয়া বৃহত্তর ইউরোপের আঙ্গিক অংশ এবং রুশ নাগরিকেরা তাদেরকে ইউরোপীয় হিসেবেই মনে করেন। কিন্তু পুতিন তার এ দর্শনকে ত্যাগ করেছেন — তিনি এখন মনে করেন, রাশিয়া একটি আলাদা 'ইউরেশীয় সভ্যতা'।
১৯৯৯ সালে পুতিন ক্ষমতায় আসেন। ২০২০ সালে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময়ের মাঝে রাশিয়ার এ কৌশল তীব্র কিছু ব্যর্থতা দেখেছে। কিন্তু একই সময় প্যারিস ও বার্লিনের বিভিন্ন কার্যকলাপ রাশিয়াকে তাদের ও কৌশল ধরে রাখতে আশা জুগিয়েছে।
২০০৮ থেকে ২০১২ সালে দিমিত্রি মেদভেদেভ যখন রাশিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন, তখন ইউরোপে নতুন একটি নিরাপত্তা অর্ডার বিষয়ে আলোচনার সবচেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল দেশটি। পুতিনের অনুমোদন নিয়ে মেদভেদেভ ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিয়ে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত এ চুক্তি কার্যকর হলে ন্যাটোর বৃদ্ধি থমকে যেত, ইউক্রেনসহ অন্যান্য দেশের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হতো, এবং রাশিয়া ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সমকক্ষ আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেত। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো কস্মিনকালেও রাশিয়ার এসব প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়নি।
২০১৪ সালে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের রাশিয়া ও জার্মান-রাশিয়া সম্পর্কের 'ভয়ানক ক্ষতি'র সতর্কবার্তার পর পুতিন দনবাসে রাশিয়ার মদতপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অগ্রযাত্রা স্থগিত করেন। এর বদলে জার্মানি ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিতে প্রত্যাখ্যান জানায়, এবং ফ্রান্স মিনস্ক ২ চুক্তির মধ্যস্থতা করে।
পশ্চিমা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভাঙনের রুশ আশা আবারও পুনর্জীবিত হয় ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর হোয়াইট হাউজ ও পশ্চিমা ইউরোপ আবারও এক ছাতার নিচে আসে। মিনস্ক ২ চুক্তি অনুযায়ী দনবাস স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একই সময়ে ইউক্রেনও দনবাসকে স্বায়ত্তশাসন দিতে অপারগতা জানায়। পশ্চিমারাও এক্ষেত্রে কিয়েভকে কোনো চাপ দেয়নি।
এসবের সঙ্গে আরও অনেক ঘটনার কারণে পুতিন ইউক্রেন নিয়ে চূড়ান্ত কিছু করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের কৌশলগত অংশীদারিও পুতিনের এ সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব রেখেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানির মার্কেল ও ফ্রান্সের ফ্রান্সোয়া ওলঁদ জানিয়েছিলেন, দনবাসের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে মিনস্ক ২ চুক্তি মূলত ইউক্রেনকে এর সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে সময় দেওয়ার জন্য তাদের পক্ষ থেকে একটি সাময়িক চাল ছিল। রাশিয়ান কট্টরপন্থীরা এমনটাই সবসময় বিশ্বাস করেছিলেন। বর্তমানে পুতিনও এমনটাই মেনে নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তারপরও আক্রমণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত পুতিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখোর ওপর চাপ দিয়েছিলেন ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ও দনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে। কিন্তু তার সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশ্য একথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, মাঁখো পুতিনের কথা শুনলেও পুতিন শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে হামলা চালাতেন না। কিন্তু পুতিনের কথামতো মাঁখো কাজ করলে ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল ধরত, আর তা-তে হয়তো এ দুই বৈরীশক্তিকে দ্বিধাবিভক্ত করার পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান কৌশলের প্রতি পুতিন আবার আস্থা ফিরে পেতেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও নৃশংসতার কারণে এ মহাদেশে সহসা শান্তিপূর্ণ কোনো নিরাপত্তা অর্ডার এখন অনেক দূর অস্ত। কিন্তু পুতিন ও তার কার্যকলাপ যেমনটা এসবের জন্য বেশিরভাগক্ষেত্রে দায়ী, তেমনিভাবে আমাদেরকে এটাও মানতে হবে যে, গর্বাচেভের 'সর্বজনীন ইউরোপীয় আবাসের' স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে সেন্ট্রাল ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলো খুব বেশি কোনো সহায়তা করেনি।