ইউক্রেনযুদ্ধে এখন যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাশিয়া!
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। সহসা প্রচণ্ড আক্রমণের মাধ্যমে কিয়েভ দখল করে জেলেনস্কির সরকার হটানোই ছিল মস্কোর উদ্দেশ্য। কিন্তু সে পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয় ইউক্রেনের পাল্টা প্রতিরোধ।
কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে রাশিয়ান বাহিনী। আর রুশ বাহিনীর এ রণভঙ্গকে ব্যাখ্যা করার জন্য জুলাই মাসে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ সদর্পে বলেছিল, 'সব অপদার্থ রাশিয়ান মারা পড়েছে।' যুদ্ধের প্রথমদিকে রাশিয়া বেশকিছু ভুল পদক্ষেপ নিলেও বর্তমানে সামরিক কৌশলগত দিক থেকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশটি।
গত সেপ্টেম্বের রিজার্ভ বাহিনীকে আংশিকভাবে মবিলাইজেশনের ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন। এতে ফ্রন্টলাইনে রাশিয়ান বাহিনী আবারও শক্তিশালী হয়েছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে নিয়মিত হামলা জারি রেখেছে রাশিয়া। এর ফলে ইউক্রেনকে রণাঙ্গণ থেকে মনোযোগ কিছুটা সরিয়ে এর শহরের নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ বাঁচানোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। আর নভেম্বরে খেরসন থেকে যে সেনাদের রাশিয়া প্রত্যাহার করে নিয়েছে, তাদেরকে এখন যুদ্ধের অন্য কোনো অংশে ব্যবহার করতে পারছে দেশটি।
জুলাই মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে এগিয়ে ছিল। রাশিয়ার কিয়েভ থেকে পিছু হটা দেশটির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক অর্জন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দুপক্ষেরই সৈন্যক্ষয়ের সংখ্যা সমান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুমান, দুই দেশই এ যুদ্ধে এক লাখ করে সৈন্য হারিয়েছে।
বর্তমানে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। এখন আর এ যুদ্ধে ইউক্রেন খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারছে না। বরং আক্রমণ আর পাল্টা-আক্রমণেই পরিচালিত হচ্ছে যুদ্ধটি। কোনো পক্ষ যদি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু অর্জন করতে পারে, তাহলে তা হবে অনেক রক্ত ও সম্পদক্ষয়ের বিনিময়ে।
রাশিয়া বা ইউক্রেন; কোনো দেশকেই এখনো আলোচনার বিষয়ে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে কাউকে কোনো অংশে ছাড় দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি টানার আশা এখনই করা যাচ্ছে না। তবে ওয়াশিংটনের ক্ষমতা আছে এ দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসানোর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও এমন কিছু না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এসবের পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে দুই দেশেরই সাধারণ সৈনিকদের।
রাশিয়ার নতুন বাহিনী
প্রাথমিকভাবে পুতিন চেয়েছিলেন বিশেষ অভিযান ও আকাশ থেকে ছত্রীসেনা নামিয়ে কিয়েভের দখল নেবেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর ট্যাংক, গোলন্দাজ বাহিনী, পদাতিক সেনা, সহযোগী সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হয় রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন বাহিনীর ক্রমাগত অ্যামবুশের মুখে এ পরিকল্পনাও কার্যকর হয়নি।
হারানো সৈন্যদের স্থান পূরণের জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া তাদের সেনাবাহিনীতে নতুন করে সৈন্য যুক্ত করেছে। ইউক্রেনের জন্য কাজটি তুলনামূলক সহজ ছিল, কারণ দেশটির হাজারো মানুষ এ যুদ্ধে স্বেচ্ছায় যোগ দেওয়ার জন্য সেই শুরু থেকেই উন্মুখ ছিল।
ইউক্রেনে নিজেদের সেরা যোদ্ধাদেরই পাঠিয়েছে রাশিয়া। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশটি এর মোট বৃহৎ ফর্মেশনের অর্ধেক—৪০ ব্রিগেড সৈন্য মোতায়েন করে। খুব সম্ভব এ ৪০টি ব্রিগেডে রাশিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনারাও ছিল। পেশাদার সদস্যের পাশাপাশি রাশিয়ার কমব্যাট ইউনিটগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তি করানো (ড্রাফট) অনেক সদস্যও থাকে। তবে পুতিন জানিয়েছেন, ড্রাফটের মাধ্যমে আসা সদস্যদের সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হবে না। তার অর্থ, অবশিষ্ট ৪০ ব্রিগেড যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে না, তাদের অভিজ্ঞ সৈনিকদের ফ্রন্টলাইনে পাঠানো ব্রিগেডগুলোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
গ্রীষ্মকালের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার বাহিনী ক্রমেই এর শক্তি হারাতে শুরু করে। রুশ কমান্ডারেরা এক অঞ্চলের সৈন্যদের অন্য জায়গায় মোতায়েন করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে বাধ্য হন। আর এর সুযোগ নেয় ইউক্রেন বাহিনী। তারা আরও বেশি বেশি এলাকা পুনর্দখল করে নিতে শুরু করে। আর পুতিন টের পান, তার আরও সৈন্যের দরকার।
এজন্যই গত সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ বাহিনীর মবিলাইজেশন শুরু করে রাশিয়া। সবমিলিয়ে পুতিনের এ সিদ্ধান্তকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অপারেশন ও কৌশলগত সমস্যাগুলোর যৌক্তিক জবাব হিসেবেই দেখা যায়। রাশিয়া নতুন করে আরও তিন লাখ সৈন্য জড়ো করার কথা বলছে। আর এর সঙ্গে হিসেবের দুইয়ে দুইয়ে চারও মিলে যায়। রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যারাকে থাকা ৪০টি ব্রিগেডকে আবারও পূর্ণশক্তিতে রূপান্তর করতে দেশটির প্রায় ২০০,০০০-এর মতো সৈন্য দরকার। আর যুদ্ধে নিহত ও আহত হওয়া সেনাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য প্রয়োজন বাড়তি এক লাখ সৈনিক।
রিজার্ভ বাহিনীতে থাকা অনেক রাশিয়ানের কোনো সামরিক দক্ষতা নেই। কিন্তু এদের অনেকের আবার সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। কারণ, এ যুদ্ধের আগে থেকেই রাশিয়ান বাহিনী প্রতি বছর ড্রাফট করা ২৫০,০০০ সৈন্যকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার বেসামরিক জীবনে ফেরত পাঠাত।
একটি সুচতুর পশ্চাদপসরণ
নভেম্বরে খেরসন থেকে রাশিয়ানদের সরে আসার সিদ্ধান্তটি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ গ্রহণযোগ্য। খেরসনের নিপ্রো নদীর পশ্চিমে রাশিয়ান সেনারা বিপাকে পড়ার পর পিছু হটার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কথা অনস্বীকার্য, ইউক্রেনের আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়েই পশ্চাদপসরণ করেছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার জন্য স্বস্তির কথা হলো, তারা বড় একটি আক্রমণের মুহূর্তে বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পিছু হটতে সক্ষম হয়েছে।
নিপ্রো নদীর গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলো ইউক্রেনীয় বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এসব ব্রিজ সারিয়ে তুলে, পন্টুন ব্রিজ বানিয়ে, ফেরি ব্যবহার করে প্রায় ২০,০০০ সেনা ও তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ইউক্রেনীয়দের বিস্মিত করেই পিছু হটতে হয় সক্ষম হয় রাশিয়া। এর সঙ্গে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি এড়ানোর সুকঠিন কাজটি তো ছিলই।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ান বাহিনী এখন ফ্রন্টলাইনে প্রতিরক্ষাব্যূহ এবং কংক্রিটের বাংকার ও বাধা নির্মাণ করছে। এছাড়া ইউক্রেন বাহিনীর চলার পথে মাইনও পুঁতছে রুশ বাহিনী। এখন যদি না রাশিয়ার যোদ্ধাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে বা পুরো বাহিনীতে গণবিদ্রোহ শুরু হয়, তাহলে এ ব্যূহ ভেঙে সামনে এগোতে বিপুল কাঠখড় পোড়াতে হবে ইউক্রেন বাহিনীকে।
জয়ের জন্য বোমাবর্ষণ?
পরিশেষে, রাশিয়া এখন ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, ও বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। এ পদক্ষেপটি এখনো স্পষ্ট কোনো ফলাফল না দিলেও, অন্যসব কৌশলগত বোমাবর্ষণ অভিযানের মতো এটির ফলে ইউক্রেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ, এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ; সবকিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। তাই নিয়মিত পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবারহ না ঘটলে এসব সামরিক কার্যক্রমের জন্য ইউক্রেনকে জেনারেটর ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু জেনারেটর ব্যবহারের ফলে এ ব্যবস্থাগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। আবার জেনারেটরের জন্য বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি জেনারেটর থেকে তৈরি হওয়া তাপ রাশিয়ার গোয়েন্দা নজরদারির জন্য আরেকটি বাড়তি ডেটা পয়েন্টে হিসেবে কাজ করবে।
রাশিয়ার বোমা হামলার ফলে ইউক্রেনের সুযোগ ব্যয় ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এসব হামলার সঙ্গে তাল সামলাতে ইউক্রেনকে এর সামরিক সম্পদ এখন ফ্রন্টলাইন থেকে নিয়ে এসে শহরে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহার করতে হচ্ছে। ইউক্রেনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ শিল্প বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।
যেসব রেলগাড়ি ব্যবহার করে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম পরিবহন করা হয়, সেগুলোর জন্যও প্রয়োজন বিদ্যুতের। বিদ্যুতের অভাবে ডিজেল ইঞ্জিন বা জেনারেটরের দিকে ঝুঁকতে হবে দেশটিকে। এর ফলে প্রয়োজন হবে জীবাশ্ম জ্বালানির, যা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী একটি মহার্ঘ বস্তু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হলো, রাশিয়া জানে এ বোমাবর্ষণ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা কী করতে চাচ্ছে। তুলনামূলক অল্প পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করে ছোট সংখ্যক লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা পরিচালনা করছে রাশিয়া। আর তার তুলনায় অনেক বেশি হারে অস্ত্র উৎপাদন করছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অতীতে অনুমান করেছিল, রাশিয়ান বাহিনী এক পর্যায়ে এর গোলাবারুদের ভান্ডার শূন্য করে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। রাশিয়া কোনোভাবে এর গোলাবারুদ সংকটকে ঠেকিয়ে রেখেছে। রাশিয়ার বিমানবাহিনী ইউক্রেনের সশস্ত্রবাহিনীর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও এখন যেভাবে নতুন পদ্ধতিতে অপারেশন পরিচালনা করছে; তা-তে একথা বলা যায়, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এটি।
সমাপ্তির নেই দেখা
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাশিয়ার এখন লক্ষ্য কেবল একটি: দখল করা ভূমি অধিকৃত করে থাকা। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দেশটি দুটি সামরিক কৌশল অবলম্বন করছে। একটি হলো রিজার্ভ সৈন্যদের মবিলাইজ করা ও তীব্র প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি যাতে ইউক্রেন নিজেদের ভূমি পুনর্দখল করতে চাইলে মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অন্যটি, ইউক্রেনের বৈদ্যুতিক অবকাঠামোর ওপর হামলা অব্যাহত রাখা ও দেশটিকে ফ্রন্টলাইন থেকে মনোযোগ সরিয়ে খোদ দেশের ভেতরে বোমা হামলা ঠেকাতে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা।
পুতিন হয়তো আশা করছেন, এভাবে চালিয়ে গেলে একসময় ইউক্রেন হাল ছেড়ে দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসবে, অথবা এক সময় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবে। খুব কম সংখ্যক মানুষই রাশিয়ার সার্বিক সামরিক কৌশলের কথা জানে। এমনও হতে পারে, বর্তমানে রাশিয়ার গ্রহণ করা সামরিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলো শেষ অব্দি বিশেষ কোনো প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখবে না। কিন্তু রাশিয়া যদি নতুন নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও গোলাবারুদের ব্যবস্থা করে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারে, তাহলে এ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা এভাবেই চলতে থাকবে।
এ মুহূর্তে দুইটি দেশই ভাবছে, জয় তাদের পক্ষে সম্ভব এবং জয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ দৃশ্যপট পাল্টাতে পারে কেবল কূটনীতি। এ যু্দ্ধে দুই পক্ষই রাজনৈতিকভাবে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক কৌশল তৈরি করতে সক্ষম। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুদ্ধরত দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসাতে খু্ব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি এ দেশটি। আরও এক বছর ধরে এ রক্তক্ষয়ী, বিধ্বংসী, ও ঝুঁকিপূ্র্ণ অচল যুদ্ধ চলতে থাকলে হয়তো শেষপর্যন্ত দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে পারে।
সূত্র: ফরেইন অ্যাফেয়ার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত