কৌশলগত পেট্রোলিয়াম মজুতে চীন যেভাবে আমেরিকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
03 November, 2022, 08:20 pm
Last modified: 04 November, 2022, 12:48 am
জ্বালানি বাজার ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে দুষ্ট বহুদিন ধরেই। যেমন ইরানের তেল রপ্তানির ওপর রয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। একইকথা প্রযোজ্য বিশ্বের আরেক বড় উৎপাদনকারী রাশিয়ার ক্ষেত্রে। ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আবারো প্রমাণ করেছে সরবরাহ চক্র সঠিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব। এটি ব্যাহত হওয়া কীভাবে কৌশলগত ও কারিগরি বাধাবিপত্তি তৈরি করে– সেদিকটাও উঠে এসেছে। খবর ইউরেশিয়ান টাইমসের

এতে বিশ্বব্যাপী মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রভাবিত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির সংকট। যুদ্ধরত ইউক্রেন এসব সংকটে এরমধ্যেই আক্রান্ত। শীতকালটা দুর্বিষহই কাটবে ইউক্রেনীয়দের। 

সবমিলিয়ে একটি দেশের পেট্রোলিয়াম পণ্যের মজুদ– দেশটির ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি সরবরাহ থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে যেতে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ– বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতন বাংলাদেশও তার সাক্ষী।  

পেট্রোলিয়াম পণ্য মজুত এমন কৌশলগত সম্পদ– সব ধরনের পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অন্যান্য শিল্পকাজের যা আবশ্যক চালিকাশক্তি। 

পেট্রোলিয়াম বা হাইড্রোকার্বনের প্রাকৃতিক মজুতের আশীর্বাদধন্য বিশ্বের কিছু কিছু অঞ্চল। বাকিদের স্থানীয় উত্তোলন চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট নয়। 

আর অন্য অনেক দেশকে সম্পূর্ণরূপে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় উৎপাদন বিপুল হওয়ার পরও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য আরও জ্বালানি দরকারও হয় প্রধান অর্থনীতিগুলোর।   

যেমন- ইউরোপ, চীন, জাপান ও ভারতসহ অন্য কয়েকটি প্রধান অর্থনীতি হলো পেট্রোলিয়াম পণ্যের অন্যতম আমদানিকারক।

জ্বালানি বাজার ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে দুষ্ট বহুদিন ধরেই। যেমন ইরানের তেল রপ্তানির ওপর রয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। একইকথা প্রযোজ্য বিশ্বের আরেক বড় উৎপাদনকারী রাশিয়ার ক্ষেত্রে। ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 

অন্যদিকে, উচ্চ দর ধরে রাখতে পেট্রোলিয়াম পণ্য রপ্তানিকারকদের জোট ওপেক প্লাসের সরবরাহ কর্তনের সিদ্ধান্তেও জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। 

আর ঠিক এসব কারণেই আমদানিকারক দেশগুলিকে শুধু তাদের সরবরাহ উৎসেই বৈচিত্র্য আনতে হচ্ছে না; সাথে সাথে তারা নিজস্ব কৌশলগত মজুত সক্ষমতা বৃদ্ধি বা সেটি গড়ে তোলার তাৎপর্য– নতুন করে উপলদ্ধি করছে। 

বৈশ্বিক পেট্রোলিয়াম মজুত

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, দৈনিক প্রায় ৯ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় বিশ্বজুড়ে। 
 
এই হিসাবে বছরে দরকার হয় সাড়ে ৩৫ বিলিয়ন ব্যারেল। অন্যদিকে, বিশ্বে জীবাশ্ম তেলের প্রমাণিত মজুত রয়েছে প্রায় ১,৬৫০ বিলিয়ন ব্যারেল। চাহিদা এই পর্যায়ে থাকলে তাতে চলবে আরও ৪৭ বছর। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো– গত এক দশকে প্রমাণিত এই খনিজ মজুতের পরিমাণ তেমনভাবে বাড়ার তথ্যও সামনে আসেনি। 

প্রমাণিত প্রাকৃতিক এই মজুতের মধ্যে ভেনিজুয়েলায় ১৮.২%, সৌদি আরবে ১৬.২%, কানাডায় ১০.৪%, ইরানে ৯.৫%, ইরাকে ৮.৭%, কুয়েতে ৬.১%, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫.৯%, রাশিয়ায় ৪.৮%, লিবিয়ায় ২.৯%, যুক্তরাষ্ট্রে ২.১%, চীনে ১.৫%, ভারতে ০.২৯% এবং পাকিস্তানে ০.০২১%। খনিতে ছোট ছোট মজুত আরও রয়েছে অন্যান্য দেশে।    

বৈশ্বিক কৌশলগত পেট্রোলিয়াম মজুত

কৌশলগত বৈশ্বিক মজুতকে বলা হয়– গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (জিএসপিআর)। বিভিন্ন দেশের সমূহের সরকার যে পরিমাণ অপরিশোধিত জ্বালানির ইনভেনটরি রাখে– সেগুলি এর অন্তর্গত। মূলত, অর্থনীতিকে জ্বালানি তেলের আকস্মিক দর বৃদ্ধি এবং সংকটকালে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে এসব মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। 
 
বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে স্বল্পকালীন কোনো বিচ্ছিন্নতা দেখা দিলে– তখন এই মজুত থেকে বাজারে তেল সরবরাহ করা হয়। অপরিশোধিত জ্বালানিকে মজুতে রাখার অন্যতম কারণ– এটি এরমধ্যেই উত্তোলিত এবং প্রয়োজন অনুসারে পরিশোধন করে বাজারে ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন যে তেলটির তখন দরকার বেশি– সেটি সরবরাহ করা যায়। 

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) সদস্য দেশের জিএসপিআর সক্ষমতার প্রাক্কালন করা হয়েছে ৪১০ কোটি ব্যারেল তেল। 

আইইএ'র ৩১টি  সদস্যের তাদের বিগত বছরের সার্বিক আমদানি অনুসারে অন্তত ৯০ দিনের চাহিদা মেটানোর মতো কৌশলগত রিজার্ভ রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  

তবে এই বিধির বাইরে সার্বিকবভাবে জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ। মোট বৈশ্বিক রিজার্ভের মধ্যে ১৪০ কোটি ব্যারেল সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাকিটা রাখে বেসরকারি খাত।  

বরাবরই সবচেয়ে বড় কৌশলগত মজুত (এসপিআর) রক্ষা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যার পরিমাণ অন্তত ৭২৭ মিলিয়ন ব্যারেল। বেশিরভাগটাই রাখা হয়েছে টেক্সাস ও লুইজিয়ানা রাজ্যের ভুগর্ভস্থ সংরক্ষণ ব্যবস্থায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৫৬৬ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানির মজুত ছিল। ওই সময়ে তেলের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ১২৫ ডলার। সে হিসাবে, মার্কিন এসপিআর এর মূল্য ছিল প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলার। 

দেশটির দৈনিক তেল ব্যবহার ০.১ বিলিয়ন ব্যারেল। সে হিসাবে, ৪১০ বিলিয়ন ব্যারেল মজুত ৪১ দিনের বর্তমান উৎপাদন হারের সমান। 

দ্বিতীয় বৃহত্তম–৪০০ মিলিয়ন ব্যারেলের মজুত রয়েছে চীনের। বর্তমানে এটি বাড়িয়ে ৫১১ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত করার কাজ চলছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রাক্কালন অনুসারে, চীনের কাছে ৪০-৫০ দিনের আমদানির সমান এসপিআর রয়েছে। এটি আরও বাড়িয়ে ৯০ দিনের সমান মাত্রায় উন্নীত করতে চায় চীন। 

তৃতীয় বৃহত্তম মজুত থাকা জাপানের রয়েছে ৩২৪ মিলিয়ন ব্যারেল, যা আমদানি ছাড়া ১৩৩ দিনের চাহিদা মেটাতে পারবে। চতুর্থ অবস্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে ১৪৬ মিলিয়ন এবং স্পেনের ১২০ মিলিয়ন ব্যারেল সংরক্ষণ সক্ষমতা।

প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট লবণের সুড়ঙ্গে রয়েছে বেশিরভাগ দেশের কৌশলগত মজুত। এটি জ্বালানি ট্যাংক নির্মাণের খরচের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী, পরিবেশগতভাবেও নিরাপদ। এভাবে দীর্ঘকাল অপরিশোধিত জ্বালানি সংরক্ষণের সুবিধা মেলে।  

প্রয়োজনের সময় অনেকবার কৌশলগত মজুত থেকে বাজারে সরবরাহ করেছে মার্কিন সরকার। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০০৫ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় (হ্যারিকেন) ক্যাটরিনা এবং ২০০৮ সালের হ্যারিকেন ক্যাটরিনা পরবর্তী সময়ে। এ দুটি দুর্যোগের পর, আমেরিকার মেক্সিকো উপসাগর তীরের জ্বালানি শোধনাগারগুলি থেকে তেল সরবরাহ ব্যাহত হয়েছিল।

চলতি বছরে বড় কৌশলগত মজুত থাকা একমাত্র দেশ হিসাবে এটি থেকে বাজারে বিপুল পরিমাণে বিক্রি করেছে আমেরিকা। স্থানীয় বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেখা দেওয়া সরবরাহ ঘাটতি পূরণেই মার্কিন সরকার এ উদ্যোগ নেয়। 

বৃহৎ মজুত থাকা অন্যান্য  দেশ তাদের এসপিআর ধরে রাখছে। 

সরকারি এসপিআর মজুত থেকে ঋণ আকারে, সরাসরি বিক্রি বা কোনোকিছুর বিনিময়েও বাজারে সরবরাহ করা হয়। 

তেল রপ্তানিকারক দেশগুলি যেন উৎপাদন কোটা পূরণে সহায়তা পায় এজন্য বাণিজ্যিক সংরক্ষণাগার চুক্তির প্রচলন বেড়েছে। এতে করে, আমদানিকারক দেশে রপ্তানিকারক দেশের চালান মজুত রাখা যায়।  

এসব মজুত আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানিকারক দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পদ হলেও– এতে করে আমদানিকারক দেশ প্রয়োজনের সময় বাণিজ্যিক এ মজুত ব্যবহারের সুবিধা পায়। ফলে লাভবান হয় উভয়পক্ষই। 

তেল মজুত ভাগাভাগির চুক্তি আছে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির মধ্যে। এর আওতায় তারা জরুরি মুহূর্তে একে অন্যের রিজার্ভ থেকে তেল কিনতে পারে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেও রয়েছে একই রকম চুক্তি। 

বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি এবং দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হলেও–কৌশলগত রিজার্ভ সে তুলনায় ছোট ভারতের।

ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি ভোক্তা ও আমদানিকারক। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি ২১২.২ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে ১১৯.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। এ তথ্য জানা গেছে দেশটির তেল মন্ত্রণালয়ের পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড এনালাইসিস সেলের সূত্রে। 
 
শুধু ২০২২ সালের মার্চ মাসেই তেল আমদানিতে ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ভারত। এসময় ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে বিশ্ববাজারে তেলের দর। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.