মোরাল পুলিশিং: দুই দশক ধরে যে বর্বরতার শিকার ইরানের নারীরা

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
23 September, 2022, 02:35 pm
Last modified: 23 September, 2022, 03:19 pm
ইরানে ১৯৮৩ সালে প্রণীত একটি নতুন আইনে হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়।

ইরানের তথাকথিত নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ বা মোরাল পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যু বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদের সূচনা করেছে গোটা ইরান জুড়ে। হিজাব পুড়িয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায় দেশটির নারীরা। নারীদের এই প্রতিবাদ মূলত ১৯৭৯ সালের ইরানি নারীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর নিয়মের বিরুদ্ধে সত্তরের দশকেও পথে নেমেছিলেন নারীরা। কিন্তু তখনও কি মোরাল পুলিশের অস্তিত্ব ছিল?

গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রোল) হলো ইরানের বিশেষ পুলিশ ইউনিট যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করা এবং 'সঠিকভাবে' পোশাক না পরা ব্যক্তিদের আটক করা।

ইরানের নিজস্ব শরিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রণীত আইনের অধীনে, নারীদেরকে নিজেদের চুল হিজাব (হেড স্কার্ফ) দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা এমন পোশাক পরতে হবে যাতে তাদের দেহের অবয়ব না বোঝা যায়।

১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানে মোরাল পুলিশ যখন মাহসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে তখন তার সামনের দিকে চুল হিজাবের বাইরে দৃশ্যমান ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। তাকে আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি কোমায় চলে যান এবং তিনি দিন পরে হাসপাতালে মারা যান। কিন্তু পুলিশ তার মৃত্যুর সকল দায় অস্বীকার করেছে।

ইরানে ১৯৮৩ সালে প্রণীত একটি নতুন আইনে হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়।

যদিও সংস্কারপন্থী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামির অধীনে জনসমক্ষে পোশাক এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার রাষ্ট্রীয় কঠোরতা হ্রাস পায়, ২০০৫ সালে তার মেয়াদ শেষে দেশটির সুপ্রিম কাউন্সিল 'সতীত্বের সংস্কৃতি বিকাশের কৌশল' নামে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করে।

মোরাল পুলিশের যাত্রা শুরু মূলত এখান থেকেই। খাতামির উত্তরসূরি, অতি-রক্ষণশীল মাহমুদ আহমাদিনেজাদের অধীনে নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ বা গাশত-ই-এরশাদ গঠিত হয়।

পরবর্তীকালে ২০০৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরাল পুলিশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক হয়। সেসময় সংস্কারপন্থী প্রার্থীরা এই বাহিনী ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাদের কঠোর আচরণের ভিডিও বা প্রমাণ সামনে আসলেও মোরাল পুলিশ সরানোর বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

মাহসা আমিনি কিন্তু মোরাল পুলিশের বর্বরতার প্রথম শিকার নন। মোরাল পুলিশের প্রথম প্রকাশ্য শিকার জাহরা বানি ইয়াগুব। ২০০৭ সালে ২৭ বছর বয়সী তেহরানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক জাহরা বানি-ইয়াগুবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিজের বাগদত্তার সাথে একটি পার্কে বসে ছিলেন তিনি। আটকের দুই দিন পর আটক কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান যে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

মাহসার পরিবারের মতোই জাহরার পরিবার তাদের মেয়ের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করে। এমনকি জাহরার মৃত্যুর খবর প্রকাশের ১৫ মিনিট আগেই তিনি তার ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন বলে দাবি করে তার পরিবার। তার আত্মহত্যার কোনো কারণই ছিলোনা বলে অভিযোগ করেন তারা।

জাহরার পরিবার আরো জানায়, তার শরীর ক্ষতবিক্ষত ছিল এবং তার নাক ও কানে রক্ত ​​ছিল।

জাহরার মৃত্যুতে তার বাবা কয়েকজনকে বাদী করে মামলা করার ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের কোন শাস্তি হয়নি। এমনকি তাদের পুরো নামও জানা যায়নি।

মোরাল পুলিশের শিকার হওয়া অসংখ্য নারীদের মধ্যে আরেকজন ছিলেন তেহরান আজাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে পুলিশের একটি পেট্রোল ভ্যান সেই নারীকে রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ছাত্রী একটি চলন্ত টহল ভ্যানের সামনে ঝুলে আছেন। কিছু সময় পর ভ্যানটি থেমে গেলেও ওই ছাত্রীর কী হয়েছিল তা এখনো জানা যায়নি।

তেহরান পুলিশের কমান্ডার দাবি করেন, ওই নারী পুলিশ ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং চালক তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দেন।

এর পরের বছর, ২০১৯ সালে তেহরানের ওয়াটার ফায়ার পার্ক থেকে পাঁচ কিশোর-কিশোরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পানি নিয়ে খেলার অভিযোগে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ঘটনারও একটি ভিডিও সেসময় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, গাড়িতে উঠতে বাধা দেওয়ায় এক কিশোরীকে মারধর করছে পুলিশ।

পুলিশ দাবি করে, গ্রেপ্তারকৃত কিশোরী পুলিশ অফিসারকে 'অসম্মান' করেছিল।

এরপর ২০২১ সালে পশু ধরার ফাঁদের খুঁটি দিয়ে একজন নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেবছর অনলাইনে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ ঐ নারীকে এমন একটি খুঁটি দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে যা প্রাণীদের জীবিত ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়।

সেসময় তেহরানের সামাজিক বিষয়ক ডেপুটি পুলিশ কমান্ডার কর্নেল মোরাদ মোরাদি এই ধরনের হাতিয়ার ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেন। "বিতর্কিত ভিডিওতে যা দেখা গেছে তা কোনো খুঁটি ছিল না, বন্দীর ব্যাগের স্ট্র্যাপ ছিল," তিনি দাবি করেন।

তবে তিনি স্বীকার করেন যে কর্মকর্তারা অপেশাদারভাবে কাজ করেছেন এবং নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। তা সত্ত্বেও কর্মকর্তাদের এ নিয়ে জবাবদিহি করতে হয়নি এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

  • সূত্র: রয়টার্স ও ইরানওয়্যার

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.