জাকারবার্গের অদক্ষ নেতৃত্বই 'ফেসবুক'কে পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে: হার্ভার্ডের বিশেষজ্ঞের দাবি   

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
13 September, 2022, 03:55 pm
Last modified: 13 September, 2022, 04:09 pm
জাকারবার্গের অতীত সাফল্যের দিকে তাকালে তার বিপক্ষে বাজি ধরা কঠিন! কিন্তু তবুও বিল জর্জ জাকারবার্গকেই কেন দায়ী করেছেন? জাকারবার্গের একজন বাজে সিইও বা বস হবার পেছনে ৩টি কারণ দেখিয়েছেন জর্জ।
হার্ভার্ডের বিশেষজ্ঞ বিল জর্জের ভাষ্যে, জাকারবার্গ স্রেফ খ্যাতি ও সম্পদের পেছনে ছুটছেন। ছবি: সংগৃহীত

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সিনিয়র ফেলো এবং মেডিকেল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেডট্রোনিকের সাবেক সিইও বিল জর্জ দাবি করেছেন, ফেসবুক এর সিইও হিসেবে মার্ক জাকারবার্গের অদক্ষ নেতৃত্বই প্ল্যাটফর্মটিকে পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাকারবার্গ দিন দিন ফেসবুককে এর আসল পথ থেকে বিচ্যুত করছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে বিল জর্জের বলেন, "আমি মনে করি তিনি (জাকারবার্গ) যতদিন আছেন, ততদিন ফেসবুক ভালো কিছু করতে পারবে না। এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে মানুষ দূরে সরে যাওয়ার অন্যতম কারণ জাকারবার্গ। তিনি সত্যিই পথ হারিয়ে ফেলেছেন।"

গত ২০ বছর যাবত কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বদানে ব্যর্থতার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন বিল জর্জ। সম্প্রতি নিজের কাজগুলোকে একত্রিত করে 'ট্রু নর্থ: লিডিং অথেনটিক্যালি ইন টুডে'স ওয়ার্কপ্লেস, এমার্জিং লিডার এডিশন' নামক একটি বই প্রকাশ করেছেন জর্জ।

জর্জের ভাষ্যে, যেসব বসেরা টাকা ও ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও নেতা হওয়ার উদ্দেশ্যটিই ভুলে যায়, তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। দুই দশক ধরে অসংখ্য হাই-প্রোফাইল কর্পোরেট নেতার অধঃপতন দেখে এবং বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার পরে জর্জ মনে করেন, মার্ক জাকারবার্গ এবং তার প্রতিষ্ঠান 'মেটা'ও বর্তমানে সেই একই পথে রয়েছে।

এ ব্যাপারে সিএনবিসি জাকারবার্গ ও মেটার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া পায়নি।

২০০৪ সালে আরও কিছু সহযোগীকে নিয়ে ফেসবুক (বর্তমানে মেটা) প্রতিষ্ঠা করেন মার্ক জাকারবার্গ। প্রতিষ্ঠানটির উল্কাগতিতে প্রসারের পেছনে এই টেক উদ্যোক্তার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। সোমবার সকাল পর্যন্ত মেটার মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের পরিমাণ ৪৫০.৪৬ বিলিয়ন ডলার।

ফেসবুক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক সময়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে রাতারাতি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পেয়েছেন জাকারবার্গ। মেটা নামকরণের পর এখন তিনি তার প্রতিষ্ঠানকে মেটাভার্সে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সিএনবিসির জিল ক্র্যামার গত ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, জাকারবার্গের অতীত সাফল্যের দিকে তাকালে তার বিরুদ্ধে বাজি ধরা কঠিন, হয়তো অবিবেচকের মতো কাজও বটে!

ক্র্যামার বলেছিলেন, "হয়ত এটা এখন আউট অব ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমি মনে করি, জাকারবার্গ আবারও ঘুরে দাঁড়াবেন।" সেই সাথে তিনি এও জানিয়েছেন যে, স্টক হ্রাস পাওয়া, কেলেঙ্কারি ও বিতর্কের পর্ব শেষেও মেটার ঘুরে দাড়ানোর রেকর্ড আছে।

কিন্তু এই সবকিছু জানার পরেও বিল জর্জ জাকারবার্গকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু কেন?

জাকারবার্গ অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপান!

বিল জর্জের বইয়ে পাঁচ ধরনের 'বাজে বস' এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনটি শ্রেণীতেই জাকারবার্গের নাম রয়েছে বলে জানান জর্জ!

প্রথমত, জর্জের ভাষ্যে- জাকারবার্গ এমন একজন বস যিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন না বা ভুল থেকে শিক্ষা নেন না। এর বদলে তিনি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে চান।
গত ফেব্রুয়ারিতে মেটার মোট বাজারমূল্যের ২৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লোকসান হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন! কিন্তু জাকারবার্গ ও তার কার্যনির্বাহীরা এর দায় চাপিয়েছে অন্যান্য বিষয়ের উপর, যেমন- ২০২১ সালে অ্যাপলের গোপনীয়তা নীতির পরিবর্তন, যার ফলে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছে বিজ্ঞাপন পৌছাতে না পারা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্ম টিকটকের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা।

কিন্তু এসব কারণের পাশাপাশি মেটাভার্স গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে যে প্রচুর ব্যয় হয়েছে তা তারা স্বীকার করেননি। জনসম্মুখে জাকারবার্গ এখনো আর্থিক ক্ষতির দায় স্বীকার করেননি, যদিও জাকারবার্গ বলেছেন, মেটাভার্স প্রযুক্তির পেছনে প্রচুর বিনিয়োগের ফলে আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠানটি 'উল্লেখযোগ্য পরিমাণ' ক্ষতির স্বীকার হবে।

কারো উপদেশ মানেন না জাকারবার্গ

বিল জর্জ বলছেন, জাকারবার্গ একজন একাকী মানুষ, যিনি সবকিছু একা হাতে করতে চান। তিনি কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন না, কেউ আগ্রহী হলে তাকেও দূরে সরিয়ে দেন। এ ধরনের বসেরা কারো কাছ থেকে সাহায্য, উপদেশ বা ফিডব্যাক নিতে চান না; ফলে ভবিষ্যতেও তারা ভুল করতেই থাকেন।

নিজের বিচক্ষণতার উপর শতভাগ আস্থা রাখার জন্য জাকারবার্গ সুপরিচিত... মাল্টিবিলিয়ন ডলারের টেক জায়ান্ট 'মেটা' প্রতিষ্ঠা করা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু শুরুর দিকে জাকারবার্গ বিশ্বস্ত উপদেষ্টাদের উপদেশ নিলেও, এখন তা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।

উদাহরণস্বরুপ, প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম এলিভেশন পার্টনার্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ফেসবুকের একজন প্রাথমিক বিনিয়োগকারী রজার ম্যাকনামির কথা বলা যায়। ২০০৬ সালে ম্যাকনামি জাকারবার্গকে ১ বিলিয়ন ডলারে ফেসবুক কেনার ইয়াহুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ দেন। ম্যাকনামি পরে জাকারবার্গকে প্রাক্তন সিওও শেরিল স্যান্ডবার্গকে নিয়োগের জন্য উৎসাহিত করেন, যিনি শেষ পর্যন্ত কোম্পানির বিজ্ঞাপন বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

দুইবারই, জাকারবার্গ ম্যাকনামির পরামর্শ মেনে নেওয়ায় সিদ্ধান্তগুলো খুবই সফল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মেটা প্রসারের সাথে সাথে জাকারবার্গ অন্যদের উপদেশ শোনা বন্ধ করে দেন। ম্যাকনামি ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কারকে এ তথ্য দেন।

২০১৬ সালে ম্যাকনামি ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মগুলোতে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রভাব সম্পর্কে জাকারবার্গকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু জাকারবার্গ কয়েক মাস ধরে ম্যাকনামিকে উপেক্ষা করে যান। সে থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই উপসংহারে পৌঁছায় যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের একটি প্রধান প্ল্যাটফর্ম ছিল ফেসবুক এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনেঙ্গের ভূমিকা থাকতে পারে।

জাকারবার্গ শুধু খ্যাতি ও লাভ চান!

শেষোক্ত সমস্যাটিতে বলা হচ্ছে যে, জাকারবার্গ স্রেফ খ্যাতি ও সম্পদের পেছনে ছুটছেন। জর্জের ভাষ্যে- এধরনের বসেরা কখনোই নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না, আরও বেশি টাকা-খ্যাতির পেছনে ছুটে চলেন।

জাকারবার্গ মেটার প্রসার ও লাভের দিকেই শুধু গুরুত্ব দিয়েছেন, এমনকি তা কোটি কোটি ব্যবহারকারীর স্বার্থের বিনিময়ে হলেও! জর্জ মনে করেন, এটা নতুন কিছু নয়। কারণ ফেসবুকের কারণে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে এবং তা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত বহু বিতর্কও রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, গতবছর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানতে পারে, মেটার মালিকানায় থাকা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের মানসিক সমস্যার পেছনে দায়ী, বিশেষত, টিনেজ মেয়েদের। কিন্তু তারা জানতে পারে, মেটা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে এ সমস্যাটি এড়িয়ে যাচ্ছিলো, যাতে করে ইনস্টাগ্রামের প্রসারে ব্যাঘাত না ঘটে।

"এখান থেকেই বোঝা যায় যে জাকারবার্গ তার প্রতিষ্ঠানের আয়, সম্পদ লাভ ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝেন না", এই বলে নিজের কথার ইতি টানেন জর্জ।

সূত্র: সিএনবিসি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.