একনায়কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন বাইডেন, তার বিজয়ই এখন পশ্চিমাদের ভরসা

আন্তর্জাতিক

সাইমন টিসডাল, গার্ডিয়ান
08 September, 2022, 08:00 pm
Last modified: 08 September, 2022, 08:05 pm
গণতন্ত্রের মৃত্যু নিয়ে আমেরিকায় এখন ভবিষ্যদ্বাণী চলছে। কিন্তু রাশিয়ায় গণতন্ত্র ইতোমধ্যেই মৃত।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাল্টাপাল্টি বাক্যবাণে জমে উঠেছে রাজনীতির অঙ্গন। গত বৃহস্পতিবার ফিলাডেলফিয়ায় এক ভাষণে পূর্বসুরী ট্রাম্প ও তার উগ্র সমর্থকদের যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে দাবি করেন বাইডেন।

ট্রাম্পও থেমে থাকেননি। পেনসিলভানিয়ায় বাইডেনকে পালটা আক্রমণ করে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন।

রাশিয়ার জন্যও সময়টা ভালো ছিল না। তারা গর্বাচেভের মতো মহান এক মানুষকে হারিয়েছে- যার রাশিয়াকে বদলে ফেলার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ওদিকে শি জিনপিং-এর কঠোর একনায়কতন্ত্রের অধীনে থেকে চীনের অবস্থাও বেহাল। সবমিলিয়ে বিশ্বজুড়েই গত এক সপ্তাহ ছিল গণতন্ত্রের জন্য এক কঠিন সময়।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে স্বৈরাচারী এই শাসকরা যেমন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনই অভ্যন্তরীণভাবেও যুক্তরাষ্ট্রে পপুলিস্ট চরমপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু সোনা আগুনে পুড়েই খাঁটি হয়।

কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার হুমকিগুলোই মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতার মূল্য অনুধাবন করাবে। স্বাধীনতা রক্ষায় তারাও সরব হবে। এটাই অন্তত একমাত্র আশার কথা। তবে আসলেই কি তাই? সেটা অবশ্য আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা ঝালাই করে নিতে পারবেন।

দীর্ঘদিন ট্রাম্পকে এড়িয়ে গেলেও শেষমেষ বাইডেন মুখ খুলেছিলেন। 'সেমি ফ্যাসিবাদ'-এর নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন রিপাবলিকানরা সহিংসতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। তবে সত্যিই ট্রাম্পের কোনো সমালোচনা নিতে না পারা কিংবা বৈধ বিচার বিভাগীয় তদন্ত পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করা পুরোপুরি গণতন্ত্রবিরোধী। ট্রাম্পের বিশ্বাস তিনি আইনের ঊর্ধ্বে!

অজস্র মিথ্যার পরেও ট্রাম্প মাঠপর্যায়ে ব্যাপক সমর্থন পেয়ে চলেছেন। রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা আবারও বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে ৫৯ শতাংশের বিশ্বাস ২০২৪ সালে ট্রাম্পের আবারও নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।

গণতন্ত্রের মৃত্যু নিয়ে আমেরিকায় এখন ভবিষ্যদ্বাণী চলছে। কিন্তু রাশিয়ায় গণতন্ত্র ইতোমধ্যেই মৃত। মিখাইল গর্বাচেভকে ভালোবাসুন বা অপছন্দ করুন, তাঁর মৃত্যু রাশিয়ানদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে, তারা কী হারিয়েছে আর কী পেতে পারত।

গর্বাচেভ তাঁর দেশকে বিশ্বের দরবারে উন্মুক্ত করার জন্য কাজ করেছিলেন। বিদ্বেষে ভরা পুতিন শেষ সোভিয়েত নেতাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করার মাধ্যমে বিশ্বের থেকে রাশিয়াকে আলাদা করার সেই দেয়াল পুনর্নির্মাণের বিষয়টিই নিশ্চিত করলেন।

ইউক্রেন যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ততই স্পষ্ট হবে যে পুতিনের দেওয়া ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও মাতৃভূমি রাশিয়াকে কোনঠাসা করতে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের দাবিগুলোর অধিকাংশই বানোয়াট।

আসলে পুতিন যা অনুভব করতে পারছেন- তা হলো তার দেশের দোরগোড়ায় জেগে উঠা গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্র তার সমালোচনা করে, তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সোনালি দিন নিয়ে পুতিনের বাগড়ম্বর করাটাও যে মিথ্যা সেটাও গর্বাচেভ ভালোই জানতেন।

ফরেন অ্যাফেয়ার্সে ড্যান সুলিভান এবং ড্যানিয়েল টুইনিং লিখেছেন, তাইওয়ান নিয়ে শি'র দৃষ্টিভঙ্গি ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মতোই। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাইওয়ানে চীনের টহলদারির পর গত সপ্তাহে তারা পালটা আক্রমণে একটি ড্রোন নামায় যার কোনো চিহ্ন বা পরিচয় ছিল না।

তাইওয়ান এক সমৃদ্ধ গণতন্ত্র যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে এবং যাদের নির্বাচনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রই যে কেবল চীনের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে এমন ধারণা যে কতটা ভুল তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তাইওয়ান।

চীনের একনায়কতন্ত্রের অবস্থা ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বাজে। গত সপ্তাহের দুটি ঘটনাতেই তার ইঙ্গিত মিলে।

পলিটব্যুরোর এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অক্টোবরে শি-র তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। মাও সেতুং আর উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসকদের পুনরাবৃত্তির দেখাই মিলবে আবার।

অন্যদিকে বিধ্বস্ত হংকং-কেও যেন চীনের বাকি সব অঞ্চলের মতো ঠুলি পড়ানো যায় সেই প্রচেষ্টাতেও আরেক ধাপ এগিয়েছে বেইজিং। জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগে অ্যাপল ডেইলির প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাই-কে জুরি ছাড়াই আদালতে তোলা হবে। এর পরিবর্তে সরকারিভাবে অনুমোদিত বিচারকরা লাই-এর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। লাই ছাড়াও আরও ৪৭ জন গণতন্ত্র সমর্থনকারী অ্যাক্টিভিস্টের পৃথক পৃথক ট্রায়ালেও আরেক নাটক রচিত হতে চলেছে।

তবে বৈশ্বিক গণতন্ত্রকে রক্ষার একটি সুযোগ এখনও রয়েছে। ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান, টোরি হোক কিংবা লেবার দল সবাইকে মানতে হবে যে এই আসন্ন বিপদ চীন ও রাশিয়ার তৈরি। শি ও পুতিন গণতান্ত্রিক বিশ্বের জোটবদ্ধতা ভাঙতে বদ্ধপরিকর। আর সেই উদ্দেশ্যেই এক নতুন যোজনা নিয়ে নেমেছে তারা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কী? সুলিভান ও টুইনিং-এর মতে 'পুরো বিশ্বকেই স্বৈরতন্ত্রের জন্য নিরাপদ করে তোলা'।

ইউক্রেন, তাইওয়ান ও অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে এই স্বৈরাচারী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অনেক কিছু করা যেতে পারে বা করা উচিত।  

এর জন্য পশ্চিমা-চালিত উদ্যোগের দরকার যার মাধ্যমে ব্যক্তি অধিকার ও সম্মিলিত অগ্রগতি নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক শাসনের পুনরুদ্ধারের প্রচারণা চলবে। ট্রাম্পের মতো যারা স্বৈরশাসকদের পক্ষে সাফাই গায় তাদের মতো কট্টর ডানপন্থীদেরও এক কাতারে আনতে সাহায্য করবে তা।

নির্বাচন নির্ভর রাজনীতিকে আরও ভালোভাবে কাজ করতে দিন। স্বাধীনতাকে সহজলভ্য ভাববেন না। একে রক্ষার জন্য যে মূল্য চুকাতে হয় তা দিন। বাইডেন ঠিকই বলেছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ২১ শতকের এক বড় চ্যালেঞ্জ।

গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার মাধ্যমেই কেবল এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব।


  • সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান থেকে পরিশীলিত
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.