হিমালয়ের হিমবাহ গলছে, ডুবছে পাকিস্তান, উপমহাদেশ মহাসংকটের মুখে!

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক 
07 September, 2022, 08:00 pm
Last modified: 07 September, 2022, 08:13 pm
এই অঞ্চলের প্রায় দুইশ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হিমবাহের জলপ্রবাহের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু, পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলায় রেকর্ড হারে গলছে এসব হিমবাহ। সংকুচিত হচ্ছে তাদের ব্যাপ্তি। এতে একদিকে ভয়াবহ বন্যা, আরেকদিকে ভবিষ্যতে মিঠা পানির চরম সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছে উপমহাদেশবাসী।    

প্রতিবছর গ্রীষ্মে ভারতের হিমাচল প্রদেশে পাহাড়ে চড়েন একদল বিজ্ঞানী। এই বিজ্ঞানীরা শৌখিন পর্বতারোহী নন, বরং যান একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে। তারা হিমালয় পর্বতশ্রেণির 'ছোটা শিগ্রি' নামক হিমবাহের বরফের গলন মাপতে যান, হিমবাহের এই ক্ষয় হচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলেই। আর তাতে কী পরিমাণ জলরাশি নিঃসৃত হচ্ছে– সেটার পরিমাপই তাদের উদ্দেশ্য। 

গত দেড় দশক ধরে তারা পর্বতে তুষারের আচ্ছাদনের মাত্রা, মাটি ও বায়ুর তাপাঙ্ক, হিমবাহে বরফ সঞ্চয় বা বরফ গলে জলরাশির নিঃসরণ মেপে আসছেন। হিমবাহের এই জলধারাই প্রবাহিত হয় পর্বতের পাদদেশের উপত্যকা দিয়ে, ছোটখাট অজস্র স্রোতধারাগুলিই ধীরে ধীরে উপমহাদেশের এক একটি প্রধান নদীর জন্ম দিয়েছে। 

এই অঞ্চলের প্রায় দুইশ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই স্রোতধারার ওপর তথা হিমবাহের জলপ্রবাহের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু, পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলায় রেকর্ড হারে গলছে এসব হিমবাহ। সংকুচিত হচ্ছে তাদের ব্যাপ্তি। এতে একদিকে অকাল বন্যা, আরেকদিকে ভবিষ্যতে মিঠা পানির চরম সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছে উপমহাদেশবাসী।    

অভিযাত্রী বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতার কথাই বলা যাক প্রথমে, এ বছর তারা হন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের সাক্ষী। এবার 'ছোটা শিগ্রি' গ্লেসিয়ারের গলন এত বেশি হয়েছে, যার প্রচণ্ড প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে যায় তাদের পরিমাপ কেন্দ্র।  

বিজ্ঞানী দলের সদস্য ও ইন্দোর-ভিত্তিক ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির হিমবাহবিদ মো. ফারুক আজম সেই অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন এভাবেই, 'জুনে আমরা পরিমাপ কেন্দ্রটি স্থাপন করি, কিন্তু আগস্টে সেখানে ফিরে তার কোনো চিহ্নও খুঁজে পাইনি'।  

তিনি বলেন, 'এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে গ্রীষ্মের শুরুতেই দেখা দেয় চরম তাপদাহ, যা ১০০ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গে। তার ফলে বিপুল গতিতে গলেছে হিমবাহ। গত সপ্তাহে আমাদের বৈজ্ঞানিক দলটি আরেকটি হিমবাহে ছিল, সেখানে আমরা হিমালয়ে রেকর্ড মাত্রায় বরফের গলন লক্ষ করেছি'।  

চলতি বছরের গ্রীষ্মে, পুরো পৃথিবী জুড়েই তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে দাবদাহ। ফলে ইউরোপের আল্পস থেকে শুরু করে হিমালয় পর্বতশ্রেণি– সবখানেই অতীতের সব নজির ছাড়ায় বরফের গলন। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বাইরে সবচেয়ে বেশি স্বাদু পানি জমা আছে হিমালয় পর্বতশ্রেণি ও এর শাখা পর্বতশ্রেণিতে।  

বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি তাদের ধারণার চাইতেও উদ্বেগজনক মাত্রায় গলিয়ে ফেলছে হিমালয়ের হিমবাহগুলিকে। অথচ পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার সাথে নাজুক ও পরস্পর-সম্পর্কিত রয়েছে এগুলোর। হিমবাহ গলায় জলবায়ু ব্যবস্থার ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে, হয়ে উঠছে আরও অস্থিতিশীল। ব্যাহত হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা জলচক্র।   

এই প্রভাব বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান পাকিস্তানে। সেখানে বন্যায় ডুবে গেছে লাখো একর কৃষিজমি আর জনপদ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ কোটির বেশি মানুষ, গত জুনের পর থেকে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

বালুচিস্তান প্রদেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী তার শিশু সন্তানকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। ছবি: এএফপি/ ভায়া জাপান টাইমস

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আরও উষ্ণ হয়ে উঠেছে আরব সাগরের পানি। বাষ্পীভবন বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর বর্ষায় রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয় পাকিস্তানে। তার সাথে ছিল- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুতে দেখা দেওয়া 'লা নিনার প্রভাব। 'মরার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়েছে হিমবাহের অতি-গলন।

সার্বিক পরিণতিকে, পাকিস্তানী কর্মকর্তারা 'জলবায়ু বিপর্যয়'- এর চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন।   

যদিও এ বিপর্যয় কেবল শুরু হয়েছে মাত্র। সামনে আসছে আরও ভয়াল দশা। কারণ, সাধারণত রেকর্ড বন্যার পরই ধেয়ে আসে চরম খরা। 

পাকিস্তানের জীবনীশক্তি বলা যায় সিন্ধু নদীকে। ঐতিহাসিক সময় থেকেই সভ্যতা ও মানব বসতির পৃষ্ঠপোষক এই নদীর স্রোত ও তার বয়ে আনা উর্বর পলি। তাই সিন্ধু অববাহিকাতেই জনবসতি বেশি পাকিস্তানে। 

তিব্বত থেকে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করাচিতে এ নদী গিয়ে মিশেছে আরব সাগরে। নদী অববাহিকার দৈর্ঘ্য ফ্রান্সের দ্বিগুণ, পাকিস্তানের ৯০ শতাংশ খাদ্য এখানেই উৎপাদন হয়।   
 
যখন এই অববাহিকায় বন্যা আসে, তখন মাটির জলশোষণ খুব একটা বাড়ে না। বেশিরভাগ পানিই সরাসরি গিয়ে পড়ে আরব সাগরে। তাতে করে জল সংকট দেখা দেয় শুস্ক মৌসুমে। 

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ার ১৫০-১৭০ কোটি মানুষ ক্রমহ্রাসমান সুপেয় জলের সংকটে পড়তে পারে। 

তাই পাকিস্তানে বানের জল নেমে যাওয়ার অনেক পরও এর অভিঘাত পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতেই অনুভূত হতে থাকবে। কারণ, এবার বিরূপ আবহাওয়া ব্রাজিল থেকে শুরু করে ফ্রান্স, চীন, আমেরিকা–সবখানেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কৃষিকাজ ও খাদ্য উৎপাদন। তার সাথে এবার যোগ হবে–পাকিস্তানের বুভুক্ষ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা।  

জলবায়ুতে বরফের অবদান

বরফপুঞ্জ জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে যে অবদানকে একটি  'ক্রায়োস্ফিয়ার' ব্যবস্থা বলা হয়। সাগরে ভাসমান বরফ থেকে শুরু করে স্থল-হিমবাহ, পার্মাফ্রস্ট, পর্বত চূড়ার বরফ সবই এর আওতায় পড়ে। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় বরফ শুধু নদী প্রবাহেই প্রাণ সঞ্চার করে না বরং এর সাদা রঙ সুর্যের বিকিরণকে প্রতিফলিত করে মহাশূন্যে ফেরত পাঠায়।

পৃথিবীর অন্যতম 'ক্রায়োস্ফিয়ার' হিমালয়, এটির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া– বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ধরন পাল্টাতে আরও ভূমিকা রাখছে বলে জানাচ্ছেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। তাতে মহাসাগরগুলি আরও উষ্ণ হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে খরা।  

হিমালয় এবং এর বর্ধিত দুটি প্রশাখা পর্বতশ্রেণি কারাকোরাম ও হিন্দুকুশে রয়েছে ৫৫ হাজার বেশি স্থল-হিমবাহ। এরমধ্যে ৭ হাজারের বেশি রয়েছে পাকিস্তানে। সাম্প্রতিক দশকে হিমবাহগুলি গলে সেখানে ৩ হাজারের বেশি ছোট বড় হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। মাঝেমধ্যেই পানির চাপে ভেঙে পড়ছে হ্রদের পাড়, বিপুল জলস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে জনপদ। বরফ যত গলছে, ততই বাড়ছে আকস্মিক ঢলের ঝুঁকি।  

হায়দরাবাদ-ভিত্তিক ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেসের গবেষণা পরিচালক ও অধ্যাপক অঞ্জল প্রকাশ ব্যাখ্যা করেন, 'সক্রিয় জলচক্রের সাথে মহাসমুদ্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে বিজ্ঞান অনেক আগেই স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। তবু কেউ যদি প্রশ্ন রাখেন, এই দুটি ব্যবস্থাই কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ? –তাহলে বলব, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নিয়ন্ত্রক প্রভাব রাখায় আসলে তারা অপরিহার্য'।   

তিনি বলেন, 'এই দুইয়ে মিলে যে একক ব্যবস্থার তৈরি হয়েছে, তা আসলে পৃথিবীর জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেজন্য একে রক্ষা করতেই হবে'।

ভারত ও পাকিস্তানে রেকর্ড মাত্রায় তাপদাহ এবং হিমবাহের ক্রমবর্ধমান ক্ষয় 'পৃথিবীর ছাদ' খ্যাত হিমালয়ে যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে– তা আগামী নভেম্বরে মিশরে অনুষ্ঠেয় কপ-২৭ জলবায়ু আলোচনায় প্রভাব ফেলতে পারে।  
জলবায়ু আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে– ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে দেওয়া সহযোগিতা বৃদ্ধি– যাতে তাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু, তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি গত এক দশকেও। এই সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ অনেক দেশ হচ্ছে চরম দুর্দশার শিকার। 

আয়োজক মিশরও রয়েছে চরম বিপদে। সেখানে প্রাণদায়ী নীল নদীর অববাহিকায় কমেছে জলপ্রবাহ, আর বাড়ছে সমুদ্রের নোনা জলের অনুপ্রবেশ। মিশরের খাদ্যের ঝুড়িখ্যাত অঞ্চলটির কৃষকদের জীবন তাতে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।  

উন্নত দেশগুলো ঐতিহাসিক বিচারে যে পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করেছে, সে তুলনায় সামান্য অংশের জন্য দায় রয়েছে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের। কপ-২৭ আলোচনায় তাই এবার তারা আরও বেশি তহবিল দেওয়ার জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। 

জলবায়ু ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও তারা অর্থ সহায়তা চাইবে।  

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির মধ্যে অষ্টম স্থানে থাকা পাকিস্তান– জলবায়ু ক্ষতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অথচ দেশটি পৃথিবীকে উষ্ণ করে তোলা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ১ শতাংশেরও কম করে বলে উল্লেখ করেন ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রতিনিধি মোহসিন হাফিজ।  

হাফিজ বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং আগাম সতর্কতার ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এই কাজ পাকিস্তান একা করতে পারবে না'। 

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক ক্লাইমেট এনালিটিক্স সংস্থার জলবায়ু বিজ্ঞানী ফাহাদ সাঈদ বলেন, কপ-২৭ সম্মেলনে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেজন্য ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত।  

'পাকিস্তানে এবছরের বন্যা পুরো বিশ্বের জন্যই জাগ্রত হওয়ার সতর্কবার্তা'- তিনি যোগ করেন। 


  • সূত্র: স্ট্রেইটস টাইমস, ব্লুমবার্গ 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.