বন্যায় পাকিস্তানের এক তৃতীয়াংশ তলিয়ে যাওয়ায় আশঙ্কা, জরুরি সহায়তার আহ্বান

আন্তর্জাতিক

টিবিএস রিপোর্ট
29 August, 2022, 03:55 pm
Last modified: 29 August, 2022, 04:00 pm
দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। করোনা মহামারি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বাজেট ঘাটতিতে টালমাটাল পাকিস্তানে এখন নতুন করে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট হিসেবে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা। 

পাকিস্তানে চলমান ভয়াবহ বন্যায় জুন থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজারেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে; ধ্বংস হয়েছে ৪ লাখেরও বেশি মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদ। শুধু এতটুকুতেই শান্ত হচ্ছে না এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ; দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, এভাবে ভারি বর্ষণ চলতে থাকলে দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড তলিয়ে যাবে পানির নিচে। স্মরণকালের ভয়াবহতম এই বন্যা মোকাবেলায় তাই জরুরিভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন জনিয়েছে পাকিস্তান সরকার।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি রোববার (২৮ আগস্ট) রাতে জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং হিমবাহ গলা পানির কারণে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ইতোমধ্যেই সংকটে থাকা অর্থনীতি আরও ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। সামনে আরও ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবনতি ঘটার আশঙ্কা উল্লেখ করে তিনি দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানান।

ছবি: ইপিএ
 

তিনি বলেন, "আমার আশা, শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সংস্থাগুলো সত্যিকার অর্থে ধ্বংসের মাত্রা উপলব্ধি করবে।" 

"এই পরিমাণ ধ্বংস আমি আগে কখনো দেখিনি, এটি ভাষায় বর্ণনা করা খুবই কঠিন বলে মনে করি ..." যোগ করেন তিনি। 

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। করোনা মহামারি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বাজেট ঘাটতিতে টালমাটাল পাকিস্তানে এখন নতুন করে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট হিসেবে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা। 

ছবি: ইপিএ

এমন পরিস্থিতিতে, চলতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সিদ্ধান্ত নেবে, ২০১৯ সালের বেলআউট প্রোগ্রামের সপ্তম এবং অষ্টম ধাপের ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাকিস্তানকে দেওয়া হবে কিনা। তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আইএমএফ অর্থ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইএমএফ ও পাকিস্তানের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন বলে জানান তিনি। এবং সামনের দিনে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি পাকিস্তানের বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সহায়তায় অংশ নেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পাকিস্তান সরকারের সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে আজ সোমবার (২৯ আগস্ট) তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রথম বিদেশি সহায়তা প্রবেশ করেছে পাকিস্তানে। দেশটির ৩৩ মিলিয়ন লোক এই দুর্যোগের সরাসরি ভুক্তভোগী, তাদের দুর্ভোগ কমাতে দেশজুড়ে বিশাল ত্রাণ অভিযান শুরু হয়েছে। 

বন্যায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৬১ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়েন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে চলেছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। 

ছবি: রয়টার্স

বন্যায় নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দেশটির উত্তরের পাহাড়ীঅঞ্চলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ডুবে গেছে রাস্তাঘাট এবং সেতু। ফলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাও কঠিন হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকর্ষণ পাকিস্তানের এ অঞ্চল। নদীর পাড় ভেঙে ১৫০ কক্ষ বিশিষ্টি একটি হোটেলসহ আরও অনেক ভবন ভেসে গেছে পানির প্রবল স্রোতে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরি রেহমানও সতর্ক করেছেন, এ বছরের বর্ষায় পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, "গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও গুরুতর জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান।" 

গেল সপ্তাহে সোয়াত নদী প্লাবিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে প্রবেশ করে বন্যা। বিশেষ করে এই প্রদেশের চরসদ্দা এবং নওশেহরা জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকার কয়েক হাজার মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, নিরুপায় হয়ে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ শিবিরে। 

প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র কামরান বনগাশ জানান, অনেকে রাস্তার ধারেও তাঁবু টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

ছবি: ইপিএ

তিনি আরও জানান, চরসদ্দা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এবং নওশেরা জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে দেড় লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে, জাতীয় অর্থনীতিতে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কতটা পড়েছে এবং পড়তে চলেছে তার মূল্যায়ন চলছে এখনও বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো। তবে অনুমানের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অবকাঠামো এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। 

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে পাকিস্তান। বিগত তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত দেখছে দেশটি। 

ব্যাপক মৌসুমি বৃষ্টিপাত কৃষিখাতের ওপরেও বিপর্যয়কর প্রভাব রাখবে বলে ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষকদের জমিজমা-ফসল সব পানিতে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে নিজের বক্তব্যেও উল্লেখ করেছিলেন বিলাওয়াল ভুট্টো। 

ছবি: রয়টার্স

নজিরবিহীন বর্ষা মৌসুমের প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের চারটি প্রদেশেই। প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং এরসঙ্গে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে পাকিস্তানে। 

দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। 

"আমি আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে এমন বন্যা আগে কখনও দেখিনি। চারদিক দিয়েই পাকিস্তান এখন পানির নিচে। আমি সবাইকে এগিয়ে আসতে এবং সাহায্য করতে অনুরোধ জানাচ্ছি," বলেন প্রধানমন্ত্রী।

 

  • সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.