আসছে শীত, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থনের নজিরবিহীন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে ইউরোপকে

দেখতে দেখতে কেটে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাস। দীর্ঘ এ সময় রাশিয়ার মতো বৃহৎ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে কিয়েভের পাশেই ছিল পশ্চিমারা। একাট্টা এই সমর্থন অনেক পর্যবেক্ষককেই বিস্মিত করেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে ইউরোপের সাথে সম্পর্কের ফাটল ধরেছিল আমেরিকার। কিন্তু, আটলান্টিকের উভর পাড়ের মিত্ররা সে দূরত্ব কাটিয়ে উঠতে পেরেছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ট্রান্স-আটলান্টিক এই জোট এখন ঐক্যবধ্য হয়ে কিয়েভকে অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিসহ পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।
যুদ্ধের অর্ধবছর এভাবে পার হওয়ার পর, সামনে এখন অন্ধকার শীতকালের হাতছানি। ইউরোপীয় দেশগুলির শীর্ষ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এই হিমেই ভেঙে পড়তে পারে রুশ-বিরোধী জোটের ঐক্য। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ও ঘর উষ্ণ রাখার মতো জ্বালানির অপর্যাপ্ত সরবরাহ এই অনৈক্যের বীজ বুনতে পারে। তার ওপর মন্দার ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে, পশ্চিমা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা সরকারগুলির মধ্যে স্পর্শকাতর আলোচনা অকপটে জানিয়েছেন মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন'কে। আর সেই সূত্রেই মিলেছে এমন ইঙ্গিত।
সংকট জানতে গোপন আলোচনা না জানলেও চলে অবশ্য। গণমাধ্যমের শিরোনামেই এখন ইউরোপের সংকট জায়গা দখল করে রেখেছে। মানুষ প্রত্যক্ষও করতে পারছে তার লক্ষণ।
যেমন বিদ্যুৎ বাঁচাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ও সৌধগুলিকে রাতের বেলাতেও আলোকিত করার বাতিগুলো এখন নিভিয়ে রাখা হচ্ছে। এয়ার কন্ডিশনিং চালু থাকা অবস্থায় দরজা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ফ্রান্সের দোকানগুলিকে, এই নির্দেশ না মানলে তাদের জরিমানা দিতে হবে।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সস্তায় রাশিয়ান জ্বালানি কেনার রাস্তা বন্ধ করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে বসেছে ইউরোপ। এই উপলদ্ধি এখন সরকার পর্যায়েও হচ্ছে।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি রুশ আগ্রাসনের সময়ে অবিচল থেকে পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রশংসা কুড়ান। হয়ে ওঠেন রুশ বিরোধীতার আইকন। তিনি পশ্চিমা মিত্রদের ওপর আরও সহায়তা দেয়ার চাপও সৃষ্টি করেন এই খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে। মস্কোকে শায়েস্তা করছে ইইউ ও ন্যাটো জোটও তাতে ব্যাপক সাড়া দেয়। ফলস্বরূপ দীর্ঘায়িত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। নাহলে ক্রেমলিন অনেক আগেই বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেত।
জেলেনস্কির সেই সুদিন এবার হয়তো ফুরাবে। ইউরোপের নেতারা যখন নিজ দেশের অর্থনীতিতে আসা ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত থাকবেন– তখন তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করাই কঠিন হবে জেলেনস্কির পক্ষে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- চ্যাথাম হাউজের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ফেলো কেইর গাইলস ব্যাখ্যা করেন, 'পশ্চিমাদের সহায়তা লাভ নিয়ে যুদ্ধের প্রথমদিন থেকে ইউক্রেন সমস্যায় পড়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জ আগামী দিনেও ফিরে আসছে। পুতিন খাদ্যশস্য ও জ্বালানি সরবরাহকে জিম্মি করায় তার ভুক্তভোগী হচ্ছে ইউরোপ। এই অবস্থায় তাদের অব্যাহত সমর্থন লাভ, কিয়েভের জন্য সহজ হবে না'।
যুদ্ধ যত দীর্ঘদিন চলবে, ইউরোপের সংকট ততো জটিল রূপ নিবে। গাইলস বলেন, 'হয়তো একারণেই বড়দিনের আগে যুদ্ধ শেষ করতে চান বলে মন্তব্য করেন জেলেনস্কি। তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন, পশ্চিমারা আরও দীর্ঘদিন সহায়তার প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে পারবে না'।

যুদ্ধের আগে ২০২১ সালে ইউরোপের প্রায় ৫৫ শতাংশ গ্যাস আসতো রাশিয়া থেকে। এবারের শীতের আগেই সে পরিমাণে বিপুল সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আসন্ন শীতের জ্বালানি মজুত গড়া নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবতে হচ্ছে ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের।
ইউরোপের জ্বালানি ক্ষুধা মেটানোর আরেক উপায় ছিল রাশিয়ান জ্বালানি তেল। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই রপ্তানি হতো সেখানে। ২০২১ সালে দৈনিক প্রায় ২২ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল (ক্রুড) আমদানি করেছে ইইউ।
ইইউ সদস্য দেশগুলির মধ্যে রাশিয়ান গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাতে একটি সমঝোতা হয়েছে– সেদিকে ইঙ্গিত করে ইউরোপীয় একজন কূটনীতিক বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে এটি বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। তবে গ্যাস ও অন্যান্য উৎস থেকে রাশিয়ার আয় কমানোর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমাদের চেষ্টা করতেই হবে'।
তবে এই সমঝোতা পালন বাধ্যতামূলক নয় কোনো দেশের জন্য। তাই অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, সংকটকালে অনেক দেশই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করবে না।
গাইলস বলেন, পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়া থেকে অনেকটা দূরে থাকায়, এসব রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবোধও বেশি। তাদের অর্থনীতি বড়, সামরিক শক্তিও উল্লেখযোগ্য। তাই রাশিয়ান জ্বালানি কেনা মানেই যে নির্ভরশীলতার খাল কেটে কুমির ডেকে আনার মতো বিপদ– তাদের সেটা বোঝানোই মুশকিল। অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ায়, তারা এখন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আশাও করছে'।
এই দেশগুলির কর্মকর্তাদের আরও শঙ্কা যে, ইউক্রেনীয়দের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া আসলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সমাধান হয়ে উঠেছে। কারণ এই যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্পষ্ট নয়, শেষ কীভাবে হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। সংঘাত বিরামহীনভাবে চলছে তো চলছেই।
ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠিয়েছে পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স। জার্মানি তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর শান্তিবাদী নীতি থেকে সরে এসে আগ্রাসীভাবে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। অস্ত্রও দিচ্ছে কিয়েভকে।
ন্যাটোর একজন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, 'যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া যতোটা আশা করেছিল, পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া ছিল তার চেয়ে কঠোর। আসলে তাদের পক্ষে ইউক্রেনের পেছনে সমর্থন দান তখন রাজনৈতিকভাবে সহজ ছিল। অস্ত্র ও অর্থ দিতেও ছিল না তেমন বাধা'।
'কিন্তু, দিন যত গেছে অস্ত্র পাঠানোর জটিলতা ততো বাড়ছে। অস্ত্র সঠিকভাবে চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে একই সমস্যা। ইউক্রেনীয়রা অস্ত্র পেয়ে যুদ্ধে টিকতে পারছে আপাতত, কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘদিন চলবে ততোই কমতে থাকবে এগুলির সরবরাহ। নিজেদের অস্ত্রাগারে টান পড়লে, ইউরোপের দেশগুলি সহজে এত অনুদানও দিতে চাইবে না' –যোগ করেন তিনি।

যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও সামরিক মূল্যই কেবল ইউরোপের বদন্যতায় লাগাম দিচ্ছে না; রয়েছে আরও বড় শঙ্কা। ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে বিশ্ববাসী ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে– দেশে দেশে শুরু হয়েছে আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলির সরকারও এই দীর্ঘ যুদ্ধে রসদ দেওয়ার জন্য পশ্চিমাদের ওপর বিরক্ত।
এবিষয়ে ন্যাটোর একজন কূটনীতিক বলেন, 'গেল ফেব্রুয়ারিতে পুতিন-বিরোধীতার হুজুগে মিছিলে যোগ দেয়া ছিল খুবই সহজ। এখন যুদ্ধ চলে এসেছে কৌশলগত এক পর্যায়ে, যখন সংঘাতের সংবাদ মানুষের কাছে আবেদন হারাচ্ছে। একঘেয়ে লড়াইয়ের দৈনিক অগ্রগতি এখন চাঞ্চল্যকর সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে না। আর তাতে যুদ্ধের উত্তেজক দৃশ্যধারণের সুযোগও কমেছে অনেকখানি'।
সে তুলনায় ইউরোপবাসীর কাছে বড় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা। এবারের শীত তাই হয়তো ইউক্রেনের জন্য পরাজয়ের বার্তা নিয়েই আসছে।
ইতোমধ্যেই, রাশিয়ার সাথে আপোষ করা দরকার এমন বার্তা দিয়ে রেখেছে জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো প্রভাবশালি দেশ। এজন্য আলোচনার দ্বার খোলা রাখার প্রতি জোর দিয়েছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। তিনি বিশ্বাস করেন, এক পর্যায়ে যুদ্ধ শেষ করতে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলেই বসতে হবে। রাশিয়ার গ্যাস কেনা নিয়ে কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ করায়, সম্প্রতি তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ।
ইউরোপীয় এক কূটনৈতিক বলেন, 'সব দেখেশুনে সন্দেহ জাগে, চূড়ান্ত লক্ষ্যের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী বদলে যাচ্ছে? আমরা কী রাশিয়াকে তার আগ্রাসন পূর্বের সীমান্তে ফেরত পাঠাতে চাই? আমরা কী এই যুদ্ধের পর পুতিনকে শায়েস্তা করব নাকি এই যুদ্ধের মাধ্যমেই তাকে সরানোর চেষ্টা চলবে? –দীর্ঘমেয়াদি এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। কিন্তু, বর্তমান সময় প্রশ্নগুলি করার সঠিক মুহূর্ত নয়'।
- সূত্র: সিএনএন