বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌ বাণিজ্য পথকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনা

আন্তর্জাতিক

কেভিন ভার্লে, ব্লুমবার্গ
03 August, 2022, 11:35 am
Last modified: 03 August, 2022, 01:18 pm
চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বিশ্বের সচল ৫,৪০০ কনটেইনারবাহী জাহাজের ৪৮ শতাংশ তাইওয়ান প্রণালী পাড়ি দিয়েছে। তারা এশিয়ার এই অংশ থেকে বিশ্বব্যাপী নিয়ে গেছে পোশাক, মুঠোফোন, সেমিকন্ডাক্টরসহ অন্যান্য লাখো ধরনের পণ্য।
ছবি-ব্লুমবার্গ

তাইওয়ান নিয়ে মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তার মধ্যেই মঙ্গলবার (২ আগস্ট) তাইওয়ানে পৌঁছেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।

চীন আগেই এ সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রকে 'কঠিন পরিণতি'র হুমকি দিয়েছে। দুই পরাশক্তির এই চোখ রাঙানি কি রূপ নেবে সংঘাতে?- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়াও যায় না বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে।

আর এ উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে- তখন বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত জাহাজ চলাচলের লেন নিয়ে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিও স্পষ্ট হচ্ছে। সামান্যতম সংঘাতময় পরিস্থিতি এ রুটে জাহাজ চলাচল ব্যাহত করতে পারে। তার ফলে সরবরাহ চক্রে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে–তার অভিঘাত অনুভূত হতে পারে পৃথিবীর সর্বত্র।

তাইওয়ান প্রণালী চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে অবস্থিত এশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্য জাহাজে করে ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য বাজারে পরিবহনের প্রধান নৌপথ। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক কনটেইনারবাহী জাহাজ বহর এবং প্রায় ৮৮ শতাংশ বৃহত্তম জাহাজ এই জলপথ পাড়ি দেয় বলে জানাচ্ছে ব্লুমবার্গের সংকলিত তথ্য।

তাইওয়ান প্রণালীতে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বৈশ্বিক শিপিং শিল্পের ওপর মারণ আঘাত হানবে। বিশেষ করে যখন মহামারির শুরু থেকেই প্রচণ্ড চাপে রয়েছে এই সরবরাহ ব্যবস্থাটি।

এখনও চীনের প্রধান কয়েকটি শহর লকডাউন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত সামলে ওঠার চেষ্টা করছে।

ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মারমুখী অবস্থানের কারণে মঙ্গলবার তাইওয়ানের তাইএক্স শিপিং অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন ইনডেক্স- নামক জাহাজ শিল্পের সূচকে ৩.২ শতাংশের বড় ধস নেমেছে। হয়ে উঠেছে তাইওয়ানের পুঁজিবাজারের মূল সূচকের অধীন সবচেয়ে বাজে পারফরর্ম করা উপ-সূচক। তাইওয়ানের শিপিং খাতের জায়ান্ট এভারগ্রিন মেরিন কর্পের বাজারমূল্য ৩.৭ শতাংশের মতো কমেছে।

তাইওয়ান নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে চীনের দীর্ঘদিনের বিরোধ থাকলেও, পেলোসির সফর তুঙ্গে তুলেছে উত্তেজনা।

এই বাস্তবতায় গত সোমবার মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি চীন এ সফরের প্রতিক্রিয়ায় যেসব পদক্ষেপ নিতে পারে বলে ওয়াশিংটন অনুমান করছে–সেসব সবিস্তারে তুলে ধরেন। আমেরিকার আশঙ্কার তালিকায় আছে, তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ; এই প্রণালীর মালিকানা নিয়ে 'অহেতুক' দাবি এবং সামরিক অভিযানের মতো পদক্ষেপ।  

এর আগে ১৯৯৫-৯৬ সালের তাইওয়ান সংকটকালে- চীন তাইওয়ানের বন্দরগুলির কাছে সমুদ্রে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। হামলার ভয়ে ব্যাহত হয় জাহাজ চলাচল– আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তখন বেইজিংকে আমেরিকার বাহুবলের স্মরণ করিয়ে দিতে দুই দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠান ওই অঞ্চলে।

চীনের নৌশক্তি তখন খুবই দুর্বল, ছিল না নিজেদের কোনো বিমানবাহী রণতরী। আমেরিকার চেয়ে সংখ্যায় কম হলেও, আজ চীনের কাছে মোট তিনটি এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। যুদ্ধজাহাজের সংখ্যাতেও এখন চীনা নৌবাহিনী সর্ববৃহৎ।

শক্তির এই নতুন ভারসাম্যের কারণে হয়তো আমেরিকা ও চীন–যুদ্ধের মাধ্যমে একে-অন্যের গলা কাটতে উদ্যত নাও হতে পারে। কিন্তু সংঘাত এড়ানো গেলেও তাইওয়ান প্রণালী নিয়ে আশঙ্কা দূর হওয়ার সুযোগ নেই।

ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নতুনভাবে প্রমাণ করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুর্বলের ওপর সবল প্রতিবেশীর জবরদস্তি রুখতে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' ক্ষেত্রবিশেষে। আগামী বছরগুলোয় এ থেকে উৎসাহিত হয়ে চীন তাইওয়ানে অভিযান চালাবে না–কেইবা তার গ্যারান্টি দিতে পারে!

আমেরিকার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মিলে সম্প্রতি কংগ্রেসকে বলেছেন যে, ২০২৭ সাল নাগাদ তাইওয়ান দখলের মতো সামরিক সক্ষমতা তৈরির লক্ষ্য নিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

আমেরিকা ও তার মিত্রদের দাবি, তাইওয়ান প্রণালী আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার অংশে পড়েছে। এজন্য তারা নিয়মিতভাবে এ জলপথে রণতরী পাঠায়– চীনকে চোখ রাঙিয়ে দূরে রাখতে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলোকে বলা হয়, ফ্রিডম অফ ন্যাভিগেশন এক্সারসাইজ। এক যুগে নৌপথের স্বাধীন চলাচল প্রতিষ্ঠার নামে এসব রণতরীর উপস্থিতি ভালই কাজ দিয়েছে। কিন্তু, সেদিনের চীন আর আজকের চীন এক নয়। এক নয় সামরিক শক্তি আর প্রযুক্তিও।   

তাই তো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনা কর্মকর্তারা তাদের মার্কিন প্রতিপক্ষদের সাথে বৈঠকে বার বার জোর দিয়েই বলেছেন, এই প্রণালী কোনোদিনই আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার অংশ নয়।  

সংঘাত পরিস্থিতি চীনেরও ক্ষতি করবে। এশীয় শক্তিটি বিশ্বের কারখানা নামেই পরিচিত। করে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি। যুদ্ধের আগুনে বিশ্বের সাথে চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিন্ন হবে। তারপরও আমেরিকা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, সামরিক শক্তিতে বলীয়ান চীনা নৌবাহিনী বিশ্ববাণিজ্যের ব্যস্ততম নৌপথগুলো অবরুদ্ধ করতে পারে। জবাবে গত জুনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'আন্তর্জাতিক জলপথগুলোর নিরাপত্তা এবং সেগুলোতে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে সক্রিয় রয়েছে চীন'।  

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় কম্যান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক কার্ল সুস্টার মনে করেন, 'সম্পূর্ণ প্রণালীকে অবরোধ করা (চীনের পক্ষে) খুবই কঠিন হবে; এতে যে সংঘাতের ঝুঁকি রয়েছে তা চীনের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে'।  

তিনি বলেন, 'অবরোধ করে চীন রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীকী বার্তা দিতে পারবে। তবে, বাইডেনের বর্তমান প্রশাসন এ ঘটনা বসে বসে দেখবে– শি জিনপিং হয়তো এমনটা বিশ্বাস করেন না'।

তারপরও ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলি অবরোধ করে রাশিয়া প্রমাণ করেছে, আঞ্চলিক সংঘাতের ঢেউ ছড়িয়ে যেতে পারে পুরো দুনিয়াতেই। পঙ্গু হতে পারে নিত্যপণ্যের বাজার আর তাতে মূল্যস্ফীতির আগুনই ছড়ায় দিকে দিকে। তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ জাহাজ চলাচল করে সেটি বিবেচনায় নিলে বলাই যায়– এখানে বাণিজ্যের সর্বোচ্চ মৌসুমে সামান্যতম ব্যাঘাত যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের ছুটির সময় পর্যন্ত পণ্যের সংকট তৈরি করবে।

চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বিশ্বের সচল ৫,৪০০ কনটেইনারবাহী জাহাজের ৪৮ শতাংশ তাইওয়ান প্রণালী পাড়ি দিয়েছে। তারা এশিয়ার এই অংশ থেকে বিশ্বব্যাপী নিয়ে গেছে পোশাক, মুঠোফোন, সেমিকন্ডাক্টরসহ অন্যান্য লাখো ধরনের পণ্য।

এখানে সংঘাত বাঁধলে জাহাজগুলি তাইওয়ানের পূর্ব উপকূল ধরে ফিলিপাইন সাগর দিয়ে যেতে পারবে। তবে তাতে যাত্রার সময় আরও কয়েকদিন বাড়বে। বিকল্প রুটও ঝামেলাহীন নয়।

যেমন ফিলিপাইন ও তাইওয়ানের মধ্যেকার লুজন প্রণালী উত্তর-দক্ষিণে চলাচলের একটি সম্ভাব্য বিকল্প হলেও– দক্ষিণ চীন সাগরের ঘূর্ণিঝড় (টাইফুন) মৌসুমে এখানে চলাচল খুবই বিপজ্জনক।

ফিলিপাইনের আশেপাশের সমুদ্র অঞ্চল দিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্রান্তীয় সাইক্লোন দক্ষিণ চীন সাগরে আসে। বছরে যার গড় সংখ্যা অন্তত ২০টি বলে জানাচ্ছে ফিলিপাইনের জলবায়ু বিভাগ। এর আগে ২০২১ সালে তিনটি টাইফুন পশ্চিম দিকে অনেক দূর পর্যন্ত আঘাত হানে, এতে করে সাংহাই ও হংকং বন্দর প্রভাবিত হলে, বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়।

  • সূত্র: ব্লুমবার্গ
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.