২০৮ বিলিয়ন ডলার সম্পদ নিয়ে মুখোমুখি আম্বানি ও আদানি
চলতি বছরের জুন মাসে ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি এবং তার সহযোগীরা একটি অপ্রত্যাশিত দ্বিধার মুখে পড়েন। আম্বানি সাম্রাজ্য পরবর্তীতে কোন খাতে বিনিয়োগে নজর দিবে, তা নিয়েই সৃষ্টি হয় এ দ্বিধা।
আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড যখন একটি বিদেশি টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট কেনার কথা ভাবছিল, ঠিক তখনই শোনা যায়, এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে আম্বানিকে ছাড়িয়ে যাওয়া গৌতম আদানি ভারতে ফাইভ-জি এয়ারওয়েভের প্রথম বড় নিলামে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছেন।
আম্বানির রিলায়েন্স জিও ইনফো কম লিমিটেড ভারতের মোবাইল বাজারের শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে আদানি গ্রুপের ওয়্যারলেস টেলিকমিউনিকেশন পরিষেবা দেওয়ার লাইসেন্সও নেই।
আম্বানির সহযোগীরা ইতোমধ্যেই তাকে বিদেশি লক্ষ্যের দিকে নজর দিতে এবং ভারতীয় বাজারের বাইরে বৈচিত্র্য আনতে পরামর্শ দিয়েছেন।অন্যদিকে, বাকি সহযোগীরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তহবিল সংরক্ষণের জন্য।
তবে, শেষ পর্যন্ত কোনো বিদেশি সংস্থার জন্য বিড করেননি ৯০ বিলিয়ন ডলারের মালিক আম্বানি। ১১৮.৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক আদানির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্থিকভাবে একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের নিজ নিজ ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসার প্রসার ঘটানোর পর, এখন এশিয়ার দুই শীর্ষ ধনী ক্রমশই একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছেন। এক্ষেত্রে, বিশেষভাবে নিজের ঐতিহ্যগত ক্ষেত্র ছাপিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আদানি।
ভারতে ই-কমার্স থেকে শুরু করে ডেটা স্ট্রিমিং এবং স্টোরেজ খাতের এই উদ্ভব- আদতে ১৯ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উত্থানের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেসময় জন্ম হয়েছিল কার্নেগি, ভ্যান্ডারবিল্টস এবং রকফেলারদের মতো বিলিয়নিয়ার অভিজাতবংশের।
মুম্বাইয়ের বিনিয়োগ উপদেষ্টা সংস্থা ক্রিস এর প্রতিষ্ঠাতা অরুণ কেজরিওয়ালের মতে, আম্বানি-আদানি দুটি পরিবারই ব্যবসার প্রসারের জন্য ক্ষুধার্ত। এর অর্থ হলো, তারা অনিবার্যভাবেই একে অপরের মুখোমুখি হতে চলেছেন।
"আম্বানি এবং আদানিরা একে অপরকে সহযোগিতা করবে, সহাবস্থান করবে এবং প্রতিযোগিতা করবে। পরিশেষে যোগ্যতমদেরই উত্থান ঘটবে" বলেন তিনি।
তবে, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদানি এবং আম্বানির কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
৯ জুলাই একটি পাবলিক বিবৃতিতে আদানি গ্রুপ বলে, বর্তমানে আম্বানির আধিপত্যে থাকা কনজিউমার মোবাইল স্পেসে প্রবেশ করার তাদের কোনো ইচ্ছা নেই। শুধুমাত্র 'প্রাইভেট নেটওয়ার্ক সলিউশন' তৈরি করতে এবং বিমানবন্দর ও সমুদ্র বন্দরে সাইবার নিরাপত্তা উন্নত করতে সরকারি নিলামে কেনা যেকোনো এয়ারওয়েভ ব্যবহার করবে তারা।
তাদের এই বিবৃতি সত্ত্বেও জল্পনা চলছে, গ্রাহকদেরকে বেতার পরিষেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন আদানি।
কয়েক দশক ধরে আদানির ব্যবসা বন্দর, কয়লা খনি এবং শিপিংয়ের মতো খাতগুলোতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু গত বছর ধরে তার ব্যবসার খাত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
মার্চ মাসে আদানি গ্রুপ সৌদি আরবে সম্ভাব্য পার্টনারশিপ নিয়ে বিবেচনা করেছে বলে উঠে আসে ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে। দেশটির শীর্ষস্থানীয় তেল রপ্তানিকারক 'আরামকো'তে আদানির শেয়ার কেনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া, দুই বিলিয়নিয়ার গ্রিন এনার্জিতেও একে-অপরের মুখোমুখি হয়েছেন। দুজনই এমন একটি জায়গায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের অগ্রাধিকারের সাথে ব্যাপকভাবে আবদ্ধ।
ইতোমধ্যে আদানি ডিজিটাল পরিষেবা, খেলাধুলা, রিটেইল, পেট্রোকেমিক্যাল এবং মিডিয়াতে আগ্রহী হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আম্বানির রিলায়েন্সেরও এসব খাতের কয়েকটিতে আগে থেকেই আধিপত্য আছে; পাশাপাশি অনেক খাতে নতুন করে বিনিয়োগের বড় পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
ইতিহাস বলে, টেলিকমিউনিকেশনে যদি আদানি গ্রাহকদের বড় আকারে লক্ষ্য করতে শুরু করেন- তাহলে প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্যায়ে দাম কমতে পারে। কিন্তু দুটি কোম্পানি যদি একইসাথে শক্ত অবস্থান ধরে রাখে, তাহলে তা আবার বাড়তে পারে।
আম্বানি যখন ২০১৬ সালে টেলিকমে বিনিয়োগ শুরু করেন, তখন তিনি বিনামূল্যে কল এবং খুব কম দামে ডেটা অফার করেন। তার এই সাহসী পদক্ষেপের ফলে সেসময় এই খাতে দাম কমতে থাকে। কিন্তু টেলিকমে আম্বানি নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার পর, আবারো বাড়তে থাকে দাম।
বাইরে থেকে, মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানি দুজন বেশ আলাদা। ৬৫ বছর বয়সী আম্বানি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে কোম্পানিটি পেয়েছেন; যেখানে ৬০ বছর বয়সী আদানি একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু তাদের কিছু উল্লেখযোগ্য মিলও আছে।
ব্যাপকভাবে মিডিয়া লাজুক এই দুই ব্যক্তির প্রচণ্ড রকমের প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। যেসব খাতেই তারা পা রেখেছেন, তার বেশিরভাগেই আধিপত্য বিস্তার করেছেন ভারতের এই দুই বিলিয়নিয়ার।
দুজনেরই চমৎকার ব্যবসায়ীক প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা রয়েছে; দুজনই অত্যন্ত বিশদ ভিত্তিক, দুজনেরই ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরণে বড় প্রকল্প পরিচালনার রেকর্ড রয়েছে।
দুজনেই মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় অগ্রাধিকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে নিজেদের ব্যবসায়িক কৌশলগুলোকে পরিচালনা করছেনও উভয়ে।
তবে মিল থাকলেও, আদানির সমস্ত চুক্তি রিলায়েন্সের সাথে মেলে না। বিশ্বের অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যেখানে আম্বানি বিদেশে ব্যয় করার বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে আছেন, সেখানে আদানি বিনিয়োগ করে চলেছেন।
জুলাই মাসে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরটি ১.২ বিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করে আদানি গ্রুপ। মে মাসে তারা হলসিমের ভারতীয় সিমেন্ট ইউনিট ১০.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়।
আদানি যেসব ক্ষেত্রে নতুনভাবে বিনিয়োগ করছেন বা বিনিয়োগের কথা ভাবছেন- তা এতটাই নতুন যে এসবের সম্পূর্ণ প্রভাব এখনই বিচার করা কঠিন। তবুও বিশ্লেষকরা একমত যে, আম্বানি-আদানি দুজনই ভারতীয় ব্যবসায়িক ল্যান্ডস্কেপ পুনর্নির্মাণে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন।
কিন্তু এ বিষয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে অনেকের। আহমেদাবাদের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভসের পরিচালক ইন্দিরা হিরওয়ে বলেন, "আম্বানি-আদানি যদি একে অপরের সাথে ওভারল্যাপ করেন এবং একসাথে কাজ করা শুরু করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট খাতের ছোট সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।"
"যদি তারা প্রতিযোগিতা শুরু করে- তাহলে তা ব্যবসায়িক ল্যান্ডস্কেপের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ দুটি কোম্পানিই সম্পদ এবং কাঁচামালের জন্য লড়াই করবে"- যোগ করেন ইন্দিরা।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ