মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি: হাইপার থেকে হাইব্রিডের যুগে

আন্তর্জাতিক

মারওয়ান বিশারা, আল জাজিরা 
23 July, 2022, 09:35 pm
Last modified: 24 July, 2022, 01:42 pm
পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো এক পরাশক্তির পক্ষে যোগ দিয়ে যে মেরুকরণের সূচনা করেছিল—বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই বৃহত্তর জোট গঠন থেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যে একটি পরিবর্তনশীল, কার্যসিদ্ধিমূলক জোট গঠনের নজির দেখা যাচ্ছে—আগে থেকে যার অনুমান করাই কঠিন।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকা ও রাশিয়ার সম্পর্কে প্রাধান্য পাচ্ছে নতুন ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলি সরাসরি কোনো এক পক্ষে যোগ দিতে অসম্মতি জানিয়ে, এই দ্বন্দ্ব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছে।  

পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো এক পরাশক্তির পক্ষে যোগ দিয়ে যে মেরুকরণের সূচনা করেছিল—বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই বৃহত্তর জোট গঠন থেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যে একটি পরিবর্তনশীল, কার্যসিদ্ধিমূলক জোট গঠনের নজির দেখা যাচ্ছে—আগে থেকে যার অনুমান করাই কঠিন।

স্নায়ুযুদ্ধের কালে মধ্যপ্রাচ্য মানেই ছিল বিদেশি শক্তির বৃহত্তর হস্তক্ষেপের অঞ্চল। সংগঠিত হয় সর্বাত্মক অনেক যুদ্ধ। 

স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকাল দুর্ভাগা মধ্যপ্রাচ্যের কপালে আরো বিপর্যয় নিয়ে আসে। গত দুই দশকে এ অঞ্চলেই হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতিমূলক সংঘাত। কিন্তু, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় যুদ্ধের মরণখেলা থেমে আসছে। সংঘাতগুলি গতি হারানোর সাথে সাথে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উভয় ধরনের শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের আগুন নতুন করে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের ক্লান্তি ও অনাগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আর তাতে করে সৃষ্টি হচ্ছে- নয়া ভূরাজনৈতিক পরিবেশ।

পরিবর্তনের এই গতি লক্ষ করা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আমেরিকা-আরব সম্মেলন এবং তেহরানে অনুষ্ঠিত রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনে।

জেদ্দায় গত সপ্তাহের সম্মেলনে, আমেরিকার ও তার আরব মিত্র (আসলে সমর্থনপুষ্ট) দেশগুলির মধ্যে বিভাজন ও অবিশ্বাসের দিকটি উঠে আসে।  মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশগুলিকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মস্কোর সাথে সকল সহযোগিতা ছিন্ন করতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেও- তাতে ব্যর্থই হয়েছেন।

ওয়াশিংটনের বার বার অনুরোধ আর চাপ সত্ত্বেও—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর; মস্কোর সাথে তাদের জ্বালানি ও অন্যান্য বাণিজ্যে ইতি টানবে এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। এ পরিস্থিতি ১৯৮০'র দশকের সম্পূর্ণ বিপরীত। স্নায়ুযুদ্ধের ওই দশকে প্রকাশ্যে আমেরিকার পক্ষ নেয় সৌদি আরব। ওয়াশিংটনকে খুশি রাখতে তেলের দাম কমায়, আবার আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনাদের তাড়াতেও সহায়তা করে।

বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বৃত্ত শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছেন ক্ষমতায় আসার আগে। তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এসব শাসকদের ওপর চাপ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতি তাকে মার্কিন 'জাতীয় স্বার্থের' খাতিরে সমালোচনায় লাগাম দিয়ে, আত্মসম্মানহানি করে হলেও মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে আসে। তারপরও, আমেরিকার নেওয়া সিদ্ধান্তকে মানতে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে রিয়াদ ও কায়রো।তাদের এই অবাধ্যতা, গত দুই দশকে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে লজ্জাজনকভাবে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়া আমেরিকার বৈশ্বিক পরাশক্তির মর্যাদা ও কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

চীনের উত্থানকালেই আগের তুলনায়- আমেরিকার প্রতিপত্তির তুলনামূলক পতন এবং রাশিয়ার পুনঃউত্থান ঘটেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার (স্নায়ুযুদ্ধকালীন) বিশ্বস্ত মিত্ররা বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে এক ধরনের হাইব্রিড পদ্ধতিমুখী হয়েছে। এই সম্পর্কের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি কোনো শক্তির প্রতি একান্ত সমর্থনের নয় বরং তাদের শাসকগোষ্ঠীর ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত।

ভাবগতিক দেখে মনে হয়, বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে সুসম্পর্ক ও নানান বিষয়ে দ্বিচারিতার ইসরায়েলি নীতি তার আরব প্রতিবেশীরা ভালোই রপ্ত করেছে। তেল আবিবের মতোই এখন মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ আমেরিকার অস্ত্র ও ত্রাণ চায়—কিন্তু তার পরামর্শ চায় না।

মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠতম ও একান্ত মিত্র হচ্ছে ইসরায়েল। অথচ বাইডেনের সফরকালে রাশিয়া, ইরান ও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আমেরিকার অনুরোধগুলি প্রত্যাখ্যান করেছে তেল আবিব। মার্কিন স্বার্থরক্ষায় যে ইসরায়েলের আনুগত্য ছিল 'সারমেয়'সম খ্যাতির (বা কুখ্যাতি)—তারাই শেষপর্যন্ত আমেরিকাক অবোধ কুকুর ছানার মতোই আদুরে ভঙ্গিতে শুধু সংবর্ধনা দিয়েছে, বিনিময়ে তার অন্য চাহিদাকে অবজ্ঞা করেছে।  

ইসরায়েল, সৌদি আরবের মতো আমেরিকার আরেক আঞ্চলিক মিত্র- তুরস্ক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য—দুই প্রান্তেই যার স্বার্থজড়িত—বেশ কিছুকাল ধরেই হাইব্রিড পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে আঙ্কারা।

তেহরানে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনে ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য দেশ ওয়াশিংটনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও ইরানের সাথে নতুন চুক্তি করেছে। এমনকী দিয়েছে ইরানকে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবও।

এর আগে তুরস্কের শর্ত মেনে দেশটির কাছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রিতে অস্বীকার করে আমেরিকা ও ন্যাটোর অন্যান্য মিত্ররা। তখন রাশিয়ার কাছ থেকে সর্বাধুনিক এস-৪০০ ক্রয় করে আঙ্কারা। তারপর থেকেই তুরস্ককে চরম বিতৃষ্ণার সাথে দেখছে আমেরিকা ও ইউরোপ। রিয়াদও এরপর একই রকম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে মস্কোর কাছ থেকে রুশ অস্ত্রটি ক্রয়ের আলোচনা শুরু করে।

তুরস্ক, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মতো—ইরানও হাইব্রিড সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে। সখ্যতা বাড়াচ্ছে চীন ও রাশিয়ার সাথে, পাশাপাশি আমেরিকাকে সাথে পরমাণু চুক্তির সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে ইউরোপের সাথে সহযোগিতার দ্বার খোলা রেখেছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে সিরিয়ায় মার্কিন ও তুর্কি প্রভাবকে ঠেকাতে ইরানের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে রাশিয়া।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি আঞ্চলিকভাবেও হাইব্রিড সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দেখাচ্ছে। যেমন বলা যায়, একে-অন্যকে পরম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা ইরান ও সৌদি আরবের কথাই। তাদের মধ্যে, এক ধরনের আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধ চলমান থাকলেও, সাম্প্রতিককালে তারা সরাসরি কূটনৈতিক সংলাপে অংশ নিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা পারস্য উপসাগরসহ ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে পরিস্থিতি অনুযায়ী আপসরফা এবং পারস্পরিক উত্তেজনা নিরসন করতে চাইছে।

একই ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কে। ইতোমধ্যেই সিরিয়ার আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে আমিরাত এবং ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে একপ্রকার সরেই এসেছে। আবার একইসঙ্গে ইরানের শত্রু ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

এক কথায় বলা যায়, পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের আমলে দুনিয়া যেভাবে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়েছিল, পরাশক্তিগুলোর প্রতি অনুগত রাষ্ট্রের যে নিবেদিত সমর্থন ছিল—বর্তমান চিত্রকে তার সাথে মেলানোই দায়। আজকের দুনিয়ায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলি একইসঙ্গে যুদ্ধ লড়ে, আবার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে ব্যবসাও করে। তার সাথে চলে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। উদ্দেশ্য অবশ্য আগের মতোই, নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। আর সেজন্যই যেকোনো পথে চলতে আর কুন্ঠিত নয়। এই পরিবর্তন হয়তো স্থায়ী ও বৈশ্বিক রূপই নেবে।
  
তবে পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা হাইব্রিড পররাষ্ট্রনীতি—আঞ্চলিক ও ভৌগলিক সমীকরণকে আরো জটিল রূপই দিচ্ছে। আগামীতে কোন হুমকি, কোন পথে আসতে চলেছে- তার অনুমান করাই হবে দুষ্কর। সংঘাত বিশ্বের কোন অঞ্চলে দানা বাঁধবে- তার নির্ণয়ও সহজ হবে না। সহজ হবে না সে ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টাও। একইসঙ্গে বলা যাবে না—কাল কোনো দেশ কার সাথে আপসের গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছে!

সব মিলে এই প্রশ্নই জাগে: বৃহত্তর থেকে হাইব্রিড জোটের এই নতুন বাস্তবতা কি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারবে? আপাতভাবে, এটি আন্তঃআঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাকে কিছু সময়ের জন্য কমাবে একথা সত্য, তবে এই ফাঁকে আঞ্চলিক শক্তিগুলো পারস্পরিক দ্বন্দ্বের স্থায়ী সমস্যাগুলোকে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে—আগের মতোই হিংসা ও হানাহানির ধারাবাহিকতাই দেখতে হবে তাদের।


  • লেখক: মারওয়ান বিশারা কাতার-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক 
  • সূত্র: আল জাজিরা অবলম্বনে 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.