ইউক্রেন যুদ্ধজয়ে প্রাচীন এক অস্ত্রের ওপর বাজি ধরেছেন পুতিন

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
23 July, 2022, 06:30 pm
Last modified: 23 July, 2022, 06:56 pm
ল্যাভরভ পশ্চিমা দুনিয়াকে যে বার্তা দিয়েছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘তোমরা যুদ্ধকে যত দীর্ঘস্থায়ী করবে, আমরা ততবেশি ভূমি ও সম্পদ দখলে নেব’-এমন ব্যাখ্যা করেন লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের অধ্যাপক ভ্লাদিস্লাভ ইয়ুবক।  

ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা যত শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রই দিক না কেন- যুদ্ধে জিততে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার চেয়ে আরও শক্তিশালী এক প্রাচীন অস্ত্র: 'সময়'-এর ওপর বাজি ধরেছেন।  

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরুর নির্দেশ দেন পুতিন। এর পর শুরু হয় আগ্রাসন। ইউক্রেনের অনেক অঞ্চল তাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের কারণে বাড়ছে জ্বালানি ও খাদ্যের বৈশ্বিক মূল্য—শেষপর্যন্ত এসব চাপে পশ্চিমাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে এমন আশাই করছে রাশিয়া। 

মূল্যস্ফীতির চাপ পৃথিবীকে মন্দার দিকেই নিয়ে চলেছে। ধনী ইউরোপীয় দেশগুলোও সেই চাপে পড়েছে। অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারগুলো সমালোচিত হচ্ছে। এর সঙ্গে আরো নানান কারণ থাকায়- সম্প্রতি পদত্যাগ করতে হয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও তার ইতালীয় সমকক্ষ মারিও দ্রাঘিকে। রাষ্ট্রায়ত্ত রুশ টেলিভিশন চ্যানেল ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই তাদের পদত্যাগকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের আরোপিত 'আত্মঘাতী' নিষেধাজ্ঞার ফলাফল বলে সগর্বে উল্লেখ করছেন।  

তারা প্রশ্ন তুলেছেন—এভাবে বিদায় নিতে বাধ্য হওয়া পরবর্তী পশ্চিমা নেতা কে হবেন? 

অন্যদিকে, চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া কেবল যুদ্ধ শুরু করেছে। রাশিয়ার চেয়ে অর্থনীতি ও প্রচলিত সামরিক অস্ত্রে বহুগুণ শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি বলেছেন- পারলে যেন যুদ্ধকে মস্কোকে পরাজিত করার চেষ্টা করে শত্রুরা। কিন্তু, তারা এতে ব্যর্থ হবে বলেও পুতিন উল্লেখ করেন। 

চলতি সপ্তাহে একটি নিরাপত্তা সম্মেলন- অ্যাস্পেন সিকিউরিটি ফোরামে অংশ নিয়ে মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সিইএ'র পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, 'ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়ক্ষতির এক যুদ্ধ চলছে, এতে পুতিন সফল (জয়ী) হওয়ার আশা করছেন'।   

বার্নস বলেন, কেজিবির এই সাবেক গুপ্তচর (পুতিন) বাজি ধরেছেন যে, তিনি 'ইউক্রেনের অর্থনীতির টুটি চেপে ধরতে পারবেন এবং ক্লান্ত করে তুলবেন- ইউরোপের নাগরিক ও রাজনীতিকদের। আমেরিকার সহ্যশক্তিতেও ফাটল ধরানোর আশা রাখেন পুতিন। তার দৃষ্টিতে, আমেরিকানরা সবসময় যথেষ্ট গুরুত্ব না পাওয়ার একপ্রকার মানসিক হীনমন্যতায় ভোগে, তাদের ইচ্ছেশক্তির অভাবও রয়েছে। যুদ্ধ হোক বা রাজনীতি—মূল লক্ষ্য রেখে তারা প্রায়ই অন্য বিষয় নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে'। 

ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পরিণতি সম্পর্কে পুতিনকে হুঁশিয়ারি দিতে গেল নভেম্বরেই বার্নসকে মস্কো পাঠান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সিআইএ পরিচালক স্বীকার করেন, তিনি মনে করেছিলেন রুশ নেতার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। 

কিন্তু, ক্রেমলিন ইউক্রেন থেকে পিছু হটার কোনো লক্ষণ দেখায়নি, উল্টো জানিয়েছে- ইউক্রেনে রাশিয়ার তার সব লক্ষ্য অর্জন করবে। 

১৮ বছর ধরে পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদাধিকারী এবং ঝানু রুশ কূটনীতিক সের্গেই ল্যাভরভ গত বুধবার জানান, পূর্ব ডনবাসের বাইরে ইউক্রেনের অন্য অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের অভিলাষ পুরোদমে আছে মস্কোর। দেশটির দক্ষিণসহ 'অন্যান্য কিছু প্রদেশের' বিপুল অঞ্চল অধিকার করতে চায় ক্রেমলিন। 

দখল 

গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানায়, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, রাশিয়া সম্পূর্ণ ডনবাস-সহ ইউক্রেনের দক্ষিণ উপকূলের খেরসন ও জ্যাপোরিঝিয়াকে নিজ ভূখণ্ডের সাথে একত্রীকরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

এই প্রক্রিয়া ইউক্রেনের দখলীকৃত ভূমিকে রাশিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করারই নামান্তর, যার মাধ্যমে এবার ইউক্রেনের ১৮ শতাংশের বেশি ভূমিতে রাশিয়ার অধিকার ঘোষণা করা হবে। এর আগে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর তা একত্রীকরণের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড অধিকার করে মস্কো।  

ল্যাভরভ সতর্ক করে বলেন, পশ্চিমারা যদি ইউক্রেনকে হাই-মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (হিমার্স) এর মতো দূরপাল্লার অস্ত্র দিতে থাকে—তাহলে রাশিয়া আরো বেশি ভূমি দখলের লক্ষ্য নেবে। 

ল্যাভরভ পশ্চিমা দুনিয়াকে যে বার্তা দিয়েছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, 'তোমরা যুদ্ধকে যত দীর্ঘস্থায়ী করবে, আমরা ততবেশি ভূমি ও সম্পদ দখলে নেব'-এমন ব্যাখ্যা করেন লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের অধ্যাপক ভ্লাদিস্লাভ ইয়ুবক।  

তার মতে, 'এটি মিথ্যে হুমকি হতে পারে, তবে রাশিয়া যদি (ইউক্রেনের) দক্ষিণাঞ্চলের ভূখণ্ড নিজ অধিকারে রাখতে চায়- তাহলেও আমি আশ্চর্য হব না'। 

রাশিয়ার হুমকিতে এপর্যন্ত বিচলিত হয়নি আমেরিকা। এপর্যন্ত ইউক্রেনকে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে নিরাপত্তা সহযোগিতা হিসেবে দিয়েছে ওয়াশিংটন। অচিরেই আরো ৪টি হিমার্স সিস্টেম কিয়েভের হাতে তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন।  

এ বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে- ইউক্রেনে লড়াই শেষপর্যন্ত কোন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে? 

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ফোর্ড সম্মাননাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্যারি আর. পোসেন বলেন, 'আমি মনে করি, বর্তমানে রণাঙ্গনে দুই পক্ষের যে অবস্থান তার রদবদল হবে না খুব একটা, রক্তক্ষয়ী এক স্থিতাবস্থায় রূপ নেবে সংঘাত। তখন অস্ত্র-বিরতি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হতে পারে'।   

তার মতে, '(চুক্তির পরও) অস্বস্তিকর এক অবস্থা তৈরি হবে, সংঘাতের হুমকি হবে সার্বক্ষণিক। তারমধ্যেই দখলীকৃত অঞ্চলে আমরা অবৈধ অভিবাসন উৎসাহিত করার একটি সামরিক-রাজনৈতিক শাসনের যুগ দেখব'।


  • সূত্র: রয়টার্স   
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.