মোবাইল ফোন ডলারের বিরুদ্ধে এশিয়ার তুরুপের তাস!
মুদ্রার দরে উত্থানপতন ঘটে সকল সময়েই। কখনো কখনো এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং শিল্পে ফেলে সুদূরপ্রসারী এবং স্থায়ী প্রভাব। যেমনটা ঘটেছিল ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ পাউন্ডের বেলায়, সে সময় মুদ্রাটির অবমূল্যায়ন ছিল ব্রেটন-উডস সম্মেলন পরবর্তী যুগের দিনবদলের প্রতীক। এর ফলে এশিয়ায় মার্কিন ডলারের চাহিদা আকাশ্চুম্বী হয়। ডলার নিয়ে এ উন্মাদনার সুযোগ নিতে সিঙ্গাপুরে একটি আন্তঃসীমান্ত আর্থিক লেনদেনের সংস্থা-ই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন ব্যাংক অব আমেরিকার সাথে সংশ্লিষ্ট এক ডাচ মুদ্রা ব্যবসায়ী- ডিক ভ্যান ওয়েনেন।
ওই ঘটনার অর্ধ-শতক অতিবাহিত হয়েছে। তবে আরও একবার মুদ্রা-নির্ভরশীলতা নিয়ে আলোচনার পাদপ্রদীপে ফিরেছে মার্কিন ডলার। ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধিতে ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্য এখন ডলারের। আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি কমানো এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে শায়েস্তা করা—এ দুটি লক্ষ্য নিয়ে ডলারকে শক্তিশালী করেছে ওয়াশিংটন। এ পদক্ষেপ কিন্তু ভবিষ্যতের ওপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে ইতোমধ্যেই।
দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনটা এবার ডলারের পক্ষে যাবে না। কারণ, এশীয় ব্যাংকগুলো ডলারের চাহিদা কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
চাহিদা কমানোর এ প্রক্রিয়াকেই বিশ্লেষকরা বলেন- 'ডি-ডলারাইজেশন'। আসলে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা কোন মুদ্রায় ইনভয়েস বা মূল্য চালান লেনদেন করবেন—তা নির্ধারণ করে দিতে পারে না আর্থিক সেবাদাতারা। বিনিয়োগকারীরা যদি শক্তিশালী ডলারে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করেন—তাতেও বাধ সাধার সুযোগ কম তাদের। তবে অর্থায়নকারীরা যেসব আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে মার্কিন মুদ্রায় বিনিময় অদরকারি, সেখানে এর সরবরাহ কমাতে পারে।
প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলেও তা সহজে করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ২০০১ সালে প্রথম মুঠোফোনের মাধ্যমে লেনদেন শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া। এক দশক পর চালু হয় চীন ও ভারতে। এরপর কিউআর কোড স্ক্যানের উদ্ভব এবং স্মার্টফোন হাতে হাতে চলে আসায় দ্রুত হয়ে উঠেছে সেবাটির বিস্তার। এখন এশিয়ার দেশে দেশে মুঠোফোন-ভিত্তিক আর্থিক সেবা পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা। গ্রাহকের থেকে সেবা বা পণ্যের দাবীকৃত মূল্য তাৎক্ষণিকভাবে পাচ্ছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এই অগ্রগতি এতটাই বিস্ময়কর গতিতে হয়েছে যে, ২০২১ সালে BI-FAST নামক খুচরা লেনদেন ব্যবস্থা চালু করে ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে একই রকম সেবা চালুর প্রস্তাবিত সময়ের (২০২৩ সাল) দুই বছর আগেই তা করা হয়।
এশিয়ার প্রতিটি দেশ সফলভাবে মুঠোফোনের আর্থিক খাতকে বিকশিত করছে। নীতিনির্ধারকরা এখন এই সাফল্যকে এক ছাতার নিচে এনে আরও বড় লেনদেন নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে চান। আন্তঃসীমান্ত এ নেটওয়ার্ক দেশগুলির স্থানীয় লেনদেন ব্যবস্থাকে যুক্ত করবে। খুব শিগগির যা চালু হতে পারে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পাঁচটি বড় অর্থনীতি- ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে। সম্প্রতি বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের বৈঠকে একথা জানিয়েছেন ব্যাংক অব ইন্দোনেশিয়ার গভর্নর পেরি ওয়ারিজো।
পরিকল্পনা অনুসারে, থাইল্যান্ডে কেউ যদি ইন্দোনেশীয় অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করেন- তাহলে এর মূল্য সরাসরি ইন্দোনেশীয় রুপিয়াহ থেকে থাই বাথে রুপান্তরিত হবে। ইন্দোনেশিয়ায় থাই অ্যাপ ব্যবহারেও মিলবে একই সুবিধা। ফলে মাঝখান থেকে দূর হবে ডলারের মধ্যসত্ত্ব ভূমিকা।
এর অর্থ হচ্ছে- স্বল্প মূল্যের কেনাকাটার ক্ষেত্রে, এই লেনদেন ব্যবস্থায় যুক্ত একটি অর্থনীতির ব্যাংক একাউন্ট, বাকি চারটি অর্থনীতির সাথে লেনদেনযোগ্য হবে।
এতে সবচেয়ে সুবিধা মিলবে আঞ্চলিক পর্যটনের বিকাশে। যেমন পর্যটকরা যখন ক্রেডিট কার্ডে মূল্য পরিশোধ করেন তখন তাদের বাড়তি ফি দিতে হয় সেবাদাতা কোম্পানিকে। সঙ্গে ডলারের বিপরীতে নিজ দেশের মুদ্রার অসুবিধাজনক বিনিমর দরেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু নতুন লেনদেন ব্যবস্থায় ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমণকারী সিঙ্গাপুরের কোনো নাগরিক যখন মুঠোফোনে পেমেন্ট করবেন- তখন তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে সম-পরিমাণ সিঙ্গাপুরি ডলার কেটে নিয়ে তা মার্চেন্ট বা সেবাদাতার একাউন্টে রুপিয়াহ দিয়ে পরিশোধ করা হবে। কিউআর কোডের মাধ্যমেও করা যাবে এ লেনদেন, ফলে তা স্থানীয়ভাবে করা আর্থিক লেনদেনের চেয়ে মোটেও আলাদা কিছু হবে না।
গত বছর সিঙ্গাপুরের মোবাইলে ব্যাংকিং সেবাদাতা পে-নাউ বিশ্বের প্রথম আন্তঃদেশ সংযোগ স্থাপন করে থাইল্যান্ডের প্রমপট-পে'র সাথে। এতে দেশদুটির মোবাইল ব্যবহারকারীরা সরাসরি নিজেদের মধ্যে লেনদেনের সুযোগ পেয়েছেন।
আঞ্চলিক এই লেনদেন নেটওয়ার্ক যদি ভৌগলিকভাবে বিস্তার লাভ করে—তাহলে ব্যবসা ও ভোক্তা বান্ধব পেমেন্টের সুযোগ সকলেই নিতে উৎসাহী হবে। কিউআর কোড দিয়ে মূল্য শোধ করায় গোপনও থাকবে মূল্যদাতার ফোন নম্বর। সম্প্রতি এই সুবিধা একে-অপরের ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকদের দেওয়া শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি হবে ব্যাংকিং খাতে। প্রতিটি দেশে একটি বড় ব্যাংকিং সংস্থাকে সার্বিক পেমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হবে। ওই দেশের কোনো গ্রাহক যখন অন্য দেশে গিয়ে কিউআর কোড দিয়ে মূল্য পরিশোধ করবেন—তখন ওই গ্রাহককে অ্যাপ স্ক্রিনে মুদ্রার বিনিময় হার জানাতে হবে সংস্থাটিকে। ভোক্তা যদি ওই হারে মূল্য দিতে সম্মতি দেন—তাহলে ওই গ্রাহকের সেবাদাতা ব্যাংক অন্য দেশের ব্যাংককে টাকা পাঠাবে। দিনে দুইবার মধ্যস্ততাকারী উভয় বৃহৎ ব্যাংককে একে-অন্যের সকল পাওনা অর্থ পরিশোধও করতে হবে।
প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জিং হলেও বেশ সম্ভাবনাময় এবং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা সব দেশের জন্যই এতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু রয়েছে, এরা সকলে যোগ দিলে এটি 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব' এর মতোই লেনদেনের এক বৈশ্বিক জালে রূপ নিবে। এতে ভোক্তারাও যে লাভবান হন- সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের ঘটনা এরমধ্যেই তা প্রমাণ করেছে'।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক অ্যান্ডি মুখার্জি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।